হাফেজ মাও: মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহীম ক্বাদেরী ||
ইবাদত
তিন প্রকার। ০১. শারীরিক- যেমন নামাজ ও রোজা। আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক ধনী
গরিব সবার জন্য এই ইবাদতগুলি সমানভাবে ফরজ। যদি শারীরিক সুস্থতা থাকে। ০২.
শারীরিক ও আর্থিক যেমন- হজ। এই ইবাদতটির জন্য শারীরিক সুস্থতার সাথে সাথে
আর্থিক স্বচ্ছলতা ও অপরিহার্য। কোন একটি না থাকলে হজ ফরজ হবেনা। ০৩. আর্থিক
যেমন যাকাত। এটি আর্থিক স্বচ্ছলতার ভিত্তিতে ফরজ। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা
স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রোপ্য পরিমাণ সম্পদের মালিক যিনি এবং ঐ সম্পদ
যদি এক বছর যাবৎ অতিবাহিত হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ। যাকাত
আদায়কারী ব্যক্তি তার সমুদয় সম্পত্তি হিসাব করে গরিবদেরকে তাদের হক যাকাত
প্রদান করবেন।
যাকাত শব্দের অর্থ প্রধানত দুটি। ০১. পবিত্রতা। ২. বৃদ্ধি
পাওয়া। আর এর যথার্থতা পাওয়া যায় যাকাতের মধ্যে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে
ধনীদের সম্পদের পবিত্রতা অর্জন হয়। আর যাকাত আদায়কারীর সম্পদে বরকতও হয়।
এই যাকাত আদায়ের ব্যাপারে যে ভুলগুলো আমরা করে থাকি।
*লোক
দেখানো যাকাত: আমরা অনেক সময় ফটো সেশনের জন্য বাড়ির সামনে বা নিকটে কোন
খোলা জায়গায় বিশাল লাইন দাঁড় করিয়ে দেই। বুঝাতে চাই যে আমি অনেক অর্থ
বিত্তের মালিক। এই ধরনের লোক দেখানো যাকাত কবুল হবেনা।
* নির্দিষ্ট
যাকাতের কাপড়: বাজারে গরিব ঠকানোর অপকৌশল হিসাবে বিভিন্ন দোকানে সাইন বোর্ড
টাঙ্গিয়ে রাখা হয়, যেখানে লিখা থাকে ‘এখানে যাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’। এটি
একটি ধোকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি কাপড় দিতেই হয় তাহলে ঐ নিনম্নমানের
কাপড় দেওয়া যাবেনা বরং নিজের ও পরিবারের জন্য মধ্যম মানের যে কাপড় আমরা
ক্রয় করি সে কাপড়ই দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে অর্থের মাধ্যমে যাকাত
প্রদানই সর্বত্তোম ও উপকারী। মধ্যমানের একটি কাপড়ের দামে তথাকথিত ঐ
নিম্নমানের ৪টি কাপড় দান করলে সেই দান ও যাকাত ও আদায় হবে না।
*অহংকারী
যাকাত আদায়কারী: অহংকার এমন একটি জিনিস কোন ইবাদতই কবুল হয়না যদি অহংকারী
মনোভাব থাকে। আর অহংকারী ব্যক্তির পতন অনিবার্য দু’দিন আগে আর পরে। যদি
যাকাত আদায় করার সময় দানকারী ব্যক্তি গরিব অসহায়দেরকে সামান্য পরিমাণ তুচ্ছ
তাচ্ছিল্য অসদাচরণ করে যাকাত দেন, সেই যাকাতও কবুল হবেনা।
যাকাত দেওয়াও
ইবাদত আর গ্রহণ করাও ইবাদত: মনে রাখতে হবে সম্পদশালীগণ যাকাত দিবেন এটা
যেমনি ভাবে ইবাদত, গরিব অসহায়দের জন্য যাকাত গ্রহণ করাও ইবাদত। অতএব
গরিবদের তাচ্ছিল্য করা মানে ইবাদতকে তাচ্ছিল্য করা। কেনাটাকেই অবজ্ঞা করার
সুযোগ নেই।
যাকাত গরিবের হক ও অধিকার, গরিবের প্রতি অনুগ্রহ বা দয়া নায়:
যাকাত ধনীদের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার। তাদেরকে ছোট মনে করার কোন
সুযোগ নেই এবং তাদের প্রতি এটা কোন দয়াও নয়।
যাকাত প্রদানের সময়: আমরা
সাধারণত: রামাদ্বান মাসেই দান সদকা ও যাকাত আদায় করে থাকি। কিন্তু সেটা দেই
আমরা রোজার মাসের শেষ দিকে। যার কারণে যাকাতের আসল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।
যাকাত হোক আর ফেতরা হোক বা অন্য কোন দান, তা দিয়ে দিতে হবে রামাদ্বান মাসের
প্রথম দিকে। যাতে এর আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ধনী গরিব কেনাকাটা ও প্রয়োজন
মিটিয়ে সবাই একাকার হয়ে ঈদের খুশি উদযাপন করতে পারে। সবার পরনে থাকবে নতুন
জামা, ঘরে থাকবে ভাল খাবার আর মনে ঈদের আনন্দ ও খুশি।
অবৈধ উপার্জনের
যাকাত: অবৈধ উপার্জন যারা করেন, ঐ অবৈধ উপার্জন দ্বারা হাজার কোটি টাকাও
যদি যাকাত দেওয়া হয় তারপরও সেই যাকাত আদায়ও হবে না আবার কবুল হওয়ার কোন
প্রশ্নই আসেনা। বরং যদি কেউ অবৈধ উপার্জনের দান বা যাকাত ছাওয়াবের নিয়তে
করে তার ঈমানই চলে যাবে। আবার তাওবা করে ঈমান আনতে হবে।
* যাকাত কারা
পাবেন ?: যাকাত প্রদানের সাতটি খাত। কুরআনুল করিমে মহান আল্লাহ ঘোষণা
করেছেন- ১. ফকির। ২. মিসকিন। ৩. যাকাত উসুলকারী অর্থাৎ যাকাত আদায়ে নিযুক্ত
কর্মচারী। ৪. দাস-দাসী মুক্ত করার জন্য। ৫. ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার
জন্য। ৬. আল্লাহর পথে সত্যিকারের জিহাদকারীর সাহায্যে। ৭. অসহায় মুসাফিরদের
উপকারে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআনুল করিমে বর্ণিত যাকাতের ৪র্থ খাতটি
(মুআল্লাফাতি কুলুব) ইসলামের প্রাথমিক যুগে অন্য ধর্মের লোকদের মন জয় করে
ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ব্যবহার করা হত। সেই হিসাবে খাত ছিল আটটি।
পরবর্তীতে হযরত ওমর (রা:) এর খিলাফতকালে যেহেতু ইসলামের বিস্তার অর্ধ
পৃথিবী এবং বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বব্যাপি বিস্তৃত তাই এই খাতটি রহিত হয়ে
গিয়ে বর্তমান খাত-৭টি।
তবে প্রাধান্য পাবে নিকটাত্মীয়। এরপর এতিমখানা
বা অন্য কিছু। আমরা নিজের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গরিব অসহায় থাকার পরও
তথাকথিত এতিমখানা বা মাদরাসায় অনেক সময় দিয়ে দেই। সেক্ষেত্রেও যথাযথ যাকাত
আদায় করা হলোনা। আত্মীয়স্বজন গরিব থাকলে তাদেরকে দিয়ে বাকি থাকলে অন্য
স্থানে দিতে পারেন। আর আত্মীয়স্বজনদেরকে দেওয়ার বেলায় আপনার মনে মনে নিয়ত
করে রাখবেন। হয়তবা যাকাতের টাকা বললে মনে কষ্ট হতে পারে। তাই মনের নিয়তই
যথেষ্ট। যাকাত আদায় হয়ে যাবে। বরং না বললে সাওয়াবও বেশি হবে যাকাতও আদায়
হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ যথাযথভাবে আমাদেরকে যাকাত আদায় করার তৌফিক দিন।
আমিন।
লেখক: ইমাম ও খতিব, কান্দিরপাড় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কুমিল্লা