জুলফিকার নিউটন ||
স্বাধীনতা
একটি বোধ, একটি প্রত্যয়, একটি বিশ্বাস এবং আনন্দের অভিব্যক্তি। স্বাধীনতা
শব্দটির ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। আমরা নিজের অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে বিচার
করবার এবং জানবার অধিকারকে কি স্বাধীনতা বলব? না স্বাধীনতাকে ইচ্ছার
প্রতিরূপ হিসাবে ধরব, যে ইচ্ছা আমাকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে সাহায্য করে
এবং আমাকে আমার অবস্থান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যায় না। আফ্রিকার একজন নিগ্রো
কবি ‘স্বাধীনতা নামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটিতে তিনি লিখেছেন:
‘স্বাধীনতার মতো মধু আর পৃথিবীতে নেই। স্বাধীনতার দিনটি এমন একটি দিন যখন
একজন মানুষ নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ায় এবং বিলম্বে কর্মে ফিরে আসার জন্যে
তিরস্কৃত হয় না, স্বাধীনতা হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন একজন মানুষ নিজের
আগ্রহের বশংবদ, স্বাধীনতা হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন মানুষ ঘুম থেকে উঠে
অন্য একজন মানুষের খামারে কাজ করতে যায়না, স্বাধীনতা হচ্ছে এমন একটি অবস্থা
যখন মানুষ নিজের কৃষি ক্ষেতে শস্য বপন করে। গাছের পাতায় সকাল বেলা যখন
শিশির জমে সে শিশির মাড়িয়ে যে মানুষটি তার কৃষি ক্ষেতে যায় এবং সন্ধ্যা
নামা পর্যন্ত নিজের ইচ্ছায় ক্ষেতে কাজ করতে থাকে সে মানুষটি হচ্ছে স্বাধীন
এবং নিজস্ব আগ্রহের অধীন। যে কবি এই গাঁথাটি রচনা করেছেন তার নাম আদে বায়ো
ফালোতি। ইনি নাইজেরিয়ার ‘য়ুরোবা’ অঞ্চলের কবি। যেহেতু তিনি কৃষ্ণ আফ্রিকার
অন্ধকারের পরিপ্রেক্ষিতকে ভুলতে পারছেননা, তাই তার কাছে স্বাধীনতার অর্থ
হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোকে বিনির্গমন, বন্ধনদশা থেকে মুক্ততায় স্থিতিলাভ এবং
হিংসা ও যন্ত্রণা থেকে এক প্রকার নিজস্বতায় আগমন। আফ্রিকার মানুষ যেভাবে
স্বাধীনতার কল্পনা করেছে, অন্যকোনো দেশের মানুষ সেভাবে স্বাধীনতার ব্যাখ্যা
দেয়নি। আফ্রিকার কবি নদী তীরের ভেজা বাতাসের কথা বলেছেন এবং চাষের জমিতে
ঘাসের গন্ধের কথা বলেছেন, তিনি বলতে চেয়েছেন যে শীতল বাতাস অনুভব করবার যে
মানসচৈতন্য তা একজন দাসের কখনো থাকে না, সে চৈতন্য থাকে একজন মুক্ত
মানুষের। কবি ঘাসের যে গন্ধের কথা বলেছেন সে গন্ধ অনুভব করতে পারে একমাত্র
সেই যে নিজের ক্ষেতের ঘাস উৎপাদন করে শস্যবীজ বপন করতে পারে। আফ্রিকার
মানুষের কাছে একটি ভূখণ্ডে নিজের স্থিতি অর্জন করাটাই হচ্ছে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা
এক ধরনের সম্পন্নতা। জীবনকে গ্রহণ করবার এবং স্পর্শ করবার এক ধরনের
অধিকার। মানুষ জন্মসূত্রেই অসহায় এবং অসম্পূর্ণ। সে শৈশব থেকে ক্রমশ বড় হয়
সম্পন্নতার অধিকার পাবার জন্য। সে তার চতুর্দিকে যে পৃথিবী দেখে তাকে
অনুকরণ করবার চেষ্টা করে। শব্দকে অনুকরণ করে সে সাড়া দিতে শেখে, শ্রুতিকে
অনুকরণ করে সে অর্থ নির্ণয় করতে শেখে এবং চলমান মানুষকে দেখে দণ্ডায়মান হতে
ও চলতে। শেখে। অনুকরণের ভিত্তি থেকেই এভাবে ক্রমশ সে বিভিন্ন ক্ষেত্রে
সম্পূর্ণতা অর্জন করে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আত্মনির্ভরশীল হয়েও মানুষ
পুরোপুরি সম্পন্ন হয় না যে পর্যন্ত না সে একটি স্বাধীনতার লীলাভূমি
আবিষ্কার করতে শেখে। এক সময় পৃথিবীতে প্রতিটি জীবের একটি আত্মকেন্দ্রিক
জীবন ছিল, মৃত্যুতেই যার ছিল পরিণতি। অর্থাৎ জীবন একটি অর্থহীনতায় পর্যবসিত
ছিল। ডারউইনের তত্ত্বকে। বিশ্বাস করে বলতে হয় প্রতিটি জীবন ছিল মৃত্যুতে
পরিণত হওয়ার অর্থহীন জীবন। ডারউইন বলেছিলেন যে, জীবনের উৎস হচ্ছে পানি।
প্রথমে পানিতে বিচরণশীল এক প্রকার কীটের আবির্ভাব ঘটলো! সেই কীট মাছের জন্য
জায়গা ছেড়ে দিল। আবার মাছ জায়গা ছেড়ে দিল তার চেয়েও বৃহত্তর প্রাণীর জন্য।
কিছু মাছ পাখি হয়ে আকাশে উভুলো, আবার বোধহীন কিছু বিশাল আকৃতির প্রাণী
ভূ-পৃষ্ঠে পদচারণ করতে লাগল। কিন্তু তারাও ক্রমশঃ হারিয়ে গেল ডারউইন এভাবে
একটি থিওরি দাঁড় করালেন যে, যে শক্তিমান, সে-ই বাঁচবার অধিকার পায়।
ডারউইনের তত্ত্বকে মেনে নিলে বলতে হয়, সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে কোনো জীবনেরই
স্বাধীনতা ছিল না। তাদের প্রত্যেকেরই ছিল মৃত্যুতে নিঃশেষিত হওয়ার অধিকার।
পৃথিবী কি এভাবে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিল? আমরা কিন্তু এটা স্বীকার করি
না।
আমরা বিশ্বাস করি, বিধাতা প্রথম মানুষকে বাঁচবার অধিকার এবং
স্বাধীনতার অধিকার দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। হযরত আদম (আ.) এবং বিবি
হাওয়া স্বর্গে ছিলেন পরাধীন এবং বন্ধনদশায় আবদ্ধ। তাঁদের উপর নিশ্চিন্তে
বিচরণ করার অধিকার ছিল না। কিন্তু তারা যখন নির্দেশ অমান্য করলেন তখন তাঁরা
স্বর্গচ্যুত হলেন। বিধাতা তাঁদের পৃথিবীতে পাঠালেন। পৃথিবীতে হলকর্ষণ করে
তারা শস্য উৎপাদন করলেন, পৃথিবীকে বাসোপযোগী করলেন এবং পৃথিবীর বক্ষে
মানুষের ধারাক্রমকে অব্যাহত রাখার জন্য সন্তান উৎপাদন করলেন। এভাবে তারা
প্রমাণ করলেন যে, জন্মের অধিকার হচ্ছে মৃত্যুর অধিকারের চেয়েও বড় এবং
জন্মের অধিকার হচ্ছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে জীবনকে প্রবহমান রাখা।
স্বাধীনতা’র একটি অর্থ আমরা তখন আবিষ্কার করলাম। হযরত আদম (আ:) প্রমাণ
করলেন যে, মানুষ তার পরিণত বুদ্ধির দ্বারা জীবনকে অধিকার করতে চায় এবং
উৎপাদনের সাহায্যে জীবনকে সম্পন্ন করতে চায়-এটাই হচ্ছে স্বাধীনতা। ডারউইনের
অর্থহীন জীবন পরিবর্তন স্বাধীনতা নয়। ডারউইন একটি মৃত্যুময় কাহিনী রচনা
করেছিলেন যেখানে নিঃশেষ হওয়াই ছিল জীবনের একমাত্র পরিণতি। ডারউইনের বিচারে
কোনো একটি অবস্থারই ইতিহাস ছিল না। অনবরত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবের যে
যাত্রা, সে যাত্রা হচ্ছে মৃত্যুর জয়যাত্রা। কিন্তু আদমের ইতিহাসে মানুষের
জয়যাত্রা হচ্ছে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবার জয়যাত্রা।
মানুষ আজন্ম
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে নিজেকে সুচিহ্নিত রাখবার চেষ্টা করছে। বাইরের
পৃথিবীর সঙ্গে আপনাকে সম্পর্কিত করা, যে ব্যবধান রয়েছে মানুষের সঙ্গে
পার্থিব উপকরণ ও বস্তুপুঞ্জের, সে ব্যবধানকে সংকীর্ণ করে আনা, যে শংকায়
মানুষ অভিভূত প্রাকৃতিক ও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে, সে শংকাকে নিঃশেষ করবার
ক্ষমতা অর্জন করা সকল শিল্পকর্মের অপরোক্ষ দায়িত্ব। প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্প
হচ্ছে অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি সহজাত কর্মকাণ্ড। পৃথিবীতে শিল্পকর্মের যে
সমস্ত আদিম নিদর্শন আমাদের কাছে এসে পৌছেছে তাতে লক্ষ্য করি, মানুষ নিজেকে
অভিব্যক্ত করতে চাচ্ছে। ব্রহ্মাণ্ডের কাছে আপনার অবস্থানের চিহ্ন রাখতে
চাচ্ছে, অথবা পৃথিবীর সম্পদ এবং বস্তুপুঞ্জের সঙ্গে আপনাকে সংযুক্ত রাখতে
চাচ্ছে! অথবা যে সব সম্পদ ও বস্তুপুঞ্জকে অধিকারে আনতে চাচ্ছে। উভয়
ক্ষেত্রেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশল, অনুশীলন ও সংগ্রাম হচ্ছে সম্ভাব্য
প্রতিক্রিয়া। মানুষ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে চায় না, সে তার স্বাক্ষর রেখে
যেতে চায়। সে বস্তু ও উপকরণের, প্রাণীর ও সম্পদের এবং দৃশ্যলোকের সাদৃশ্য
নির্মাণ করতে চায়, যে সাদৃশ্য সর্বাংশে তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রাচীন
গুহাগাত্রে টানা টানা রেখাঙ্কন আছে। আবার মানুষের হাতের সুস্পষ্ট ছাপও আছে।
আমরা জানি, ভালুক তার নখকে ধারালো করবার জন্য গাছের গায়ে অথবা দেওয়ালে
আঁচড় কাটে। অতীতের মানুষ তাদের শিল্পকর্মের সূত্রপাতে প্রাণীর আঁচড়ের
অনুকরণ করেছে অথবা নিজেদের হাতের রেখার প্রতিলিপি এঁকেছে গুহার দেওয়ালে।
উদ্দেশ্য ছিল নিজের ক্ষমতাকে আবিষ্কার করা অথবা বলা যায় আপন শ্রেষ্ঠত্ব
সম্পর্কে সচেতন হওয়া। শিল্পকর্মে তাদের হাতই শুধু সক্রিয় ছিল না, হাতের
প্রক্রিয়ায় মনোনিবেশও এসেছিল।
এভাবে মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সাধনা
করেছে। এই বেঁচে থাকবার সাধনাই স্বাধীনতার প্রধান কামনা। মাইকেল পোলোনি
বলেছেন, “অ ংবষভ-পবহঃৎব ষরভব বহফরহম রহ ফবধঃয যধং ষরঃঃষব সবধহরহম' অর্থাৎ
মৃত্যুতে অধিগত একটি আত্মকেন্দ্রিক জীবনের কোনোই অর্থ নেই। মানুষের
চিরকালের ইচ্ছা হচ্ছে অনন্ত জীবনের কামনা করা। স্বাধীনতার ইচ্ছার মধ্য দিয়ে
মানুষ অনন্ত জীবনের সূত্রপাত করে। কেননা স্বাধীনতার অর্থ এককভা
স্বাধীনতাকামী কোনো ব্যক্তির উন্নতি নয়। স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতের
মানুষের জন্য আনন্দের উপঢৌকন নির্মান। প্রাচীন গুহাগাত্রে আদিম মানুষ যখন
তার চিহ্ন এঁকেছিল। তখন তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল।
ভবিষ্যতের মানুষ যেনো জানে তাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় পৃথিবীবক্ষে আনন্দিত
জীবন নির্মাণ করতে চেয়েছিল।
দুঃখ এই, বর্তমানে আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
চিন্তা করি না। আমরা অত্যন্ত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে আত্মসর্বস্বতায় নিজেকে
নিঃশেষ করে দেই। তাই আদর্শহীন বিচ্যুতি সাহায্যে সময়কে অবসন্ন করি এবং
জীবনকে নিঃশেষ করি। এক সময় নব্য প্রস্তযুগে মানুষরা সূর্যের গতিধারা
নির্ধারণ করে জীবনকে সর্বকালের জন্য একটি গ্রহণযোগ পটভূমিতে স্থাপন করতে
চেয়েছিল। স্টোন হেনজ নামক সূর্য মন্দির নির্মাণ করে তার সময়ের স্বাক্ষর
নির্ধারণ করতে চেয়েছিল এবং জীবনে মানুষের কালাতিপাতের ধর আবিষ্কার করতে
চেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অনন্ত সময়ের ধারাক্রমের মধ্যে মানুষনে স্থাপণ
করা। এটি সত্য যে প্রতিটি মানুষ একটি জন্মের মধ্যদিয়ে যায় কিন্তু অনন্তের
পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের একটি সর্বকালীন জন্ম আছে, যার বিলয় নেই। ডারউইনের
মতবাদে মৃত্যুই একমাত্র সত্য, কিন্তু আদমের বিশ্বাসের জীবনই প্রবল।
স্বাধীনতা হচ্ছে জীবনে। অঙ্গীকার। মৃত্যুর নয়। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবসে
আমরা জীবনের কথা বলব। জীবনের মূল্য দেব এবং মানুষের জন্য বাঁচবার অধিকারকে
প্রতিষ্ঠিত করব।