ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
যুক্তরাষ্ট্রের দলিলে স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু
Published : Saturday, 26 March, 2022 at 12:00 AM
বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী
১৯৭১, বিশ^ ইতিহাসে নির্মম রক্তস্নাত একটি বছর। এ বছর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ছিনিয়ে আনে মাতৃভূমির স্বাধীনতা, তারা প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’, একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা। যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী সরাসরি যুদ্ধ করলেও পেছন থেকে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সর্বতো সহায়তা দিয়েছে অন্য কয়েকটি রাষ্ট্রসহ বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধনবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মিত্র রক্ষায় অপরিসীম তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা। তাদের সেসব কর্মতৎপরতার কাহিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক নথি ঋড়ৎবরমহ জবষধঃরড়হং ড়ভ ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং, ১৯৬৯–১৯৭৬, ঠড়ষঁসব ঢও-এর ঝড়ঁঃয অংরধ ঈৎরংরং, ১৯৭১ অধ্যায়ে ফুটে উঠেছে। মার্কিন সরকারি প্রিন্টিং প্রেস কর্তৃক ২০০৫ সালে আংশিক অবমুক্তকৃত ৯২৯ পৃষ্ঠার এই অধ্যায়জুড়ে রয়েছে মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের নৈমিত্তিক সভা, কথোপকথন, আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণের বর্ণনা ও তথ্যাদি। তাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার সংকট উতরে উঠে ঘটনাবলি তাদের পক্ষে নেওয়ার সর্বময় যে চেষ্টা তারা করেছেন, সঙ্গত কারণে তা ফুটে উঠেছে। ভারত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, পাকিস্তান, চীন প্রভৃতি দেশ এবং অকুস্থল বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে মার্কিন সরকারের নীতিনির্ধাকরদের দীর্ঘ আলোচনার বর্ণনা উল্লেখিত দলিলে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, দলিল-দস্তাবেজ প্রস্তুত, রক্ষেণাবেক্ষণ এবং প্রকাশে মার্কিনিরা দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও সততা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন বিধায় এসব বর্ণনায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সরকার গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদেক্ষেপের প্রকৃত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ইতিহাস ফিরে দেখা এবং তা সবার কাছে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এক দায়বদ্ধতা রয়েছে।
ইংরেজি ৯২৯ পৃষ্ঠার একটি দলিলের বাংলা অনুবাদ করে তা প্রকাশ করা সময়সাপেক্ষ এবং তাতে অনূদিত একটি বড় আকারের পুস্তক হয়ে যাবে। তাই এই প্রবন্ধে মার্কিনিরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছে, কেবল তার ওপর আলোকপাত হলো।
এটি অবধারিত যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈশি^ক মোড়লিপনার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচার করেছে। তাদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে যে, তারা পাকিস্তানের ভাঙন চায়নি। আবার একান্তই যদি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়, তা হলে নতুন দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারেও মার্চের প্রথম থেকেই তাদের সিদ্ধান্ত ছিল। তাদের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া, না হওয়া নির্বিশেষে তারা পাকিস্তানের উভয় অংশের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। বিশেষ করে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও তা স্থায়ী করার ব্যাপারেও তারা প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। সে কারণে ’৭১-এর উত্তাল মার্চের প্রথম দিন থেকেই মার্কিনিরা সার্বক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধুর কর্মকা- এবং অবস্থান সম্পর্কে খুব উৎসুকের সঙ্গে খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করেছেন।
১৯৬৯-১৯৭৬ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক সবচেয়ে জটিল সমস্যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। তাই ৯২৯ পৃষ্ঠার ঝড়ঁঃয অংরধ ঈৎরংরং, ১৯৭১ দলিলের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এক বা একাধিকবার মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আলোচনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
মার্কিনিরা ছয় দফাকে অবিহিত করেছেন ‘জধযসধহ’ং ঝরী চড়রহঃং’ হিসেবে এবং তারা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, ’৭০-এর নির্বচানে এই ছয় দফার পক্ষেই বাঙালিরা নিরঙ্কুশ রায় প্রদান করেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ও বাঘা সব কূটনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গোয়েন্দা ও সমরনায়করা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মকা- পরিচালনার কৌশল সম্পর্কে পূর্বাভাস করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তবে তারা উল্লেখ করেছেন যে, একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার সমপর্যায়ের কিছু একটা ঘোষণা দেবেন। মার্কিনিদের আলোচনায় উঠে এসেছে যে, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে ’৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। তাই সংসদ অধিবেশন বসলে তাও তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল যে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। আর স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী কী ঘটতে পারে তারা তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।
৭ মার্চের ভাষণে আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেছেন বলে মনে হলেও তার ভাষণের পূর্ণাঙ্গ রূপ যত প্রকাশিত হয়েছিল, তা তত কঠোর এবং তাতে তার পশ্চাদপসারণ যে কেবল কৌশলগত ছিল, তা-ই মার্কিনিদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল বলে তারা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ বলে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ ঘোষণার কারণে পাকিস্তানিরা দীর্ঘমেয়াদে বাঙালিদের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হবে বলেও মার্কিন দলিলে উল্লেখ রয়েছে। আর, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা মূলত স্বাধীনতা ঘোষণারই ভিন্নরূপ ছিল। এ কারণেই পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আপস করার উদ্দেশে ইয়াহিয়া ঢাকা উড়ে এসেছিলেন বলে মার্কিনিরা উল্লেখ করেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল বিধায় পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিয়ে নিয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাও যুক্তরাষ্ট্রের দলিলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
যাহোক, ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করার বিষয়টিও মার্কিনিরা তাদের আলোচনায় আনতে ভুল করেননি। অপারেশন সার্চলাইটের কথা উল্লেখ করে সিআইএর তৎকালীন পরিচালক পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সূত্রে উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছিলেন যে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা যুক্তরাষ্ট্র সময় ২৫ মার্চ বেলা ১টার সময় বঙ্গবন্ধুকে তাদের হেফাজতে নিয়েছিল এবং তাকে গ্রেপ্তার করার সময় তার দুজন সমর্থক নিহত হয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা ঝড়ঁঃয অংরধ ঈৎরংরং, ১৯৭১ দলিলের ২৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্টত এভাবে উল্লেখ রয়েছে- ‘অ পষধহফবংঃরহব ৎধফরড় নৎড়ধফপধংঃ যধং গঁলরনঁৎ জধযসধহ ফবপষধৎরহম ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয’- যার বাংলা তর্জমা দাঁড়ায়- ‘মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে একটি গোপন রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও প্রধান রাষ্ট্রীয় দলিলত্রয়, যথা- সংবিধান, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংস্থার দলিলে হুবহু একই তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, ২৬ মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তারের আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। তার পরও ইতিহাস বিকৃত করে একশ্রেণির পথভ্রষ্ট ও ভ- রাজনৈতিক নেতাকর্মী জিয়াউর রহমানকে তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোষক বলে আখ্যায়িত করে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলে বিকৃত আনন্দ পায়। অথচ ৯২৯ পৃষ্ঠার ঝড়ঁঃয অংরধ ঈৎরংরং, ১৯৭১ দলিলে বঙ্গবন্ধুর নাম কয়েকশবার উল্লেখ থাকলেও, সেখানে কোথাও জিয়াউর রহমানের নাম একবারের জন্যও উল্লেখ নেই, স্বাধীনতার ঘোষক তো থাক দূরের কথা।
যারা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে মানে না, তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণপত্র’, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষ্য ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আইনগ্রন্থ ‘সংবিধান’- এসব কিছুর অবমাননাকারী বিধায় তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাদের বিরুদ্ধে গণহারে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলাসহ তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করা যেতে পারে।
বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী : মুক্তিযোদ্ধা ও প্রযুক্তিবিদ