বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশ
Published : Saturday, 26 March, 2022 at 12:00 AM
শামসুজ্জামান খান ||
এমন
মাহেন্দ্রক্ষণ বা শুভ সংযোগ ইতিহাসে কখনো ঘটেছে কি না সে তথ্য-তালাশ করতে
গেলে তন্নিষ্ঠ গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের বাঙালি জীবন ও ইতিহাসের কী এক
অলোকসামান্য বছর ২০২১। এই বছরেই বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, এই বছরই
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত।
আমরা যারা ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর ৭ই
মার্চের ইতিহাসে অনন্য উদ্দীপক ভাষণ শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির
বীরবিক্রম দেখেছি, বাংলাদেশকে বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবজা থেকে
মুক্ত করার লক্ষ্যে লড়াই করতে করতে অকাতরে প্রাণ দিতে দেখেছি—সেই আমাদের কী
সৌভাগ্য! আমরা বাংলা ও বাঙালির তিন ঐতিহাসিক ঘটনা ও অনন্য সাফল্যের বর্ণিল
উৎসবের অংশীদার হতে পারলাম।
প্রথমেই বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক হাজার
বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে তাঁর জন্মশতবর্ষে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানাই। এই
ছোট লেখায় তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও রাষ্ট্র নায়কোচিত প্রজ্ঞার ওপর আলোকপাত
করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর মূল সাফল্যের কটি দিকে আলোকপাত করব।
পূর্ব
বাংলার বাঙালি কত শত শত বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, অসংখ্য আঞ্চলিক
কৃষক বিদ্রোহ করেছে। টিপু পাগলা ‘ঈশান ও নিশান’কে এক করে শেরপুর-জামালপুরকে
দিনদুয়েকের জন্য মুক্ত করে রাখতে পেরেছে। কিন্তু সে বিজয় ধরে রাখতে
পারেনি। তেমনি একই লক্ষ্য নিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেছিলেন। সে প্রয়াস ছিল
ক্ষুদ্র-জনবিচ্ছিন্ন। পূর্ব বাংলায় এমনি উপনিবেশবিরোধী শত সংগ্রামের
অগ্নিগর্ভ কিন্তু বিমুখ প্রান্তর।
শৌর্য-বীর্য ও দেশপ্রেমের চরম
পরাকাষ্ঠার পরিচায়ক হলেও ওই সব অভিযান ব্যর্থ হয়েছে বাস্তবসম্মত কারণেই।
কারণ রাজনীতি তখনো ব্যাপক জনগণের আগ্রহ বা চিন্তা-চেতনার স্তরে পৌঁছেনি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময়ে সাধারণ শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। রাজনীতি রাজা-বাদশাহ
বা ঔপনিবেশিক দখলদারদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের যাপিত ভাবনাকে স্পর্শ
করছে; কিন্তু তখনো সে রাজনীতি ভদ্রলোক নবাব, নাইট জমিদারদের নেতৃত্বে
মুসলিম লীগের হাতে কবজা। সেই জায়গায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষকদের
অধিকার সচেতন করে ১৯৩৭-এর নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দীনকে তাঁর জমিদারির
পটুয়াখালীতে হারান। সেই থেকে জনগণের রাজনীতির সূচনা। কিন্তু তাঁকে নিয়েই
ফজলুল হক মন্ত্রিসভা করায় জনগণ হতাশ হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব
বাংলায় নাজিমুদ্দীনদের মুসলিম লীগ সুঃশাসন চালায় এবং বিপদ দেখলেই ‘ইসলাম
বিপন্ন’ ধুয়া তুলে রক্ষা পাওয়ার প্রয়াস চালায়। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে মুসলিম
লীগ শাসকদের নির্দেশে গুলিবর্ষণে ছাত্র হত্যার পর পাকিস্তানি
দ্বিজাতিতত্ত্বের অপমৃত্যু ঘটে এবং বাঙালি জাতিসত্তা এবং পরিশেষে যে বাঙালি
জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে তাতে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন
আহমদের বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৌলিক একনিষ্ঠ এবং
কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। তখন তাঁর এই ভূমিকাকে কখনো
লক্ষ্যচ্যুত হতে না দিয়ে দূরদর্শী চিন্তায় ১৯৬৬ সালে মোক্ষম ছয় দফার
মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পথরেখা নির্মাণ ও বহু
জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে পাকিস্তানি স্বৈর সামরিক ফাঁসির দড়ি থেকে
বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন তাঁর স্বাধীন স্বদেশে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ হানাদার
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে ভয়াবহ গণহত্যা। ২৬শে মার্চের প্রথম
প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে
হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে
পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করে।
নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তখন ‘তলাহীন ঝুড়ি’
বলেছিলেন কিসিঞ্জার। এমনকি কোনো কোনো আর্থ-সামাজিক বিদেশি গবেষক বলেছিলেন,
দেশটি টিকবে না। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠন,
রাষ্ট্র নির্মাণ এবং শক্তিশালী আর্থ-সামাজিকে যে দূরদর্শী অবকাঠামো নির্মাণ
করেন তা ছিল বিস্ময় করা। তাঁর আমলেই বিশ্বে এক শ্রদ্ধা-জাগানিয়া রাষ্ট্রে
পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এক অসাধারণ বিশ্বনেতা। এর স্বীকৃতি আছে
কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘আমি হিমালয়
দেখিনি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ’
বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর ইতিহাস
গৌরবোজ্জ্বল। সে ইতিহাসে সমালোচনা নেই এমন নয়—তবে সাফল্য দৃষ্টান্তস্থানীয় ও
বিশ্বনন্দিত। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা তৃতীয় বিশ্বে অর্থনৈতিক
উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে বাংলাদেশ। এবং তারই ফলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে
উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ। এই কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আর্থ-সামাজিক ও
রাজনীতি ক্ষেত্রে নতুন বিন্যাস প্রয়োজন। আর্থ-সামাজিকে নববাস্তবতা এবং এশীয়
অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিকে লক্ষ রেখে মূল রাজনৈতিক দলকে বিশ্বে
স্লোগান ও ধরতাই বুলি ত্যাগ করে থিংকট্যাংক গঠন, রাজনীতির শিক্ষাগত ও
তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ এবং স্বল্পসংখ্যক আর্ম অঙ্গসংগঠন দরকার। উন্নয়নশীল
দেশে ছাত্ররাজনীতি মূল দলের অঙ্গসংগঠন করা অনুচিত। আর বিগতকালে বিদেশি
শাসনে বিপর্যস্ত দেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এসবের মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবকের
প্রয়োজন ছিল। এখন এ কাজ করে সরকারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ও এনজিও। অতএব
স্বেচ্ছাসেবকদের কোনো সংগঠনের এখন প্রয়োজন দেখি না।
শুভ মুজিববর্ষে সবাইকে অভিনন্দন।
লেখক : সভাপতি, বাংলা একাডেমি