আহাম্মেদ কবীর ||
(১)
কবি জীবনের বোধকে পারঙ্গম দক্ষতায় শব্দ-সৌকর্যে আঁকতে গিয়ে সরলতা আর স্বচ্ছতায় প্রকটিত হতে হতে বলতে পারেন-
এভাবে বেলুন নিয়ে খেলো না বালিকা !
এভাবে বেলুন নিয়ে খেলো না রমনী !
প্রশ্নটাকি নারীকে করেছেন ? নিজেকে ?
কবির উত্তরের সমাপ্তি এভাবে হয়েছে- কবি যেন বলতে চাচ্ছেন-
নীরা, তুই নেই তুমি নেই তাই
বিষণ্ন বিষণ্ন সন্ধ্যা নামে
আমাদের বুড়ো পৃথিবীতে। (পৃ-১৪)
আর সেই সন্ধ্যায় বসে বসে যে কবি কবিতার বুনোজাল তৈরিতে দক্ষতা প্রয়াসের চেষ্টা চালিয়েছেন, তাঁর নাম কবি মনজুরুর রহমান (জন্ম ১৯৫৯, কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী গ্রামে।) যিনি ড. মাহবুব সাদিক দ্বারা মূল্যায়িত হয়েছেন- অনেকটা এভাবে- ‘মনজুরুর রহমানের কবিতায় বলায়িত হয়েছে তাঁরই অভিজ্ঞতার জগৎ-তাঁরই অবলোকিত সমকালীন স্বদেশ ও সমকালীন বিশ্ব। তিনি একালের এমন একজন কবি যিনি তাঁর মনন- চেতনার মোম জ্বেলে দেখে নেন স্বদেশ ও সমাজের ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা, বেদনা ও বিষণ্নতা, হতাশা ও সামূহিক অবক্ষয়; দেখে নেন সমকালীন আন্তর্জাতিক বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত। সমকালীন প্রসঙ্গের মধ্য দিয়েই তিনি শিল্পের বিভা জ্বেলে শাশ্বতকে স্পর্শ করেন।’
ঠিক তখনি আমরা বুঝে উঠতে পারি কবি কোন ঘরানার আদলে তাঁর সৃষ্টি-প্রজ্ঞাকে পরিচালিত করে চলেছেন। অবশ্য কবিকে বুঝতে হলে তার দেখার জগৎকে নানা ভাবে দেখার পাশাপাশি তার চেতনার গভীরতায় পৌঁছাতে হবে। অত্যন্ত আত্ম-কেন্দ্রীক এবং শব্দ-সচেতন অথচ সাবলিল-ধারার ছান্দসিক কবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন, দর্শন, অভিজ্ঞান কিছুটা ভিন্নতারই সুরে প্রস্ফুটিত। তবে বহুবিধ প্রক্ষেপণবাদী কবি হিসেবে তিনিও বলতে পেরেছেন- ‘আমি তার শেষ যাত্রী’। তাঁর এ বলার মধ্যেই আমরা দেখি- বলে বলে বিদায়ের অভিজ্ঞানে স্নাত জীবনের নির্লিপ্ত-জৈবিকতা, কথন, বাচন ও সূক্ষ্ম চিত্রকল্পে বিবৃত হয়েই কাব্যিক হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা তাই একাকীত্বের বেদনা-বিধূর লগ্নে এসেও তাঁরই পায়ের চিহ্নে সিক্ত হয়ে উঠে মানবীয় ‘নরম শরীর’। তাইতো কবিতাকে সংজ্ঞায় রাঙানো কবি প্রশ্ন তোলেন-
‘কবিতা সতীন নয় তুমি নও তার মিতা ?
তাহলে কবিতা কেন জ্বালায় মনের চিতা ?’
কী এক বেদনা-বিম্বিত দর্শন তাঁর চেতনায় ‘জীবনানন্দের মতো’ হয়তোবা- ‘কাশিবাবাদ’ হয়ে রূপকথা রঙে জুডাসের গল্পের মতোন গীতির দোলায় বলে ওঠে, ‘গুডবাই ধুতরা বাগান’। তিনি তাই করিডোরে দাঁড়ানো অভিজ্ঞানে ভয় না পেয়ে- ‘পূর্বাচল’ হতে জগৎ কবির চিত্তে প্রতিভাত হয়ে ‘হোসেন্দী’ পার হয়ে গেয়ে ওঠেন তাঁর প্রাজ্ঞেয় ‘এপিটাফ’-
‘সবুজ চাদরে মোড়া সাত পুরুষের জন্মভিটি
গভীর আবেগে ডাকে আমাকে কেবল।
সেই ডাকে বৃত্ত ভাঙি-
অন্তিম ঠিকানা খুঁজে ফিরে এসে স্থিত হই,
নাড়ির নোঙর পোঁতা পবিত্র মাটিতে-প্রগাঢ় প্রত্যয়ে।’
(২)
কবিতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়- বোধ ও বেদনার নানা অনুষঙ্গে, আনন্দে আর সৃষ্টিশীলতায় সেসব বিষয় যেন কবি মনজুরুর রহমানের ভালভাবেই জানা আছে। তাঁর কবিতায় দেখা যায় নানা অনুষঙ্গের সমাহার। যার বিশ্লেষণে বলা যায়- তাঁর কবিতাগুলো বহুমাত্রিক বিষয়, আঙ্গিক আর প্রকরণে ঋদ্ধ। সেজন্যই তিনি প্রাজ্ঞেয় ও শ্রদ্ধেয়। স্মৃতি-তাড়িত বিষয়ে চিত্রকে শব্দের মাধুরী মিশিয়ে তিনি যেভাবে বাঙময় করে তুলেছেন সেটা অবশ্যই অনন্য-সাধারণ। এঁকেছেন ছবিকল্প যেন বা যেমনটি ‘সবুজ টিকিট’- শীর্ষক কবিতার শৈলী-সত্তা। ট্রেন ও কবি বহুকাল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন- হয়তোবা অলৌকিক প্লাটফর্মে, কিংবা বিরতিবিহীন ভাব ও প্রজ্ঞায়। তবে পকেটের সবুজ টিকিটের কথা তাঁর স্মরণে আলপনায় স্রোতের মতো চলমান এবং জীবন্ত !
আরেকটি স্মৃতিতাড়িত কবিতা হলো- ‘ঘুমুতে যাবার আগে (পৃষ্ঠা-১০৫)’। কবিতা পড়লেই বুঝা যায় কবি ঘুমুতে চান অথবা প্রতিদিনের কাজ শেষে সবাইকেই ঘুমাতে হয়। স্মৃতি ও অনুভূতির মিশ্রণে সিক্ত এ এক অভিনব কাব্য-বোধ।
পাশাপাশি দেখা যায়-চিত্রকল্পবাদী সত্তায় তাঁর বিচরণ কিছুটা ভিন্নতার ধারা ও প্রজ্ঞায় গতিশীল। যেমন তিনি লিখেছেন-শব্দচিত্রে একরকম ভাবনার অনুষঙ্গ। আবার ভাবনাচিত্রে এবং অর্থবোধ সেটা হয়ে গেছে ভিন্নতার উল্লম্ফনবাদী। উদাহরণ হিসেবে যেমন বলা যায়- (১) পরনে নীলাভ গাঢ় বেনারসি (২) রিনিক-ঝিনিক চুড়ি (৩) পূর্ণিমা প্রহরে (৪) স্বপ্নভুক কবি (৫) ইতিহাস পুড়েছে কি তোমার হৃদয় (৬) বিষণ্ন বিষণ্ন সন্ধ্যা নামে (৭) এভাবে বেলুন নিয়ে খেলো না বালিকা (৮) শ্রাবণের মেঘে ঢাকা স্মৃতির আকাশ (৯) লোভাতুর শেয়ালেরা তবু খোঁজে রাতের আঁধার (১০) গ্রীবা ঘুরিয়ে রাজহংসীর মতো (১১) চেতনায় চিরন্তন শিখার মতোই জ্বলে (১২) শুভ্রতার পিঠে (১৩) বৈশাখী ঝড়ের মতো এ কেমন বসন্ত বিকেল ? (১৪) এই গাঢ় সান্নিধ্যের বনে
(১৫) রবীন্দ্রনাথের কল্যাণী সুর বৈশাখী কবিতা (১৬) দ্বিধার দেয়াল ভেঙ্গে এসো ঋদ্ধ হই আজ- (১৭) কবিতা অরণ্য দেখি-মধুপুর গড়ের মতো ফাঁকা (১৮) জলের মাঝেতে বাস করে জলের তৃষায় মরি (১৯) কবির উপমা তুমি অনন্ত-প্রমিত (২০) শতায়ু বৃদ্ধের মতো ঝুঁকে থাকা শহিদ মিনার, ইত্যাদি।
ইতিহাতজ্ঞাত বোধে তার চিন্তার চলমানতা অনেক বেশি গতিশীল। ‘তুমি নেই (পৃ-৪৫)’- শীর্ষক কবিতায় তিনি অতীতের মুক্তিযুদ্ধ, বাস্তবতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধার চলে যাওয়াকে নিজের অসহায়ত্ব হিসেবে দেখিয়েছেন। আরেকটি কবিতা যেমন- ‘হৃদয়ের ইতিহাস খুঁড়ে’ (পৃ-১৯) শীর্ষক শিরোনামে বলেছেন- ‘সময়ের করিডোরে বিষণ্ন দাঁড়িয়ে আছ একুশ বছর।’ তাইতো কবি বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে জনকের ফিরে আসাকে বিম্বিত করেছেন এভাবে-
‘সময় থাকেনি থেমে সময়ের হাটে,
অবশেষে নির্বাসিত নিহত নায়ক
আবার ফিরেছে দেশে হৃদয়ের ইতিহাস খুঁড়ে।’
কবি তাঁর লেখা- ‘বর্ণমালা (পৃ-৯৩)’ কবিতায় নিজেকে বয়ে চলা নদী ভেবে ভেবে লিখেছেন চলমান বাস্তবতায় বাংলা বর্ণমালা, শব্দ ও কবিতা প্রসঙ্গে-
‘ইতিহাস সৃষ্টিরও আগে
কোনো এক দ্রাবিড়ার কোল ছেড়ে পেশিবহুল পিতার প্রাণের সবুজ আর
জননীর হৃদয়ের ধানীরঙ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে-
সমুদ্রসৈকত থেকে পাহাড়ে অরণ্যে !’
‘প্রত্নসম্ভার’-শীর্ষক কবিতায় কবি ইতিহাসের বিপরীতে থাকে যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যারা শতাব্দী প্রাচীন আদি ইতিহাস মুছে দিতে চায় কবি তাদের বিপরীতে থেকে অতন্দ্র প্রহরী হতে চান। এমনকি প্রয়োজনে সেসব ‘বধ্যভূমির শকুন’-তাড়াতে কবি দ্বিধা করবেন না। অতীত ও ইতিহাস থেকে উত্থিত, একদল জুডাস, চাটুকার, ভন্ড, উচ্ছিষ্টলোভীরা ও নপুংসকরা যতই অশুভ পাঁয়তারা করুক না কেন কবি তাদের বিপরীতে দাঁড় করাতে চান রামায়ণের কুম্ভকর্ণকে- সেটাই ব্যক্ত করেছেন তাঁর ‘জুডাসের গল্প (পৃ-১১১)’-শীর্ষক কবিতায়।
(৩)
অলৌকিক অভিজ্ঞান কবির চিন্তার আরেক অভিজ্ঞান। ছোট্ট একটি কবিতা- ‘অলৌকিক ইরেজার’ (পৃ-২১) উপস্থাপিত হয়েছে কবির সরলতায় ভরা অতীতকে মুছে দেবার মাধ্যমে। পুরনো লজ্জাকে মুছে কবি যেন আগামীর। প্রত্যয় ও প্রয়াসে চলমান ভাবনাই- এ কবিতাকে ব্যঞ্জিত করেছে। পাশাপাশি কবি এই নীর গ্রহের বাসিন্দা হয়েই নিরূপদ্রবে থাকতে চান। তাঁর মতে জীবনতো একটাই। তাই কর্মব্যস্ত জীবনের বিপরীতে তিনি আজ কবিতার কথা বলতে চান (পৃ-২২)। এখানে কবিতা ও ভালোবাসা যদি চলমান থেকে তবেইনা অলৌকিক থেকে লৌকিক অভিজ্ঞান সৃষ্টি হবে।
প্রেমকে অনুষঙ্গ করে কবি জীবনের মীমাংসায় প্রেমবাদী সুরে বলে ওঠেন-
‘নীলকন্ঠের মতন যন্ত্রণায় নীল আমি আজ
তোমার ঠোঁটের স্পর্শে ফুটুক একটি ফুল
এই গাঢ় সান্নিধ্যের বলে। (পৃ-২৪)’
এ যেন কবির প্রত্যাশাই নয়-জীবন দর্শনের অন্যরকম অনুভূতি। একইভাবে- ‘আমরা ছুয়েছি (পৃ-২৫)’ শীর্ষক কবিতাতেও রাধা-শ্যামের অনুষঙ্গ টেনে জীবন নামক অলৌকিক চলমানতাকে প্রকটিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি যেন জীবনের গতিচক্রে সরলতার সৌকর্যে ‘ইচ্ছে’ (পৃ-২৯) হয়ে চলতে চেয়েছেন। যেন অনেকটাই এরকম-
‘ইচ্ছে করে নদী হই-
পাশাপাশি বয়ে যাই দীর্ঘ পথ
তারপর একদিন লীন হই সাগর-সঙ্গমে।’
নদীকেন্দ্রিক (পৃ-৪০) ভাবনা তাঁর কাব্য-হৃদয়ের নানা ক্যানভাসে প্রায়ই প্রতীয়মান। নদীকে ভালোবেসে, নদী ও নারী, প্রকৃতি, সজীবতা অথবা সরলতাকে তিনি কাব্যময় করেছেন- কথনে, বর্ণনায় আর স্বকীয় ভালোবাসায়। তিনিও- ‘নদীর মতো হারিয়ে যাবো’ বলেই ‘একলা পথে উধাও হবো পেছনে ফিরে দেখবো না।’-শীর্ষক ভাবনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নদী নিয়ে তার ভাবনাগুলোর মধ্যে জলসিঁড়ি (পৃ-৫২), তেরো বছর পর (পৃ-৫৬), কলসী কাঁখে (পৃ-৭৮), জলসিঁড়ি ভেঙ্গে পড়ে (পৃ-৯০), সার্ধশত জন্মদিনে (পৃ-১৩৩), হোসেন্দী: হে পিতৃভূমি (পৃ-১৫০) শীর্ষক কবিতাতে মূর্তমান। স্মৃতিতাড়িত হয়ে তাই তিনি বলে ওঠেন- ‘প্রবীণ ব্রহ্মপুত্রের জল ছোঁয়া সবুজ বাতাস-’ যে বাতাসের অথবা জলের স্পর্শে কবি হতে চান- ‘গভীরে প্রোথিত এক বৃক্ষমানব।’
(৪)
মানব হৃদয় ও প্রেম, কবির চিন্তা চেতনার আরেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রেমকে উপলক্ষ করে কবি যেমন- ‘সবুজ টিকিট (পৃ-১১)’ ক্রয় করেছেন; ঠিক তেমনি প্রিয় পিতৃভূমি হোসেন্দী’র স্বজনদের উদ্দেশ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতামালাকেও উৎসর্গ করেছেন। তাঁর কাছে প্রেম হলো-হৃদয়ে বেজে ওঠা নীল হুইসেল, সবুজ টিকিট, নারীর হৃদয়, সুগভীর চোখ, বিবশ বাবুল, কলের পুতুল, ষোড়শী প্রেমিকা, অনিন্দিতা, হৈমন্তী জ্যোৎস্না, গিরিতনয়া বাঁকখালি, চাঁদ বদনী, রেবেকার জন্য, কালো মেয়ে, কফি কালার কাফুলা কিংবা তোমাকে দেখিনি তাই... ইত্যাদির সন্নিবেশ বা সমাহার, হয়তোবা।
তবে তাঁর প্রিয়তমা কিন্তু-অনিন্দিতা ! ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর কবিতা- ‘চারদিকে ঘাস দেখি (পৃ-৩০)’ শীর্ষক কবিতায়।
তিনি বেশ জোরের সাথেই তাঁর প্রিয় কবি জীবনান্দকে বলেছেন-
‘আপনার কি খুব ঈর্ষা হবে যদি বলি-
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী অনিন্দিতা-
আজ আমার প্রেয়সী!’
আরেকটি কবিতায় প্রেমের গভীরতাকে চেনার জন্য তিনি নারীর ঠোঁটের স্পর্শকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন-
‘চুম্বনের বর্ণ লাল,
তোমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে আমি-
চিনেছি লাল- রঙ ! (পৃ-৩১)’
প্রেমের ক্ষেত্রে দেশ, মৃত্তিকা আর প্রিয়তমাকে উপলক্ষ করেই তিনি তাঁর পদযাত্রা শুরু করেছেন। তাঁর এ চলার পথে তিনি প্রশ্ন করেছেন, চমৎকার নটিনীকে যার স্বভাব তটের মতো। তাঁর প্রশ্ন ছিল- ‘ইতিহাস পুড়েছে কি তোমার হৃদয় ?’
এর উত্তর কী হবে, বুঝতে হলে পাঠককে যেতে হবে কবিতার অন্তর্গত মহাসত্যে। ঘর করা আর সংসার করা এক হলেও দু’য়ের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সেটা বুঝতে হলে ভাবতে হবে, কেন ?
‘স্বপ্নভুক কবি তাঁর প্রথম পূর্ণিমা প্রহরে
সঁপেছে নিজেকে রক্তে-মাংসে-মননে-মেধায়’
প্রেম বিষয়ক ভাবনাগুলোতে কবি মনজুরুর রহমান ইঙ্গিত ও প্রতীকী ব্যঞ্জনার আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলা কবিতার ধারাক্রমে ঋদ্ধ ও শিক্ষিত কবি হিসেবে তিনি প্রেমকে প্রকাশ করেছেন- তাঁর নিজস্বতায়, প্রকরণে, শৈলী ও অভিজ্ঞানে। প্রেমে হতাশা না খুঁজে সার্থকতা-বিধৌত দৃষ্টি-দৃক্ষার নতুনত্বকে খুঁজে খুঁজে উপস্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন বলা যায়, প্রেমের প্রকাশক বর্ণ বিষয়ক’ কবিতা-সিরিজের কথা। বর্ণ বা রঙকে উপলক্ষ করে তাঁর প্রিয়তমার মানসিকতাকে বাঙময় করেছেন নানাভাবে। একটি উদাহরণ হলো-
‘তুমি হাসলে/পৃথিবী আলোকিত-/শুভ্র-সাদা চরাচর,/
মুখ ফেরালে/ সন্ধ্যা নামে/ আঁধার কালো ঘর !/’
এছাড়াও রঙের সাথে চুম্বনের অনুষঙ্গ, বনের গভীরতা, নীলকন্ঠ পাখি, বেগুনি ক্যাকটাস, আকাশের রঙ, ধানের হলুদ শোভা, কমলা আর জাফরানি রঙের সম্মিলন কিংবা আঁধার প্রকৃতি ইত্যাদি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যে অনুভূতি ভাবনা আর চিত্রকল্পে।
বিরহ-ভাবনা কবিকে নানাভাবে তাড়িত করলেও নি:শেষ করে দিতে পারে নি। কবি তাই ক্রমাগত টেনে চলেছেন জীবনের গাড়ি। আত্মবিশ্বাসে বেঁচে থাকা কবি বলে ওঠেন-‘আজ আমাদের ভালোবাসার মাসপূর্তি অনিন্দিতা !’ তাইতো কবি তাঁর- ‘আমরা ছুঁয়েছি (পৃ-২৫)’ কবিতায় বেশ জোর দিয়েই বলে ওঠেন-
‘স্বর্গ থেকে নেমে এলেম-
মাটির পৃথিবীতে !
সভ্যতার সমান বয়সি আজ থেকে-
আমাদের প্রিয় ভালোবাসা!’
প্রেমের পাশাপাশি কবি বেদনার্ত হয়েছেন বহুবার। বিরহ ব্যর্থতা আর শোকগাথার সমাহার দেখা যায় কবির অনেক কবিতায়। যেমন উল্লেখ করার মতো কবিতাগুলো হলো- তোমাকে দেখিনি তাই (পৃ-২৭), নির্বাসনে যাবো (পৃ-২৮), জলের তৃষায় মরি (পৃ-৩৯), নদীর মতো হারিয়ে যাবো (পৃ-৪০), তুমি নেই (পৃ-৪৫), নির্বাসনে (পৃ-৫১), জলসিঁড়ি (পৃ-৫২), বিপন্ন (পৃ-৫৫), কত দু:খ পেয়ে (পৃ-৬১), মায়ের আঁচল ছায়ায় (পৃ-৭৩), তোমার এ মৃত্যু (পৃ-৮৩), ক্রান্তিকাল (পৃ-৯১), ঘুমুতে যাবার আগে (পৃ-১০৪), রেবেকার জন্য শোকগাথা (পৃ-১১৫), শ্রদ্ধা: জনকের প্রতি (পৃ-১৪৯) ইত্যাদি। এই কবিতাগুলির মধ্যে ‘শ্রদ্ধা: জনকের প্রতি’ যেমন অসাধারণ ব্যথিত-সত্য, ঠিক তেমনি আরেকটি কবিতা হলো- ‘ঘুমুতে যাবার আগে’। কুমিল্লায় অবস্থানকালে লেখা এ কবিতাটি অনেক দু:খ, আনন্দ স্মৃতি আর শুদ্ধতারই প্রতিবিম্ব। কবিকে চলে যেতে হবে কুমিল্লা শহর থেকে, স্মৃতি থেকে নাকি জীবন থেকে ? বিদায়ের এই ক্ষণ-কে কবি স্মরণীয় করেছেন তাঁর শব্দে শব্দে অনুভূতির অসাধারণ ব্যঞ্জনায়। শেষ তিনটি চরণই মেলে ধরা হলো কবি ও আমাদের ভাব জগতের কাব্যিক মিশেলে-
‘ঘুমুতে যাবার আগে পাড়ি দিতে হবে-
অনন্ত-প্রমিত পথ...
ঘুমুতে যাবার আগে...’
(৫)
ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা তথা অলঙ্কার ও রস সৃষ্টিতে কবি যেন ভিন্নতারই ধারাবাহিক স্বকীয়তাপুষ্ট স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। ছন্দ যেন শুধুই মুক্তক অক্ষরবৃত্তে স্বচ্ছ ও রসাভাষে মূর্তমান। তবে মাঝে মাঝে মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্তেও কিছু কবিতা তার ছন্দ সচেতনতাকে প্রকাশ করে। রসবোধ বা রস সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবির উচ্চ শিক্ষিত মনন সব সময়েই সতর্ক ও সচেতন। বিশেষ করে নবরস নিয়ে কাব্য সৃষ্টি তার অন্যতম স্বকীয়তাকে উচ্চকিত করে তোলে। কবি তাই শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, বীর, অদ্ভুত, ভয়ানক, বীভৎস, বাৎসল্য আর শান্ত রসের সম্মিলনে সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাব্য ভুবন।
প্রথমেই শৃঙ্গার বা আদিরসের প্রসঙ্গে যদি দেখি তবে দেখবো, কবি মানব-মানবীর প্রেমকে যৌন জৈবিকতায়, কিংবা উপমায়, আড়ালে, আবডালে অথবা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেছেন পারঙ্গম নান্দনিকতায়। বিশেষ করে যে কবিতাগুলোতে শৃঙ্গার রসের ছবি ফুটে ওঠে সেগুলো হলো- (১) এভাবে বেলুন নিয়ে (২) তোমার ঠোঁটের স্পর্শে (৩) বর্ণ বিষয়ক (৪) বর্ণ বিষয়ক: আট, সাত (৫) যদি ভালো লেগে থাকে...ইত্যাদি।
উদাহরণ-১
বেলুনেরা কেঁদে কেঁদে ফেটে পড়ে মরে,
বেলুন ফাটে না- যেন ফাটে বালিকার
আসন্ন আগামী।
উদাহরণ-২
নীলকন্ঠের মতন যন্ত্রণায় নীল আমি আজ
তোমার ঠোঁটের স্পর্শে ফুটুক একটি ফুল
এই গাঢ় সান্নিধ্যের বনে।
উদাহরণ-৩
প্রথম স্পর্শে তুমি রাঙা হলে
জাফরানি-রঙ কমলার মতো !
নবরসের মধ্যে হাস্যরস কবিতাকে ভাবে ও বোধে গতিশীল করে তোলে। হয়তোবা কাব্যিক একঘেয়েমিকে দূর করার জন্য হাস্যরস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কবি মনজুরও তার কবিতায় অনেকভাবেই হাস্যরসের সমাগম ঘটিয়েছেন। বিশেষভাবে দেখা যায়-ইচ্ছে করে (পৃ-২৯), চারদিকে ঘাস দেখি (পৃ-৩০), জলসিঁড়ি ভেঙে পড়ে (পৃ-৯০), রূপকথা:এক (পৃ-১০৯), কফি কালার কাফুলা (পৃ-১১৭), তাড়াতাড়ি মশা মারি (পৃ-১৩৫) ইত্যাদি কবিতাতে। যেমন-
উদাহরণ-১
কবিতা অরণ্য দেখি- মধুপুর গড়ের মতো ফাঁকা
চারদিকে ঘাস দেখি বৃক্ষ দেখি না একটাও।
উদাহরণ-২
আজ প্রবারণা পূর্ণিমার রাত
চারিদিকে আলোর মিছিল
রুপার থালার মতো চাঁদের আলোয়
সাদা পরীদের মেলা সাগরের জলে।
উদাহরণ-৩
মার্জার ও শেয়ালেরা দীর্ঘজীবী হোক...
দু:খ বেদনা আর জীবনের পরাজয়ে মূর্তমান হয়ে ওঠে করুন রসের অনুষঙ্গটি। তাইতো কবিদের কবিতায় করুণ রস প্রকটিত হয়-এটাই অনিবার্য। এমনি করুণ রসের বাস্তবতা দৃশ্যমান কবি মনজুরের নিম্নোক্ত কবিতা সমূহে। কবিতাগুলো হলো- নির্বাসনে যাবো (পৃ-২৮), অন্তরঙ্গ শত্রু (পৃ-৪৯), বর্ণ বিষয়ক: তিন (পৃ-৩৩), নদীর মতো হারিয়ে যাবো (পৃ-৪০), কাশিয়াবাদ (পৃ-৯৯) ইত্যাদি। যেমন-
উদাহরণ-১
বন-হরিণেরা আজ ভয় করে না বন্য পশুকে
পশুর অধম যেন আমরা সবাই-
তাহাদের চোখে !
উদাহরণ-২
একদিন নির্বাসনে যাবো দুঃখ যদি দাও
মায়ের স্নেহের মতো ঢাকা
ছেড়ে যাবো অনিশ্চিত লোকালয়ে !
আমরা জানি বীররসও কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর অধিকার আদায়ের কথা বলতে কবি মনজুর বীর রসের অবতারণা করেছেন। তাঁর সেসব প্রয়াস প্রকটিত হয়- অনন্ত-প্রমিত, তুমি নেই, বীর প্রসবিনী, কস্মিনকালেও না, হৃদয়ে-মননে গাঁথা, ভাষাসংগ্রামীদের প্রতি, গীতিঃচার... ইত্যাদি কবিতাতে।
উদাহরণ-১
লাখো শহিদের দেশে কিংবদন্তি তুমি
তোমার বীরত্ব আজো তুলনা রহিত !
উদাহরণ-২
বীর প্রসবিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশ
বিজয় আনন্দে জেগেছে ঐ রক্তিম রেশ।।
কবিতায় ‘অদ্ভুত রস’ অনেক সময়ই বেশ গুরুত্ব বহন করে। আমরা যাকে বিস্ময়কর, আশ্চার্যজনক কিংবা চমৎকার বলে থাকি সেটাই অদ্ভুত রসে প্রকটিত। সেই রকম রসেরই সমাহার লক্ষ্য করা যায় কবি মনজুরের অনেক কবিতায়। তিনি যে সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করে যাওয়া ঢঙ্টি ব্যবহার করে অদ্ভুত রসকে বাঙময় করে তুলেছেন। তাঁর কয়েকটি কবিতাতে এ রস প্রকাশিত হয়ে আছে। কবিতাগুলো হলো-গিরগিটি, তুমি আছো, এ কেমন ঝড়, আমরা ছুঁয়েছি, অনন্ত আষাঢ় ধরে...ইত্যাদি।
উদাহরণ-১
বিচিত্র সম্ভারে পূর্ণ আমার টেবিল
মনিটরের পাতায় সামান্য ক্লিকে মুহূর্তে দুলে ওঠে
বাসুকির মতো অস্থির পৃথিবী।
উদাহরণ-২
তবু তুমি অতো শান্ত কেন আজ ?
অথচ আমার বসবাস নিত্য পাগল ঝড়ে !
প্রকৃত প্রস্তাবে- ‘ভয়ানক রস’ মানেই ভয়ঙ্কর বা ভয়াবহ কিছুকেই ইঙ্গিত করে। অন্যভাবে বলা যায় কাব্যের চরণে চরণে যখন ভয়ের স্থায়ী ভাবটি প্রকটিত হয়ে ওঠে তখনি কাব্যকে ভয়ানক রসের উদাহরণ ভাবা হয়। এ জাতীয় রস তাঁর অনেক কবিতাতেই মূর্তমান। তবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হলো-নির্বাসনে, এ কেমন অন্ধকার, বিপন্ন, জুডাসের গল্প...ইত্যাদি। যেমন-
উদাহরণ-১
হেমলকের পেয়ালার মতো পূর্ণ আমার হৃদয়
ফেনিল মদির শব্দে ভাঙে দরিয়া নগরে !
উদাহরণ-২
এখন আগের মতো আসে না ট্যুরিস্ট বাস;
রুপালি সৈকত ছেড়ে দূর দিগন্তের পথে-
অভয়-অরণ্য-খোঁজা ঋতুবতী পাখিরা উধাও !
পরের প্রসঙ্গ হলো- ‘বীবৎস রস !’ যে রসকে বলা হয় অতিশয় কদর্য, ঘৃণ্য, বিকৃত...ইত্যাদি।
কবিতার চরণে এ ধরনের রসের সমাগম ঘটিয়ে কবি চেষ্টা করেন মানব হৃদয়ে কোন একটা ঘটনা বিষয়বস্তু বা ভাবনা সম্পর্কে ঘৃণ্য-ভাবনার জন্ম হোক। অর্থাৎ কবি তার পাঠকের মনে কোন একটা বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে কদর্য-ভাবের উদ্রেক করে থাকেন। এ ধরনের প্রয়াসই কবি মনজুরের বেশ কিছু কবিতার চরণে চরণে লক্ষ্যণীয়। আর সেই কবিতাগুলি হলো-গিরগিটি দুঃসময়, তোমার এ মৃত্যু, হিমছড়ি, প্রত্নসম্ভার...ইত্যাদি। যেমন-
উদাহরণ-১
‘কবিতায় তীক্ষè-চোখ শকুন-সন্তান উল্লাসে মেতেছে মাঠে
শতাব্দী প্রাচীন আদি ইতিহাস বদলে দেবার-
অন্তিম আকাক্সক্ষা নিয়ে !’
উদাহরণ-২
‘প্রকৃতি বিনাশী পাপ আজ মহাআততায়ী !
আমাদের লোভে মৃত নীল হিমছড়ি-
পাহাড়ের যোনি ছেঁড়া গতস্য ফোয়ারা!’
ভরত মুনির মতে রসালোচনার অষ্টম রসটি হলো- ‘বাৎসল্য রস’। নাট্য-কাব্যে এ রসের ব্যবহারের মাধ্যমে কবি চেষ্টা করেন-সন্তানের প্রতি পিতার যে মায়া-মমতা অর্থাৎ স্নেহ-প্রীতি ইত্যাদিকে জাগ্রত করতে। কবি মনজুরও তেমনি ভাবের দোলাচালে এ ধারার রসকে তাঁর কবিতায় রসোতীর্ণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। বাৎসল্য রসের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর কতিপয় কবিতাতে। যেমন কবিতার শিরোনাম হলো- বিস্কুট-রঙ ঘুড়ি, অনন্তঃ আমরা শৈশব, কত দুঃখ পেয়ে, দোয়েলের গান শুনে, মায়ের আঁচল ছায়ায়...ইত্যাদি।
উদাহরণ-১
‘পিতা-প্রপিতামহের হোসেন্দী গ্রাম
পেছনে ফেলে কিশোর এক পা-বাড়ায় পিচঢাকা পথে,
পুরনো বন্দরের স্মৃতি যেন-
জ্বলে জোনাকির মতো হৃদয়ের বাতিঘরে।’
উদাহরণ-২
‘কখনো শৈশব আসে- ভোরবেলা রাঙা আলো শরীরে মাখায়
চারপাশে ওড়ে ফেরে স্বর্ণাভ সবুজ-
লালনের পাখির মতন।’
সংস্কৃত কাব্য-কলা বিশারদরা ভরত মুনির আটটি রসের সাথে ‘শান্ত’-রসকে যুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন কাব্যের নয়টি রসের অনুষঙ্গ। তাঁদের মতে এ রসটি কাব্যের মধ্যে একটি স্থায়ী ভাবের জন্ম দেয়। কবি মনজুরের কাব্যেও তাই ‘শান্ত-রস’ মীমাংসিত মহাসত্যে জীবনের স্থিতিকে মেলে ধরে। তাঁর যে কবিতাসমূহের চরণে এ রসের আধিক্য দেখা যায় সেগুলো হলো- জলসিঁড়ি, তেরো বছর পর, সুখঃদুই, কলাতলী, স্বপ্ন বিষয়কঃ দুই... ইত্যাদি।
উদাহরণ-১
শহরের থেকে খুব দূরে নয় ঝিলংজা নগরী
সমুদ্রের কাছাকাছি গ্রাম-ছবির মতন !
উদাহরণ-২
আমিতো চাই না মুক্তো- চাই শুধু নীল জল
যে নীল আমাকে দেবে-অটুটু কবিতা-বেমান দরিয়া !
(৬)
কবি মনজুরুর রহমানের কবিতায় আরো কিছু অনুষঙ্গ রয়েছে যা তাঁর কবিতাকে সৌকর্যসাধিত রূপমায় সাধারণের অন্তর্লোকে অসাধারণ করে তুলেছে। প্রথমে আসা যায় ‘উপমা’ প্রসঙ্গে। আমরা জানি- উপমা সৃষ্টিতে তাঁর স্বকীয়তা কিছুটা ভিন্নতারই প্রতিবিম্ব। কয়েকটি উদাহরণে সেটা প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন- (১) চুম্বনের বর্ণ লাল (২) হৃদয়ের ছবি (৩) বান আসে আসুরিক (৪) যৌবনদীপ্ত উজ্জ্বল সময় (৫) কৃষ্ণকলি মেঘে (৬) আনন্দ ভৈরবী (৭) প্রশস্ত উদ্দাম বুকে (৮) বারুদগন্ধ মাখা...ইত্যাদি।
কবিতার চরণে ‘উৎপ্রেক্ষা’- সৃষ্টিও তাঁর আরেকটি সৌকর্য-স্বকীয়তা। সাধারণত উৎপ্রেক্ষা বলতে আমরা বুঝি- কবিতার চরণে চরণে, উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা। অর্থাৎ চরণের ভাব বা বিষয়ের মধ্যে বিতর্ক, অনুমান বা আন্দাজ তৈরি করা। কবি সেইরকম অসংখ্য উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টি করেছেন। যার মধ্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হলো। যেমন- (১) দুরন্ত-কলঙ্ক আজ তাঁর নিত্যসখি- (২) গিরি তনয়া বাঁকখালি (৩) পানিই জীবন-পানিই মরণ (৪) মন-সাগরে স্মৃতির ভেলা (৫) জুডাস মীর জাফর আর- খন্দকার মোশতাক...ইত্যাদি।
কবিতার অলঙ্কার হিসেবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দালঙ্কার হলো- ‘সমাসোক্তি’। আর এই সমাসোক্তি বলতে বুঝানো হয়ে থাকে, কাব্যের যে অলঙ্কারে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের গুণ বা ধর্ম আরোপ করা হয়। যেমন- ‘আমাদের প্রেম হোক আমাদের ইতিহাস শুধু’। অর্থাৎ প্রেম ও ইতিহাস-এখানে সমাসোক্তি হিসেবে প্রকটিত হয়েছে। এরকম আরো কয়েকটি উদাহরণ হলো- (১) প্রবীণ প্রেমিক সাগর বুঝি (২) আমাকে বলো না যেতে নীলকন্ঠ সমুদ্র সৈকতে- (৩) স্বজনের পাপে দেখি প্রকৃতিও ন্যাড়া (৪) নদ ও নারীরা কথা কয়- ভালোবাসে !...ইত্যাদি।
সাধারণভাবে ‘অনুপ্রাস’ বলতে আমরা বুঝি-একই ধ্বনি বা বর্ণের পুনঃপুন প্রয়োগ। যেমন- (১) প্রহর গুণছি শুধু আমি একা-একা (এখানে ‘একা’ হলো অনুপ্রাস) (২) লোভাতুর শেয়ালেরা তবু খোঁজে রাতের আঁধার (এখানে ‘র’-হলো অনুপ্রাস।) (৩) তবু একদিন নির্বাসনে যাবো, স্বেচ্ছা-নির্বাসনে (এখানে-‘ন’) (৪) সভ্যতা-ভব্যতা তুচ্ছ মনে হয় (৫) মন-সাগরে স্মৃতির ভেলা/কাটবে সাঁতার সন্ধ্যাবেলা (বেলা ও ভেলা)...ইত্যাদি।
এবার আসা যাক ‘যমক’ প্রসঙ্গে। সংস্কৃত কাব্যকলা বিশারদরা একই শব্দের ভিন্ন অর্থে পুনরাবৃত্তিকেই যমক বলেছেন। কবি মনজুরের কবিতা থেকে উদাহরণ হলো- (১) বিষণ্ন বিষণ্ন সন্ধ্যা নামে (২) নীলকন্ঠের মতন যন্ত্রণায় নীল আমি আজ (নীল শব্দটি) (৩) চুম্বনের বর্ণ লাল,/ তোমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে আমি-/ চিনেছি লাল-রঙ। (লাল শব্দটি) (৪) সবুজে সবুজময় (৫) কবিতা সতীন নয় তুমি নও তার মিতা ?/ তাহলে কবিতা কেন জ্বালায় মনের চিতা ? (এখানে ‘কবিতা’-শব্দটি যমক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।)...ইত্যাদি।
সবশেষে, প্রসঙ্গে উঠে আসে- ‘শ্লেষ’। সাধারণ অর্থে শ্লেষ হলো-বক্রোক্তি বা ব্যাঙ্গোক্তি। যার মাধ্যমে কবিতা বা কবিতার চরণে প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপ সৃষ্টি হয়। কবি মনজুরুর রহমানের কবিতার চরণ থেকে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো-
(১) বক্রোক্তি যা কিনা বাঁকা করে বা রস দিয়ে যা বলা হয়। (ক) গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে আমায় তুমি খুঁজবে না। (খ) ধর্ষিতা পাহাড় যেন প্রকৃতিবিলীন মহাযজ্ঞে রত !
(২) ব্যাঙ্গোক্তি হলো-ব্যাঙ্গ করে বা তিরস্কার করে কিছু বলা। মনজুরের কবিতায় এ বিষয়টি অনেক ভাবেই উঠে এসেছে। উদাহরণ হলো-
‘গোক্ষুর সাপের মতো উঠছে নামছে শানিত কোদাল
তেলেভাজা পুলি যেন স্ফীত শ্রমিকের পেশি ও চোয়াল!’
(৭)
তবে কবি সম্পর্কে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কথার পিঠে কথা উঠে আসে। তারপর চলে কথার কথামালা। সেই কথার সূত্রেই বিশিষ্ট কবি ড. মাহবুব সাদিক-এর মন্তব্য তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেছেন- ‘মনজুরুর রহমানের কবিতায় অনুভূত হবে বাঙালির ঐতিহ্য ও আবেগের প্রগাঢ় রূপকল্প। বাঙালির শাশ্বত আবেগ ও সংবেদনা, প্রেম ও প্রজ্ঞা, বেদনা ও তুচ্ছতাবোধ, নিসর্গ ও নগর বক্তব্যের সামগ্রিকতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালা।’
বলা যেতে পারে- কবির সার্বিক প্রয়াস তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। জীবনকে দেখা ও দেখানোর এ প্রয়াস অনেকের মতো তাঁরাও আছে-থাকবে। আমরা যেমন এ বাংলাকে ভালোবাসি। ঠিক তেমনি কবিও ভালোবাসেন তাঁর মাটি, জনপদ আর স্বোপার্জিত বিশ্বাসকে। তাইতো তিনি জোর দিয়ে বলতে পারেন-
‘এই দ্রাবিড় বাংলা ছেড়ে আমাকে ডেকো না যেতে
এই সজল স্বদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি-
কস্মিনকালেও না!’
মনজুরুর রহমান-এর জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৫৯ কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে।বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯৬-এ বেরিয়েছে সম্পাদিত গ্রন্থ ‘বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান’ ও ১৯৯৭-এ জীবনীগ্রন্থ ‘মোহাম্মদ মতিওর রহমান’। ১৯৯৯-এ অনন্যা বের করেছে কাব্যগ্রন্থ ‘এই নীল গ্রহে’ এবং আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বৈশাখী মেলা ও অন্যান্য’। ২০০১-এ দিব্যপ্রকাশ থেকে বের হয় কাব্যগ্রন্থ ‘জলসিড়ি ভেঙ্গে পড়ে’। ২০১০-এ কলকাতার সাংস্কৃতিক খবর প্রকাশ করে কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক প্লাটফর্মে রোদ ও বৃষ্টিতে ভিজে’ এবং ধ্রুবপদ প্রকাশ করেছে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ও বাংলাদেশের কপিরাইট আইন’। ২০০৪-এ সম্পাদনা করেন রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ এবং ২০০৫-এ ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি’।২০০৭-২০০৯ এর জুন পর্যন্ত কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৮ সালে কিশোরগঞ্জ ছড়া উৎসব পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক সুকুমার রায় সাহিত্য পদক-এ ভূষিত হন। ২০১১ সালে ‘কবিতালাপ’ পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে অর্জন করেন ‘ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ও সম্মাননা’। উল্লেখ্য, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিন উপস্থাপনা, আবৃত্তি ও সংবাদ পাঠের সঙ্গে যুক্ত।