পূর্বে প্রকাশের পর
১৯
যখন বৃষ্টি নামে তখন বিস্ময়কর একটি সিক্ততায় ভূপৃষ্ঠ স্নিগ্ধ হয় এবং দৃষ্টিতে সবকিছু নয়নাভিরাম মনে হয়। বিস্ময়কর স্বচ্ছতায় মেঘলোক থেকে বৃষ্টিবিন্দু পৃথিবীতে পতিত হয়; কখনো ঘাসের উপরে পড়ে, কখনো বা বনাঞ্চলে কখনো স্রোতবাহী নদীতে, কখনো কিশলয়ের সবুজে এবং কখনো গৃহাঞ্চলে। সর্বত্রই মহিমান্বিত প্রতাপ নিয়ে বৃষ্টি পতিত হয়। এ কারণেই রসুলে খোদা বলেছেন, বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর প্রসাদ এবং কৃপা। বৃষ্টিকে স্বাগত করো, অভিসম্পাৎ দিও না।
ছোট বয়সে গ্রামে থাকতে বৃষ্টি অনুভব করবার জন্য বৃষ্টিতে ভিজতাম এবং পুকুরের পাড়ে এসে পুকুরের বুকে বৃষ্টিবিন্দুর খেলা দেখতাম। শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুরের বক্ষ্যদেশ বৃষ্টিপতনের ফলে কল্লোলিত এবং স্ফীতকায় হত। আমি তখন আমার দৃষ্টিতে অলৌকিকের সন্ধান করতাম। সে যে কি বিস্ময়কর অনুভূতি তা ভাষায় বুঝিয়ে বলা যায় না। পুকুর এমনিতে শান্ত থাকে। কখনো বাতাসের তাড়ায় ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। পাড় থেকে ছেলেমেয়েরা ইটের টুকরো ছুঁড়ে দিলে টুক করে শব্দ হয়। এর মধ্যে যখন বৃষ্টি নামে তখন সমস্ত পুকুরে সাড়া পড়ে যায়। পুকুর যেন খুশীতে উচ্ছলিত হয়ে কথা বলতে থাকে। ঠিক এভাবেই ধানক্ষেতের উপর বৃষ্টি নামে তখনও অপরূপ দৃশ্য জেগে ওঠে। প্রবল বৃষ্টিপতনের ফলে ধান গাছগুলো নুয়ে পড়ে। আবার মাথা তুলবার চেষ্টা করে, আবার নুয়ে পড়ে। হিল্লোলিত সবুজের অভিবাদনে সে যেন বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানায়। সবুজ ফড়িংগুলো লাফাতে থাকে এবং কয়েকটি কাক ভিজতে ভিজতে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। শৈশবে নদী যেমন দেখেছি-বৃষ্টিও তেমনি দেখেছি। কিন্তু শৈশবে নদীর মাতকতাই ছিল আমার অবলম্বন। বৃষ্টি তখন আমার জীবনকে ততটা পীড়া দেয় নি। কিন্তু শহরে এসে স্কুল জীবন শেষ হল যখন সে সময় যৌবন উন্মেষের কেমন এক প্রকার উদ্বেগে বৃষ্টিকে নতুন করে দেখলাম।
বৃষ্টিকে দেখে বৃষ্টির মধ্যে আপন শরীরকে ছেড়ে দেওয়ার যে আনন্দ সেটা বিশেষভাবে আমি অনুভব করেছি বড় হয়ে। বিশেষ একটি উন্মাদনায় যৌবনের একটি আভাস আমার মধ্যে তখন জেগেছিল। আমি বৃষ্টির সঙ্গে ঐক্য অনুভব করবার চেষ্টা করেছিলাম। বৃষ্টি প্রকৃতির যে ঐশ্বর্য নির্মাণ করে তার মধ্যে যৌবনের বিকাশ অনুভব করা যায়। বৃষ্টি দেখে আমি অজ্ঞাত এবং অনুভূত অবস্থায় কাব্য অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল বৃষ্টি হচ্ছে জীবনধর্মী, বৃষ্টির বিনাশ নেই। বৃষ্টিকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে বৃষ্টি যেন উচ্ছলিত হয়ে হেসে ওঠে। বৃষ্টি নামে প্রবল বেগে, কতদূর আকাশ থেকে জানি না, কিন্তু নামে যখন তখন সমস্ত বাধা বন্ধনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যৌবনের লীলাও হচ্ছে বৃষ্টির মতো। শৈশব এবং কৈশোরে আমরা ভেসে চলি স্রোতবাহী নদীর মতো। কিন্তু যৌবনে বৃষ্টির প্রতাপে অধীর হই এবং কম্পমান হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করি আমি কে? আমি কোথায়? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই আকুল জিজ্ঞাসায় প্রাণের একটি স্পন্দন অনুভব করা যায়।
মানুষ যৌবনকে কখন কখন কিভাবে আবিষ্কার করে, বলা কঠিন। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করে আমার মনে হচ্ছে আমি বৃষ্টির মধ্যে যৌবনকে অনুভব করেছি। অতীতের অনুভূতিগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে গিয়ে এভাবেই যৌবনকে বারবার বোঝবার চেষ্টা করেছি। বৃষ্টি হঠাৎ নামে, আবার হঠাৎ চলে যায়। সর্বক্ষণ বৃষ্টির ধারাপ্রবাহ থাকে না। নদী যেমন সতত সঞ্চরমান, বৃষ্টি তেমন নয়। বৃষ্টি যখন আসে সবকিছুকে আলোড়িত করে আসে। আবার যখন চলে যায় তখন তার ধারাপ্রবাহের চিহ্ন থাকে না। সে একই সঙ্গে অসম্ভারে নায়ক এবং বিস্ময়ের প্রাণদ প্রবাহ। যৌবনকালে মানুষের শরীর কেমন যেন আকুল হয়। কি যেন সে চায়। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে সে জানে না সে কি চায়। সে এলোমেলো হতে চায়, সে উৎক্ষিপ্ত হতে চায়। সে সবকিছুকে ভেঙ্গে ফেলতে চায় আবার কখনো প্রবল হতাশায় আক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু এটা সে অনুভব করে যে তার সমস্ত শরীর নতুন রক্তস্রোতে উষ্ণ হয়েছে এবং সকল বস্তুকে নতুন করে দেখবার সে দৃষ্টি পেয়েছে। স্কুল জীবনে যা শুধু কৌতূহল ছিল পরবর্তীতে সে কৌতুহলের গভীরে প্রবেশ করবার আগ্রহে জন্মেছিল।
বৃষ্টি দেখে রমণীর যৌবনকে অনুভব করেছিলেন চণ্ডীদাস। বৃষ্টিসিক্ত শরীরে রাধিকা যখন নীল শাড়ি পরে শরীর সঞ্চালিত করে এগিয়ে যাচ্ছে তার কি অপরূপ বর্ণনা। চণ্ডীদাস বলছেন, নীল শাড়ি বেয়ে পানি যেমন চুইয়ে পড়ে তেমনি আমার হৃদয় থেকে কামনা বিগলিত হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে যৌবনবতী রমণী শরীর দেখে যে অপূর্ব আনন্দ জাগে একটু বড় হয়ে তা অনুভব করেছি। রমণী শরীরে একটি আন্দোলন আছে, একটি তরঙ্গিত প্রসাদ আছে, যৌবনকালে তা দৃষ্টিকে প্লাবিত করে। আমি আমার গৃহের রমণীকুলকে আত্মীয় পরিচয়ে চিনতাম রমণী পরিচয়ে নয়। কিন্তু অপরিচিতা যুবতী রমণীকে দৃষ্টির মধ্যে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিল এখানেই আমার আকাক্ষিত ঐশ্বর্য। যৌবনের ঔদার্য নিয়ে একটি শরীরী চৈতন্য এগিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক জানি না।
কিন্তু মনে হত একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে আমি সম্পূর্ণ হবো না। প্লেটো তার একটি সংলাপে বলছেন, পুরুষ এবং রমণী এক সময় এক সত্তা ছিল, পরে দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং বিভক্তির পর অনবরত আকুলতা এবং আর্তি নিয়ে একে অন্যকে পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। প্লেটো অবশ্য কথাগুলো পরিহাস করে বলেছিলেন। কিন্তু বিধাতার সৃষ্টিরহস্যের গল্পও তো এমনি! তিনি প্রথম আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। পরে আদমের পাঁজরের একটি হাড় নিয়ে ইভ বা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। আদম তাঁর অস্থিখণ্ডের দাবীদার, তাই সে অনন্তকাল ধরে প্রত্যাশায় হাওয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে থাকে এবং শিহরণের সাগ্রহে হাওয়া আদমের দিকে কৌতূহলে এগিয়ে আসে। পল এন্যুয়ার রমণীকে ‘বরাট চলিষ্ণু হাহাকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রমণীর চলিষ্ণু শরীর পুরুষের চিত্তে হাহাকার তোলে, আর্তরোল তোলে, কামনার নতুন কম্পমানতা তোলে। যুবতী রমণীর কেশগুচ্ছ থেকে পদাঙ্গুলি পর্যন্ত একটি কম্পমান শিহরণের মতো একজন পুরুষ তার যৌবনকে আবিষ্কার করে, সে একাকী সম্পূর্ণ নয় তার অনুভূতিও নিঃসঙ্গ নয়। একটি আসঙ্গের কল্পনা নির্মাণ করে সে তার যৌবনকে অনুভব করে।
যৌবনে ফুলকে আমরা নতুন দৃষ্টিতে দেখি। আমাদের বাড়িতে গোলাপ ফুলের গাছ ছিল অনেকগুলো। হঠাৎ একদিনে লাল গোলাপগুলো আমাকে চমকিত করলো। তখন সূর্য ডুবছে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়েছে, লাল কৃষ্ণচূড়ায় পথে পথে শোভা নেমেছে। ঠিক সেই সময় বাতাসের দোলায় গোলাপের সবুজ ডালে লাল গোলাপ ফুলগুলো আমাকে আকুল করেছিল। আমি অনেকক্ষণ গোলাপের গাছগুলোর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। স্নায়ুতে যে রক্ত প্রবাহিত হয় তার রক্তিমাভা অনুভব করা যায়। গোলাপ ফুল দেখে সেদিন আমার স্নায়ু চঞ্চল হয়েছিল। আমি বিপুল অধীরতায় একটা কিছুকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে একটা কিছু যে কি, তা তখন জানতে পারি নি। গ্রীক দেবতা এপোলো কবিতা এবং ঔষধের দেবতা। মানুষের জীবনে ঔষধের প্রয়োজন আছে। কামনার নিপীড়ন মানুষকে ঔষধের জন্য আকুল করে। এপোলো সে ঔষধ এনে দেন কবিতার ব্যঞ্জনায়। তাই বোধ হয় যৌবনের উন্মেষ মানুষকে প্রথম কবি করে।
বৃষ্টির অবিরল ধারা দেখে মনে হত, এর শেষ নেই, আরম্ভও নেই। একটি অনাদি অশান্ত ধারাপ্রবাহ সমগ্র জীবনকে সিক্ত করছে। যৌবন উন্মেষের লগ্নে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করতো। ইচ্ছে হত সর্ব আবরণমুক্ত হয়ে নিজেকে বৃষ্টির সঙ্গে মিশিয়ে দেই। মধ্যযুগের কবিরা বলেন যে চাতকের মতো প্রেমিক হতে হয়, প্রত্যাশী হতে হয়। চাতক বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করে এবং সে পানি পান করে যৌবনময় হয়। চতুর্দিকে অথই পানি থাকলেও চাতক সে পানিতে ওষ্ঠ স্পর্শ করবে না, সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে একবিন্দু বৃষ্টির নির্যাসের জন্য। মধ্যযুগের কবিরা আরো বলেছেন, বর্ষাকাল যখন আসে, বৃষ্টি যখন শব্দ করে নামে, তখন কল্যাণী রমণী প্রিয় প্রত্যাশায় হস্ত প্রসারণ করে, কিন্তু কোথাও কাউকে না পেয়ে বিপুল হাহাকারে আর্তনাদ করে। বর্ষার বিরহবেদনা অসহনীয়। কেননা, বর্ষা আগমনের সংকেত দেয়, প্রত্যাশার অভিপ্রায় চিত্তে জাগায়। সে মুহূর্তে প্রত্যাশার পাত্রকে না পেয়ে হৃদয় অস্থির হয়। আমি এতটা বুঝতাম, কিন্তু এটা বুঝতাম যে বৃষ্টির প্রবাহ আমার জন্য নতুন জীবনের কথা বলছে।
চলবে..