‘নদী রক্ষার ভালো আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই’
Published : Monday, 25 April, 2022 at 12:00 AM
দেশের নদীগুলোকে দখল থেকে রক্ষায় অনেক জোরালো আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
রোববার ঢাকায় এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমাদের পার্লামেন্ট যে কয়টা আইন করেছে, সেই আইন কয়টা কিন্তু ভালো। এই আইনগুলো আমরা প্রয়োগ করতে পারি নাই।
“এই প্রয়োগ আমাদের করা দরকার। প্রয়োগ সংস্থা আমাদের যেগুলো আছে, তাদের এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে। তারা যদি প্রয়োগ না করেন, তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে।”
২০১৩ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনে এই জবাবদিহিতার কোনো ধারা না থাকলেও অন্যান্য আইনে নদী দখল ফৌজদারি অপরাধ হিসাবেই গণ্য করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি যদি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে আমার বাড়ির পাশের একটা নদীতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি, তাহলে আমার বিরুদ্ধেও সিআরপিসিতে মামলা হতে পারে। এবং দণ্ডবিধির অনেকগুলো ধারা আছে, সেই মামলা হতে পারে। কিন্তু একটা মামলাও হবে? আমি জানি না।
“এখন আমরা অফিসার যারা মামলা করব, ইন্সপেক্টরের যদি ক্ষমতা না থাকে অমুককে ধরতে, তিনিতো অনেক উপরে পর্যাযে যাতায়াত করেন। তাহলে কী তার দ্বারা আইনের প্রয়োগ হবে? তাহলে পার্লামেন্ট এত কষ্ট করে এত টাকা খরচ করে; তার কী উপকার হল?”
আইনে নদী কমিশনকে ‘স্বাধীন ও কার্যকরী’ করার কথা থাকলেও সেটা ‘অধিনস্ত’ হিসাবেই কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন মুজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, “স্বাধীন মানে কি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে লেফট-রাইট করবেন? বাজেটতো রাষ্ট্রের, সরকারেরও নয়। মানুষের অর্থ, সবার অর্থ দিয়ে এটা করা।
“জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সরকার অবিলম্বে স্বাধীন ও কার্যকরী করবে। তাহলে আপনারা অধীনস্ত রাখতে চান কেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়? এর মানে কি? যদি স্বাধীন হয়ে যায়, জনগণ কথা বলবে, আপনার বিরুদ্ধে কথা বলবে, তখন উনাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন হবে, যদি উনারা নদী দখল করেন।”
নিজের দায়িত্বের সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মুজিবুর রহমান বলেন, “আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন, এবং একেবারে ক্লিয়ারকাট নির্দেশনা, আমাদের রিপোর্টগুলোতে সেটা আছে, ২০১৮-১৯ এর সালের শুরুর দিকের।
“তিনি যেগুলো বলেছেন, উন্নয়ন যিনি যেভাবে করুন না কেন, উন্নয়নের নামে কোনো নদীকে দখল করা যাবে না। পরিবেশকে দূষিত করা যাবে না। সেটা কতদূর কী হল? জানি না।”
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক বিশেষ এ আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সাবেক এই আমলা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলন ও জাতীয় নদী জোট যৌথভাবে ওই আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
বাপা সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, “ঢাকায় নদীর সার্ভে হয়েছে শীতকালে এবং সমস্ত নদীর তলদেশে পিলার বসানো হয়েছে, পাইলিং করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। আদালতের রায়কে কত ন্যক্কারজনকভাবে অবমাননা। আদালত তার রায়ে বলেছে, নদীর সীমানা প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে, তারপর তার ভেতরে যে দখলদাররা আছে, তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে, তারপর সে জায়গা যাতে পুনর্দখল না হয়, সেজন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে।
“আপনি সীমানা পিলারই করলেন ভুল, সমস্ত দখলদারকে বৈধতা দিয়ে ঢাকার আশেপাশে হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পত্তিকে দখলদারদের জন্য বৈধতা দিয়ে দিলেন।”
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার যৌথ নদী কমিশন ‘কার্যকর নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্সে আছে, তারা প্রতি বছর দুবার বসবেন। খবর নিয়ে দেখেন, তারা দুই বছরেও একবার বসতে পারে না। বসলেও কোনো ইনফরমেশন থাকে না। কাজেই এটা পাঁচ দেশ মিলে বসতে হবে।”
নদী রক্ষার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার উপর গুরুত্ব দিয়ে শরীফ জামিল বলেন, “নদী যারা ধ্বংস করেছে বা ধ্বংস করছে, তাদেরকে যদি আপনি শাস্তি দিতে না পারেন, একটাও যদি আপনার উদাহরণ না থাকে, তাহলে আপনি কীভাবে নদী রক্ষা করবেন? পৃথিবীর যে জায়গায় আইন একেবারেই বাস্তবায়ন হয় না, সেটা আপনি কীভাবে আশা করবেন?
“আমরা কি দেখেছি? নদী দখলদারের একটাও শাস্তি হয়েছে? আমরা কি কেউ দেখেছি? সরকারি কোনো কর্মকর্তা তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব না পালন করার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমরা কি দেখেছি যে একজন দূষণকারীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?”
উল্টো সরকারের পরিকল্পনার মধ্যেই ‘নদী ধ্বংসের পরিকল্পনা’ রয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এটা কেন হচ্ছে? কারণ পরিকল্পনা প্রণয়নটাই সঠিকভাবে হচ্ছে না। প্রণয়ন করার আগে পরামর্শ করবেন, পরিবেশগত ছাড়পত্র নেবেন, তারপর প্রজেক্ট করবেন। কিন্তু প্রজেক্ট বাস্তবায়ন ৬০ ভাগ হয়ে গেলেও ছাড়পত্র থাকে না।”
নদী দখলের পেছনে একটি চক্র কাজ করে মন্তব্য করে শরীফ জামিল বলেন, “আপনি যদি এক টুকরা মাটি ফেলেন, কালকে আপনাকে ধরতে এসিল্যান্ড অফিস থেকে লোক আসবে। কিন্তু নদীর জায়গায় ১০-১২ তলা ভবন করেছে তারা নাগালের বাইরে। কাজেই এটা একটা নেক্সাস, এই নেক্সাসটাকে দূর করতে হলে যে আইন আছে, সেই আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন।”
জাতীয় নদী জোটের আহ্বান শারমীন মুরশিদ বলেন, “নদী রক্ষার চ্যালেঞ্জটা বেশ জটিল। কারণ জরিপেই আছে ৮০ শতাংশের ঊর্ধ্বে নদীগুলো ধ্বংস করছে রাষ্ট্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানে দায়টা রাষ্ট্রের উপর অনেকাংশে দিতে চাই।
“কারণ যে আইনগুলো তারা তৈরি করেছেন, এটা রক্ষার জন্য, সেগুলো তারা ভঙ্গ করছেন সরকারের বিশেষ জায়গায় অবস্থায় নিয়ে। কাজেই বিষয়টা বেশ জটিল। আমাকে প্রতিবাদ করতে হয়, রুখতে হয়, তাহলে একটা বড় অংশকে রুখতে হবে, আমিতো একটি ছোট মানুষ।”
তিনি বলেন, আইনকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। আইনের বাস্তবায়ন করতে পারলে, সেটা প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে পারে।
“কৌশলগতভাবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপরে কঠোর নজর রাখতে হবে। কারণ, আমি বাস্তবায়ন করতে পারব না। কিন্তু নদী রক্ষা কমিশনের দায়িত্ব এই আইনটা বাস্তবায়ন করা। আমরা কঠোর নজরদারি করব এবং তাদেরকে চাপের মুখে রাখব।”
বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাপার নদী ও জলাশয় বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব হালিম দাদ খান।