(পূর্বে প্রকাশের পর)১৪
অন্য একটি গ্রন্থ সে সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। সেটা হচ্ছে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড অর্থাৎ রত্নদ্বীপ। এ বইটিতেও একটি নির্জন দ্বীপের মধ্যে গুপ্তধনের সন্ধানের কথা আছে। কিন্তু এই গ্রন্থে সমষ্টিগত চেতনাটি প্রবল, একক চৈতন্য নয়। একদল লোক সংঘবদ্ধ হয়ে গুপ্তধন সন্ধান করতে গেল এবং অন্য একটি দল তাদের বিরোধিতা করল। কাহিনীটি খুবই উপভোগ্য। কিন্তু রবিনসন ক্রুসো অথবা মন্টিক্রিস্টো অথবা ক্যাপ্টেন নেমোর কাহিনীতে মানুষের যে পরিচয়কীর্তিত হয়েছে রত্মদ্বীপে সেই জীবন-দর্শনটি নেই। রত্নদ্বীপ একটি উপভোগ্য কাহিনী মাত্র। কাহিনীতে একটি ঘটনাপ্রবাহ আছে একটি অগ্রসরমানতা আছে, একটি রহস্য সংবেদন আছে কিন্তু একক কোনো মানুষের বিশিষ্টতা নির্ধারণের প্রয়াস নেই।
আর একটি বই আমি পড়েছিলাম। সেটি পুশকিনের একটি উপন্যাসের বাংলা সংক্ষিপ্তসার। বইটির নাম ছিল রাশিয়ার দুর্গেশনন্দিনী'। এ বইটিতেও অসম সাহসিকতার কথা আছে, বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়ার কথা আছে এবং অবশেষে পরাজয়ের মধ্যেও জয়ের উপঢৌকন আছে। কাহিনীটি আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে যে গল্পটি আমি খুব উপভোগ করেছিলাম। সে সময় গ্রন্থের পর গ্রন্থ আমি পাঠ করেছি। একটি বিপুল বিস্ময়ের পৃথিবী আমার কাছে উম্মোচিত হয়েছিল। আমি জেনেছিলাম যে মানুষের জীবন নির্ভাবনাময় নিশ্চিত এবং সাধারণ নয়। আমরা অসাধারণকে জীবনে আবিষ্কার করতে এবং অসাধারণের সঙ্গেও নিজেকে সমন্বিত করতে পারি। মানুষ পরাজিত হলেও নিঃস্ব হয় না, সংঘর্ষকে গ্রাহ্য করে সর্বশক্তি দিয়ে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়ে সে অপরাজেয় হতে পারে। হতাশার কোনোপ্রতিবিধান নেই, কিন্তু পার্থিব পরাজয়ের প্রতিবিধান আছে- যাকে চার্চিল বলেছিলেন, ডিফায়েন্স। অর্থাৎ পরাজিত হলেও নতি স্বীকার করবো না। তিনি বলেছিলেন যে জয়ে আমি উদার হবে। কিন্তু পরাজয়ে উদ্ধত হবে। মানুষের মনুষ্যত্ব এবং শক্তির তাৎপর্য এখানেই যে ইচ্ছে করলে সকল শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হতে পারে। ইচ্ছা এবং অকুতোভয় মানুষকে জীবনক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে। পরাজিত হলেও আমরা যেন হারিয়ে না যাই। সময় আমার অনুকূলে না থাকতে পারে কিন্তু অবিচল থেকে সৌম্য ভাবের সাহায্যে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। যে অবস্থায়ই থাকি না কেন জীবনে কুশল নির্মাণ করাই মানুষের কর্তব্য। শৈশবে এই কুশলতার ইঙ্গিতগুলো আমি প্রথম পেয়েছিলাম।
গ্রন্থ পাঠ একটি আসক্তির মতো। শৈশব থেকে এ আসক্তি গড়ে না উঠলে পরবর্তী জীবনের গ্রন্থের প্রতি আকর্ষণ জন্মগ্রহণ করে না। শৈশবে চিত্তে জটিলতা থাকে না কিন্তু তখন একটি পরিচ্ছন্ন প্রদেশের মতো সে সময় গ্রন্থ পাঠের সাহায্যে একজন বালক পৃথিবীকে জানতে শেখে এবং তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমণে অগ্রসর হয়। আমার মনে আছে স্কুলে যখন ডক্টর ওয়েন্ট কর্তৃক সংক্ষেপিত এবং সরলীকৃত ভিকার অব ওয়েবফিল্ড’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম তখন এই উপন্যাসে লেখকের একটি উক্তি আমাকে অভিভূত করেছিল। কোনো একটি চরিত্রের পরিচয় সূত্রে লেখক মন্তব্য করেছিলেন হ্যান্ডসাম ইজ দ্যাট হ্যান্ডসাম ডাজ' অর্থাৎ সেই সুন্দর যে সুন্দর কাজ করে। এ কথাটি সেই বয়সেই কেন যেন আমাকে ভাবিত করেছিল। সৌন্দর্য তত্ত্ব বুঝবার বয়স তখন আমার হয়নি। যথার্থ সৌন্দর্য কি তা নির্ণয়ের কোনো কৌশলও আমার জানা ছিল না। আমি শুধু নিখুঁত শুভ্রশুচি দৃশ্যমান অবয়বকে সুন্দর বলে ভাবতে শিখেছিলাম। কিন্তু এ লেখাটি পড়ে আমার মনে হল বাইরে মানুষের আকৃতি যে রকমই হোক না কেন সে যদি নিজেকে শুভকর্মে নিযুক্ত না রাখে তাহলে তাকে কি করে আমি সুন্দর বলবো?
নদী যত আঁকাবাকাই হোক যদি তার বহমানতা থাকে তাহলেই সে সুন্দর। কিন্তু আবদ্ধ একটি জলাশয় আবর্জনা সংগ্রহ করে। তার প্রবহমানতা নেই। তাই তার সৌন্দর্য নেই। সম্ভবতঃ ষষ্ট কিংবা সপ্তম শ্রেণীতে এ বইটি আমি পড়েছিলাম। বহুদিন পর্যন্ত এ বইটির কথা আমার মনে ছিল।স্কুল জীবনেই আমি হুইটম্যানের কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। যদিও কবিতা সম্পর্কে শিল্পগতভাবে সচেতন হবার বয়স তখন হয়নি, কিন্তু হুইটম্যানের শব্দের ধ্বনি আমাকে সম্মোহিত করতো। আমার মনে হয় কৈশোরে একজনের চিত্তে যে পরিচ্ছন্নতা থাকে তখন কোনোপ্রভাব যদি পড়ে সে প্রভাব আজীবন রক্ষিত থাকে। হুইটম্যান আমার কাব্যকর্মের পশ্চাতে সব সময় উৎসাহ হিসাবে কাজ করেছে এবং ঐ উৎসাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আমার শিক্ষকআলাউদ্দিন আল আজাদ।
আমাদের অতীত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয় করা খুব কঠিন। মরিস মেটারলিংক বলেছেন যে অতীত কুয়াশাচ্ছন্ন ও পরিত্যাক্ত নগরের মতো দিথলয়ে ঘুমন্ত থাকে। এর সীমারেখার মধ্যে দু'একটি পর্বতচূড়া দেখা যায় যার উপর হয়তো আলো পড়ে। অন্যত্র সবকিছু ধ্বংস প্রাপ্ত একটি বিলয় সৃষ্টি করে । দূরের গাছগুলোর পাতা থাকে না, অট্টালিকার দেয়ালগুলো ভেঙ্গে পড়ে এবং ছায়া সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে। সমস্তই যেন মৃত এবং নিশ্রুপ। শুধুমাত্র স্মৃতি দু'একটা অঞ্চলকে আলোকিত করে। এই স্মৃতি অতীতের একমাত্র অস্তিত্ব যা জীবন্ত। আমার জন্য বর্তমানের চাইতে এবং ভবিষ্যতের চাইতে স্মৃতির অস্তিত্বটা বিরাট এবং গভীর। আমার অস্তিত্বের সমস্ত সৌভাগ্যটাকে এ অতীত ধারণ করে আছে এর ঐশ্বর্যের পরিসীমা নেই।
স্কুলে থাকতে রুশ বিপ্লবের কথা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম না বলে পড়েছিলাম বলাটাই ভালো। দৈনিক সংবাদে কবীর চৌধুরী একটি লেখা পড়েছিলাম, রুশ বিপ্লব সম্পর্কে বিচিত্রিত এই প্রবন্ধটি আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে রাসপুটিনের হত্যাকাও আমার কাছে রোমাঞ্চকর এবং ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল। কেরেনিস্কি বলেছিলেন ‘রাসপুটিন না হলে লেনিন হতেন না এবং জার নিকোলাসের পুত্র আলেক্সি অসুস্থ না হলে রাসপুটিনের আবির্ভাব ঘটতো না। কথাটি হেয়ালির মতো কিন্তু কথাটি সত্য। জারের ছেলে আলেস্কি জন্ম থেকেই অসুস্থ ছিল, তার রোগ কোনক্রমেই নিরাময়ের ছিল না। এ সময় অকস্মাৎ রাসপুটিনের আবির্ভাব ঘটে এবং তার স্পর্শে আলেস্কি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। এর ফলে জারিনা রাসপুটিনের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে পড়েন। ক্রমান্বয়ে রাসপুটিন জারিনার ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করে এবং বলতে গেলে তারই নির্দেশে রাজ্য শাসন চলতে থাকে। রাসপুটিন ছিল ভয়ংকর মানুষ। দীর্ঘ আয়তনের এই গ্রাম্য পুরুষের মেয়েদের মতো চুল ছিল শুশ্রু এবং গোঁফ ছিল অশোধিত। চোখের দৃষ্টি ছিল সাপের মতো সবুজ। সে কারো দিকে দৃষ্টিপাত করলে সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মোহিত হয়ে পড়তো। যখন রাসপুটিনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন প্রাসাদ অভ্যন্তরে রাসপুটিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে উঠলো। এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন প্রিন্স ইউসুপভ। তিনি রাসপুটিনকে তার গৃহে মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানালেন।
রাসপুটিন আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। এর পরের ঘটনা অস্বাচ্ছন্দ্যকর বীভৎস এবং অস্বাভাবিক। রাসপুটিনকে পটাশিয়াম সায়োনায়েড ভরা কেক খেতে দেয়া হয়েছিল এবং মদের মধ্যেও সায়োনায়েড বিষ মেশানো ছিল। রাসপুটিন নিশ্চিন্তে কেক হজম করে ফেললো মদ্যও পান করলো প্রচুর পরিমাণে। এই বিষ বহু মানুষকে হত্যার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু রাসপুটিন নিশ্চিন্তে এই বিষ হজম করে বসে রইল। ইউসুপভ ভীত হলেন, শংকিত হলেন এবং শেষ পর্যন্ত সরাসরি গুলি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। গুলি করার পরও রাসপুটিন মরলো না। সে অমানুষিক চিৎকার করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্রাসাদের বাইরে আঙ্গিনায় বরফের উপর দিয়ে স্রোতের মতো হেঁটে চললো। তার শরীরকে পেছন থেকে গুলি দিয়ে ঝাজরা করে দেয়া হল যখন, তখন সে বরফের উপর দু'হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়লো। ইউসুপভ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে রাসপুটিনের দেহ চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে দড়ি দিয়ে বেধে জমাট বাঁধা নেভা নদীর বরফের নীচে তলিয়ে দিলেন।
আমি সে সময় স্কুলে জার নিকোলাসের একেটারেনবুর্গ দুর্গে পরিবার-পরিজনসহ নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পড়েছিলাম। কিন্তু জারের জীবন আমার কাছে নাটকীয়ভাবে আকর্ষণীয় মনে হয়নি। জার নিকোলাস ছিলেন একজন দুর্বল শাসক এবং জনগণের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দেশে কি ঘটছে তা তিনি জানতেন না। তার অনুচরবৃন্দ তাকে যা জানাতো তাই তিনি বিশ্বাস করতেন। এভাবেই নিজের অজ্ঞাতসারে দেশের সঙ্গে একটি চরমতম অসদ্ভাব তৈরি করেছিলেন। আবেগহীন ঘাতকদের হাতে তার মৃত্যু হয়েছিল এবং এ হত্যাকাণ্ডের এমন কোনো অভিনবত্ব ছিল না। শুধুমাত্র সন্তান আলেক্সির প্রতি জার এবং জারিনার মমতা বন্ধনটি আমাকে কিছুটা বিচলিত করে। জার নিকোলাস এবং জারিনা আলেকজান্দ্রিয়ায় আপন সন্তান আলেক্সিকে নিয়েই অধিকাংশ সময় বিব্রত থাকতেন। তাদের এই সাংসারিক এবং পারিবারিক দুঃখটি সকল মানুষকেই অভিভূত করে। আমার কাছে সেই সুদূর শৈশবে রাসপুটিনের ভয়ংকরের সঙ্গে অধিবাস রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল।
রুশ বিপ্লবের কাহিনী জানলেও মার্কসীয় তত্ত্ব আমি তখনো বুঝতাম না এবং আমাদের স্কুলে রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ কোনো কথকতাও হত না। দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন সরকারী হাই স্কুলের একটি নিয়ম ছিল যে প্রতিদিন স্বদেশ এবং বিদেশের উল্লেখযোগ্য সংবাদ সংগ্রহ করতে হত। একটি বড় ব্লাকবোর্ড ছিল যেটি দোতলার সিঁড়ির কাছে দেয়ালের পাশে স্থাপিত থাকতো। উক্ত ব্লাকবোর্ডে প্রতিদিন সকালে এসে ১০টি উল্লেখযোগ্য খবর লিখতে হত। কে লিখবে সেটাই শিক্ষক ঠিক করে দিতেন। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্ররাই এটা লিখতো। আমিও অনেকদিন লিখেছি। আমি বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এবং খবরের কাগজ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতাম এবং খুব নিপুণতার সঙ্গে ব্লাকবোর্ডে লিখতাম। আমি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংবাদও দিতাম। আমার এখনো মনে আছে সৈয়দ মুজতবা আলী দেশে-বিদেশে ভ্রমন কাহিনী কথা আমি লিখেছিলাম। এভাবে দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন সরকারী হাই স্কুলের ছাত্রদের আধুনিক জীবনের সঙ্গে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটি ব্যবস্থা ছিল। আমরা নিজেদের চেষ্টায় জেনেছি অনেক কিছু কিন্তু স্কুলের পক্ষ থেকেও এই জানার সুযোগ করে দেয়া হত।
(চলবে...)