(পূর্বে প্রকাশের পর)১২
আমার শৈশবের কথা বলতে গিয়ে মা অনেক পরে একবার বলেছিলেন যে জন্মগ্রহণ করার পর আমার কানে আযান দেয়া হয়েছিল এবং আযান দিয়েছিলেন আমার এক মামা। আমার এখন মনে হয় জন্মের পর সুললিত কণ্ঠে একটি শিশুর কানে আযান দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে একটি মধুময় মুহূর্তের মধ্যে জাগ্রত করা। এই কথাটি এইজন্য বললাম যে, ইসলামে সর্বপ্রথম যখন আযান প্রবর্তিত হয় তখন সর্বপ্রথমেই অনুসন্ধান চলেছিল একটি সুললিত কণ্ঠস্বরের এবং সে সুললিত কণ্ঠ ছিল হযরত বেলালের। উপমা স্বরূপ বলা হয়েছে যে হযরত বেলালের আযান শুনে পশুপাখি এবং গাছের পাতা স্তব্ধ হয়ে থাকতো। মনে হয় তারা যেন সেই সুললিত সুর লহরী শ্রবণ করছে। আযানের মধ্যে এভাবেই ইসলামের প্রাথমিক যুগেই সঙ্গীতের সুষমা দান করা হয়েছিল-যেন সেই সুষমায় আকৃষ্ট হয়ে সকলেই নামাজের জন্য একত্রিত হয়। সুতরাং শিশুর কানে আযান দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে আনন্দের মধ্যে, সুর-সাম্যের মধ্যে এবং সংহতির মধ্যে বরণ করে নেওয়া। এই আপাততঃ ধর্মীয় ব্যাপার বলে মনে হলেও এটি একটি সামাজিক আচরণ এবং বিধি। হিন্দু সমাজেও অনুরূপ বিধি প্রচলিত আছে। তারা শিশুর কানে মন্ত্র দেয়। তাদের মন্ত্র দেওয়াটা একটি ধর্মীয় বিশ্বাস। কিন্তু আমার মনে হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের চাইতেও এখানে বড় কথা হচ্ছে একটি শিশুকে আমি কর্কশ শব্দের সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছি, না সুমধুর সুর লহরীর সঙ্গে? আমার মনে হয় ধর্মীয় চিন্তাটাকে অস্বীকার না করেও আমরা বলতে পারি যে শিশু জন্মলগ্নেই পৃথিবীর মধুরতার সঙ্গে পরিচিত হোক এই বোধহয় আমাদের আন্তরিক অভিপ্রায়, অন্তত শুরুতে বোধহয় তাই ছিল।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, একটি শিশু মাতৃক্রোড়ে যখন থাকে তখন যে স্নিগ্ধ বাতাস তাকে স্পর্শ করে যায় অথবা যেসব শব্দ তার কানে সাড়া তোলে সেগুলো কোনোদিন হারিয়ে যায় না জীবনে তার জাগরণ এগুলোর মধ্য দিয়েই। শৈশবের নিস্পাপ পবিত্রতা সারা জীবন তাকে উদ্বেলিত করে এবং প্রায় সময় ও আকাঙ্ক্ষীকে নির্মাণ করে। বড় হয়ে যখন ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়েছিলাম তখন এ কথাগুলো আমার বড় ভালো লেগেছিল এবং তখনই আমার শৈশব মুহূর্তের সমস্ত গ্লানির অপসারণ করে আমাকে আনন্দিত করেছিল। শৈশবের কোনো ঘটনাই কিন্তু হারিয়ে যায় না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেভাবে বলেছেন যে আমরা বিপুল উজ্জ্বলতায় এবং মনোহারিত্বে এই পৃথিবীতে আসি বিধাতার কাছ থেকে যিনি আমাদের পরম আশ্রয় এবং সান্ত্বনা।
বাবা কখনো কখনো গল্প বলতেন এবং গল্পগুলো মহাপুরুষদের কাহিনী। কিন্তু তিনি কোনরূপ উপদেশের কথা বলতেন না। তিনি অন্তরঙ্গ সুরে আকর্ষণীয় করে গল্পের মতো করে কাহিনীর ক্রমধারা তৈর করতেন এবং আমরা শুনতাম। এই শোনার মধ্য দিয়ে আমি একটি সমৃদ্ধ জীবনকে প্রত্যক্ষ করতাম, কিন্তু অভিজ্ঞতার প্রশ্রয় ছিল বলে তখন সে কথা বলতে পারতাম না। আজ মনে হয় জীবনে স্রোতস্বিনী সমস্ত স্মৃতিকে একত্রিত করে আমার সম্মুখ দিয়ে নিয়ে চলেছে। আমি সব স্মৃতিকে ধরে রাখতে পারছি না। স্মৃতির কোনো ধারাবাহিকতা নেই; কিন্তু একটি বালকের চিত্তে শৈশবকালের অভিজ্ঞানগুলোর একটি ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই নির্মাণ করে। আজ তাই স্মৃতিকে অনুধাবন করতে গিয়ে আমার মার সুন্দর মুখকান্তি এবং বাবার বিনম্র তন্ময়তা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
বার্ট্টান্ড রাসেল বলেছেন যে গৃহের অনুভূতি এবং অন্তরঙ্গ সকলের অনুভূতি শিশুর মনে তখনই জাগতে আরম্ভ করে যখন সে ঘরের মেঝেতে ধুলোর ওপর আঙ্গুল দিয়ে দাগ কাটতে শেখে। তখনই সে একটি বীজ বপন করে যা পরিণতিতে একটি বিরাট বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়। শিশুর পরিচিত পৃথিবী প্রথমে একটি কক্ষ, ক্রমান্বয়ে অনেকগুলো কক্ষ অবশেষে সমগ্র একটি গৃহ এবং সর্বশেষে একটি দেশ। যে দেশের বাতাস এবং পানি তাকে উচ্ছল এবং জীবন্ত করে। কথাগুলো অত্যন্ত মধুর এবং উষ্ণ। শৈশবের বরাভয় মানুষের জীবনের একটি আশ্রয়ের মতো, একটি উজ্জ্বলতার মতো একটি মধুর বেদনার অভিষেকের মতো। আমি তো আমার মধুর শৈশবকে কখনোই ফিরে পাব না কিন্তু স্মৃতিগত তাৎপর্যে তা আমাকে চিরকাল সম্মানিত করছে, আমাকে সমৃদ্ধ করছে এবং আমার অগ্রযাত্রাকে দীপান্বিত করছে।
আমার শৈশবকালে গ্রামের জীবনে পরিচ্ছন্নতা ছিল, তাই সকল দৃশ্যেরই সুস্পষ্টতা ছিল। কথার ভিড় ছিল না, মানুষের ভিড় ছিল না, শুধু গাছ ও লতাপাতার ভিড় ছিল এবং অফুরন্ত সবুজের ঔদার্য ছিল। এবং সেই ঔদার্যের মধ্যে যেসব শব্দ এসে ভিড় করতো তাদের কোনো পরাভব ছিল না। বড় হয়ে বুঝেছি এ শব্দ যেমন বিশ্বাস ও অনুভূতির আদিমতা, তেমনি প্রত্যয়ের দৃঢ়তা, তেমনি জিজ্ঞাসার অস্থিরতা, তেমনি অসম্ভবের আয়োজন।
চিত্রকর যেমন রঙ দিয়ে রেখা দিয়ে ভাষার সন্ধান করেন, একজন কবিও তেমনি প্রতিদিনের বিশ্বে কল্লোলিত কলকণ্ঠের মধ্যে শব্দের ঔদার্য এবং সম্মোহন সন্ধান করেন। শৈশবে গ্রামে সুদুর্লভ সবুজের বন্যায় আমি যখন কোনো পাখির কণ্ঠস্বর শুনতাম তখন পাতায় পাতায় বাতাসের সাড়ায় জীবনের স্পন্দন অনুভব করতাম। প্রতিদিন ঘাসের সৈকতে সবুজের সমারোহে আমার নিরুদ্ধ কণ্ঠ তখনই মর্মের গভীরে যথার্থ কবিতায় বাঙময় হয়েছিল। সেদিনের কথা আজো যেন চিরকালের এ মুহুর্তেরই কথা। কবিতা পাঠে আমি আনন্দিত হই এবং কবিতা স্নায়ুকে শিহরিত করে। দুঃখ নিয়েই হোক অথবা ব্যর্থতা নিয়েই হোক কবিতা আমার জন্য একটি উৎসবের আয়োজন। শব্দ যখন আমাকে অভিভূত করে তখন আমি আমার শৈশবের দিন যাপনের রহস্যকে স্বাগত করি। সেই কবে কোন অতীতে শব্দের কম্পন জেগেছিল আজও তার জন্য আমার কাতরতা রয়েছে। আমি সেই কাতরতার সাহায্যে আমার বর্তমানের বিশ্বাসের অভিধর্ম এবং উপলব্ধির উতরোল নির্মাণ করেছি।
একটি শিশুর শৈশবেই অসুস্থতার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং মৃত্যুর সঙ্গেও। সে তার চারপাশের পরিজনদের মধ্যে কাউকে অনেকদিন শয্যাশায়ী থাকতে দেখে এবং কাউকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে দেখে। এর তাৎপর্য সে বোঝে না, যথার্থ কোনো কারণে একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না এবং শয্যায় শুয়ে থাকে তা সে বোঝে না, কিন্তু তার মনে কৌতুহল জাগে। সেই কৌতুহলবশতঃ রোগীর শয্যাপার্শ্বে আসে এবং তাকে স্পর্শ করতে চায়। রাত্রিতে যেমন মানুষ বিছানায় শুয়ে থাকে সম্ভবত রোগীর শয়নকে সে তার সঙ্গেই সমার্থক ভাবে এবং বড় হয়ে যখন রোগের সঙ্গে সে মুখোমুখি হয় তখন শৈশবের স্মৃতি তাকে ধৈর্য শেখায় এবং সান্ত্বনার বরাভয় আনে।
মানুষের জীবনে কতগুলো অনুভূতি থাকে সে অনুভূতিগুলোদৃষ্টির, স্বাদের, ঘ্রাণের, শ্রবণের এবং স্পর্শের। এই অনুভূতির সাহায্যেই আমরা প্রাণবন্ত মানুষ বলে পরিচিত হই। শিল্প ও সাহিত্যকর্মে এসব অনুভূতির দায়ভাগ প্রচণ্ড। পৃথিবীর সকল বস্তুর তাৎপর্য সৌন্দর্য এবং মোহনীয়তাকে আমরা অনুভব করি এসব অনুভূতির সাহায্যেই। শীতকালে রোদের তাপটি ভালো লাগে, গ্রীষ্মকালে ছায়া ভালো লাগে। এটা স্পর্শের অনুভূতি থেকেই জাগে। তেমনি অন্যান্য অনুভূতিও। এসব অনুভূতি নিয়েসৃষ্টিকামী মানুষ তাদের সৃষ্টিকর্মের কল্যাণ ব্রতে অগ্রসর হয়। আমার জীবনে এবং আমার জীবনেই বা বলি কেন সকলের জীবনেই শৈশবকালেই এ সমস্ত অনুভূতির উন্মেষ ঘটে। তবে শৈশবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা থাকে না, তাই বিশ্লেষণ করতে আমরা পারি না, আমরা শুধু ভালো লাগাকে ব্যক্ত করতে পারি। অসুস্থতার পর অতি সাধারণ খাবারও আমার কাছে সুস্বাদু হয়ে উঠেছিল। সেই খাবারের স্বাদ এবং মধুর অনুভূতি। আজো আমি অনুভব করি।
সেকালের জীবনে এই পরিচ্ছন্নতাই ছিল মানুষের স্বভাব এবং অনুশীলন। যেমন একটি শিশু খেলা করতে গিয়ে ঘাসের গন্ধের মধ্যে নিরাবরণ পরিচ্ছন্নতায় শুয়ে পড়ে তেমনি পরিচ্ছন্নতা ছিল জীবনের সকল ক্ষেত্রেই। প্রকৃতির বদান্যতা ছিল শংকা ছিল , ভবিষ্যতের জন্য কোন অভিপ্রায় ছিল না কিন্তু একটি মধুর অনুভূতির বিস্ময়কর এবং লীলাময় প্রশান্তি ছিল।
লেখার প্রতি সম্মান এবং লেখনীর প্রতি সম্মান, এমনকি যে কালি দিয়ে কোনো কিছু লেখা হয় এবং যে কাগজের উপর লেখা হয় সেসবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমি দেখেছি। আমাদের হাতে মুখে কালি লাগলেও পায়ে যাতে কালি না লাগে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য থাকতো। কলম মাটিতে পড়ে গেলে তুলে নিয়ে চুমু দিতাম। মা বলতেন কলম, কালি এবং কাগজ হচ্ছে পবিত্র। তার কারণ কুরআন শরীফ কাগজের উপর কালি এবং কলম দিয়ে লেখা হয়ে থাকে। আমরা কাগজ কলম ও কালির প্রতি সম্মান দেখিয়ে মূলতঃ কুরআন শরীফের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করে থাকি।
যে সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি সে সময় গ্রামীন মানুষের জীবন ছিল স্বনির্ভর । জীবনের সকল প্রকার কর্মকাণ্ডের উপকরণ তারা নিজেরাই সংগ্রহ করতো। এই আশ্চর্য সাবলীল স্বনির্ভরতা আজকের দিনে কল্পনা করা অসম্ভব।