ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ
Published : Tuesday, 14 June, 2022 at 12:00 AM
‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||

কাজী নজরুল ইসলাম ইসলাম ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কোনো একদিন দিবাগত রাত্রে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিলেন। কাজেই ২০২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।
‘বিদ্রোহী’  কবিতাটি প্রথম ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (২১ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়, মোসলেম ভারত, ১৩২৮ কার্তিক সংখ্যায় মাঘ মাসে প্রকাশিত, প্রবাসী-মাঘ ১৩২৯, সাধনা- বৈশাখ ১৩২৯, দৈনিক বসুমতী ও ধূমকেতু প্রথম সংখ্যা, ২২ আগস্ট ১৯২২ সালে ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখিত হয়েছিল কলিকাতায় ৩/৪-সি পূর্বদিকের অর্থাৎ বাড়ির নীচেকার দক্ষিণ-পূর্বকোণের ঘরে।
কমরেড মুজফফর আহমদ লিখেছেন-
‘সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। .... ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। ... সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’ তখন অনেক পত্রিকা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে কয়েকবার পুনর্মুদ্রণ করেছেন। মুজফফর আহমেদের ভাষ্যমতে প্রায় ‘দেড় দু’লক্ষ লোক’ কবিতাটি পড়েছিলেন।
সুতরাং ২০২২ সাল হলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের শতবর্ষ। আমরা গৌরব-অহংকারে এবছর শতবর্ষী ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রকাশকে উপলক্ষ করে নানা মাত্রায় উদযাপন করব। এই ধারাবাহিকতায় সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয়ভাবে জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান কুমিল্লায় উদযাপনের আয়োজন করেছেন। এজন্য কুমিল্লাবাসী আবেগে আপ্লুত, উচ্ছ্বসিত ও সদাশয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে।
কারণ, গবেষকগণ মনে করেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল এই কুমিল্লা থেকে এবং তৎকালীন কুমিল্লাবাসীর প্রচ্ছন্ন প্রেরণায়।
কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় প্রথমবার আসেন ১৯২১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি। তিনি সে সময় কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে প্রায় তিনমাসের কম সময় অবস্থান করেছিলেন। তন্মধ্যে দৌলতপুরে দু’মাস ছিলেন। কবিকে নিয়ে এসেছিলেন দৌলতপুর নিবাসী আলী আকবর খান। তিনি নিয়ে এসেছিলেন বলেই আমরা কুমিল্লায় নজরুল ইসলামকে এত ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছি। এ প্রসঙ্গ বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার আসলেন ও ডিসেম্বরের শেষে চলে যান। উল্লেখ্য, তিনি কুমিল্লা পাঁচবার এসেছেন, প্রতিবার কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় এলাকায় ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেছেন, থেকেছেন। প্রথমবার এ বাসায় আলী আকবর খানের উঠার যোগসূত্র ছিল ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের জ্যেষ্ঠ ছেলে বীরেন সেনগুপ্ত আলী আকবর খানের  জিলা স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠী ছিলেন, তখন থেকেই যাতায়াত এবং বীরেন সেনের মাতৃদেবী বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। নজরুলও প্রথম দর্শনে তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করলেন, শুধু তা-ই নয় পরবর্তীতে নানাভাবেই মা-ছেলের সম্পর্কটি হয়ে গিয়েছিল অকৃত্রিম। তাই নজরুল দ্বিতীয়বার ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় বিরজাসুন্দরী দেবীর মাতৃচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেসময়ের ঘটনা। ১৯২১ সালের ১৭ নভেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলস বোম্বাই পদার্পণ করেন। এই উপলক্ষে সমগ্র দেশে হরতাল হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক গ্রেপ্তার বরণ করেন। নজরুল তখন কুমিল্লায়। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। এ উপলক্ষে ২১ নভেম্বর কুমিল্লায় হরতাল ও প্রতিবাদ মিছিলের আহ্বান করা হয়। এই মিছিলে একটি উদ্দীপনাময় গান রচনা করার জন্য নজরুল ইসলামকে অনুরোধ জানানো হয়।
আফতাবুল ইসলাম, তিনি কুমিল্লার খিলাফত আন্দোলনের তখনকার নেতা, ‘জাগরণী গান’ প্রবন্ধে লিখেছেন-
‘মিছিলে গাওয়ার জন্য একটা গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ করার ভার পড়ল আমার উপর। অসহযোগী উকিল ঋষিকেশ বর্ধন আর কংগ্রেস অফিসের বৃদ্ধ কেরানি অখিল করকে সাথে করে হাজির হলুম বীরেন সেনের বাসায়। কাজী সাহেব থাকতেন তাঁরই বাসায়, কবি নজরুলের সাথে সেদিনই আমার প্রথম আলাপ। অনুরোধ রক্ষিত হল সঙ্গে সঙ্গেই। রচিত গানটির নাম ‘জাগরণী’।
তখন সরকারিভাবে ঘোষণা ছিল, প্রিন্স অব ওয়েলস-এর আগমন উপলক্ষে সারাদেশে প্রতি পরিবারে প্রদীপ প্রজ্জ্বোলন করতে হবে। বাড়ির গৃহের সম্মুখে কদলীবৃক্ষ রোপণ করে মঙ্গলঘট বসাতে হবে এবং উলুধ্বনি দিয়ে আগমন বার্তা ঘোষণা করতে হবে। নজরুল ইসলাম ‘জাগরণী’ গানে প্রতিবাদ স্বরূপ লিখলেন-
‘ভিক্ষা দাও। ভিক্ষা দাও।
ফিরে চাও ওগো পূরবাসী
সন্তান দ্বারে উপবাসী
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও
জাগো গো, জাগো গো
তন্দ্রা-অলস জাগো গো
জাগো রে, জাগো রে।

আরো লিখলেন-
‘কার তরে জ¦াল উৎসব দীপ,
দীপ নেবাও, দীপ নেবাও,
মঙ্গলঘট ভেঙ্গে ফেল,
সব গেল মা গো সব গেল,
অন্ধকার, অন্ধকার,
ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার,
দীপ নেবাও, দীপ নেবাও।’

‘জাগরণী’ গান রচনা করে তাতে সুর সংযোজন করে- নজরুল গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে প্রায় শতাধিক মিছিলকারী নিয়ে যখন রাজগঞ্জের পূর্বাংশে পৌঁছেন, তখন থানা থেকে পুলিশ এসে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং নজরুলসহ বীরেন সেন, আফতাবুল ইসলাম, কংগ্রেসকর্মী আশ্রাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী প্রমুখকে থানায় নিয়ে গিয়ে আটক করা হয়। কিছুক্ষণ পর তাঁদের ছেড়ে দেয়া হয়। শহরের অবস্থা তখন থমথমে। তখনই ব্যাপকভাবে নজরুল ইসলামের নামটি উচ্চারিত হতে থাকে। এ নজরুল কে? কবি তখন বিপ্লবী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তারপরই নজরুল ইসলাম ডিসেম্বরে কলিকাতায় গিয়ে লিখলেন কালজয়ী অমরকবিতা ‘বিদ্রোহী’।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার পটভূমি বহুবিধ।
১. ১৯২১ সালে পূর্ণমাত্রায় দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে।
২. ১৯২১ সালে ১৭ নভেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলস-এর আগমন উপলক্ষে সমগ্র দেশে হরতাল পালিত হয়।
৩. ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন অর্থাৎ নার্গিসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ও বিবাহ সভায় কাবিননামায় ঘরজামাই থাকার শর্ত নিয়ে বা অজানা কারণে খান পরিবারের সঙ্গে নজরুলের মতবিরোধ।
৪. প্রথম মহাযুদ্ধোত্তরকালে পৃথিবীর পরাধীন দেশ ও নিপীড়িত, অনুন্নত মানুষের মধ্যে স্বাধিকার লাভের যে তীব্র আকাক্সক্ষা জেগে উঠেছিল নজরুলও তাতে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। বললেন-
‘আজ মহাবিশে^র মহা জাগরণ, আজ মহা মাতার মহা আনন্দের দিন, আজ মহা মানবতার মহা যুগের উদ্বোধন।... ঐ শোনো শৃঙ্খলিত, নিপীড়িত বন্দীদের শৃঙ্খলের ঝনৎকার। তাহারা শৃঙ্খলমুক্ত হইবে, তাহারা কারাগৃহ ভাঙ্গিবে। ঐ শোনো ইস্রাফিলের শিঙ্গা নবসৃষ্টির উল্লাসঘন রোল।’

এই সবকিছু মিলিয়েই নজরুলের মানসিক অবস্থা এক মহাবিদ্রোহের দোলায় আন্দোলিত হচ্ছিল। কবি তখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করার আকুতিতে উন্মাদপ্রায়। এই সংগ্রাম ও বিপ্লবের আকাক্সক্ষায় আপস নেই, বিরাম নেই, ক্লান্তি নেই, ক্ষমাও নেই। এই বিদ্রোহ রাজার বিরুদ্ধে, আইনের বিরুদ্ধে, তথাকথিত নীতিবোধের বিরুদ্ধে এবং বিশ^বিধাতার বিরুদ্ধে। এককথায়-
‘বিদ্রোহী’ সর্ববন্ধনমুক্ত, ব্যক্তি মানুষের আত্মজাগরণ- এই আত্মজাগরণ ঘটলে মানুষ হয় নির্ভীক, মুক্ত ও স্বাধীন। এ বিদ্রোহ ব্যক্তির খেয়ালমাত্র নয়, এ সমষ্টির মুক্তি আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তি।’
লিখলেন-
‘আজ রক্ত-প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব নব প্রভাতী ধরিয়াছে-
        ‘পোহাল পোহাল, বিভাবরী,
        পূর্ব তোরণে শুনি বাঁশরী।’
    এ সুর নবযুগের ...
    সেই সর্বনাশা বাঁশির সুর রুশিয়া শুনিয়াছে,
    আয়ার্ল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে, আরো
    অনেকে শুনিয়াছে, এবং সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের
    হিন্দুস্থান,- জর্জরিত নিপীড়িত, শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষ।’


‘‘বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুল ইসলাম এক প্রচন্ড প্রাণ-প্রবল শক্তিধর অনন্য পুরুষ অমোঘ নিয়তির মতো, বিসুবিয়াসের বিস্ফোরণের মতো, কাল বৈশাখীর প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের মতো, জনপদপ্লাবী পার্বত্য বন্যার মতো, মহাসমুদ্রের গর্জনমুখর জলোচ্ছ্বাসের মতো তরুণ কবি নজরুল ইসলামের আকস্মিক আবির্ভাব তাক-লাগানো এক অসামান্য স্মরণীয় ঘটনা। এ প্রতিভা ক্ষণপ্রভার মতো, এর প্রভাব বজ্রবিদ্যুতের মতো, এর ধ্বনি কখনো মন্দ্র, কখনো নির্ঘোষ।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে নজরুল ইসলাম অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন এবং স্বীকৃতি লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন-
‘তিনি বাঙালীকে চমক দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন ঠিকই, এবং এও সত্য যে রবীন্দ্রনাথ যে দেশে অর্ধজীবন নিন্দা ও তাচ্ছিল্য পেয়েছেন, নজরুল প্রথম দর্শনেই পেয়েছেন বরণ-ডালা। এটি তাঁর প্রথম জয়।’
শ্যামাপদ চক্রবর্তী লিখেছেন-
‘নানাভাবের কবিতার স্রষ্টা নজরুল। তবু তিনি হয়ে রইলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ নজরুল ইসলাম অর্থাৎ যে কবিতা তাঁকে মুহূর্তেই জনপ্রিয় করে তুলেছিল। সেই ‘বিদ্রোহী’ই হয়ে রইল তাঁর চিরন্তন উপাধি।’
কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষায়-
‘কবি নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবি বলে পরিচিত। এর প্রধান কারণ তাঁর ‘বিদ্রোহী’ নামক অসাধারণ শক্তিসত্তার কবিতা।’ বললেন-
‘অনবদ্য ছন্দ আর ভাবানুগত ধবনি-মাধুর্যে-গরীয়ান বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যের একটি অতি বিশিষ্ট কবিতা।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এক প্রচন্ড আত্মসচেতন অভিব্যক্তিতে। এগারটি স্তবক, মোট ১৩৮টি পংক্তি, একবার ‘বিদ্রোহ’ শব্দটি, সাতবার ‘বিদ্রোহী’ শব্দসহযোগে ১৪৩ বার ‘আমি’ সর্বনাম ব্যবহার করেছেন কবি।
বল বীর-
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির,
বল বীর-
বল মহাবিশে^র মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি  বিশ^-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর।
বল বীর-
আমি চির উন্নত শির।

এবং কবির প্রত্যয়ী উচ্চারণ-
মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ত্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ-ভীম রণভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
আমরা জানি সৈনিকজীবন অত্যন্ত শৃঙ্খলার জীবন। ভাবাদর্শ ও কর্মাদর্শ একই সূত্রে গ্রথিত হলেই সৈনিকজীবন সার্থক হয়। প্রায় দুইবছর নজরুলের সৈনিক জীবন ছিল বহু বৈচিত্র্যে ভরা। একদিকে কবি সত্তার জাগরণ, ভাষা শিক্ষার আগ্রহ, নিঃসঙ্গ জীবনে অতীতে বিচরণ, অপরদিকে দেশ, স্বাধীনতা, জাতি হিসেবে পশ্চাৎপরতা এবং ব্যক্তিজীবনের দারিদ্র ও অবহেলা সবকিছুই একটি মানসিক অবস্থানে কবিকে উন্নীত করে তুলেছিল। তাই প্রত্যয়-প্রকাশের প্রথম এবং একমাত্র জীবননিষিক্ত বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে অমরকবিতা, কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’তে।
‘বিদ্রোহী’ -  নজরুল কবিতার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।
‘বিদ্রোহী’ - নজরুলের সমগ্র রচনার সূচিপত্রাঙ্ক।
‘বিদ্রোহী’ - নজরুলের কাব্য-চেতনার সার্থক ফসল।
‘বিদ্রোহী’ - কবিতা-মাধুর্যের সার্থক রূপায়ণ।
‘বিদ্রোহী’ - শতাব্দীর প্রতীক-বক্তব্য।
‘বিদ্রোহী’ - মানবাত্মার শাশ^ত জাগরণ।
‘বিদ্রোহী’ - কবিসত্তার সোচ্চার সাবলীল প্রকাশ।
‘বিদ্রোহী’ - নিপীড়িত মানুষের জয়গান।
‘বিদ্রোহী’ - বিপদে-সংকটে-সমস্যার পথপ্রদর্শক।
‘বিদ্রোহী’ - আবেগ-সাম্রাজ্যের স্বাধীন প্রকাশ।
‘বিদ্রোহী’ - জীবনের শাশ^ত বাণী-বিগ্রহ।
‘বিদ্রোহী’ - সর্বকালের স্বাধীন জীবন-বেদ।
‘বিদ্রোহী’ - নজরুলের কবি সাম্রাজ্যের ‘গান্ডীব’।
এইসব পরিচয়ের মূলে যে অন্তর্নিহিত ভাববৈচিত্র্যের সমন্বিত আদর্শটি বিরাজিত, তাহলো কবির আজন্ম লালিত ‘বিদ্রোহী’ সত্তা।
রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে নজরুল-কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শুনে বলেছিলেন-
‘আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ^বিখ্যাত কবি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবি প্রতিভায় জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’
১০১ বছর আগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, শতবর্ষ আগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এই কবিতাটি। আজ শতবর্ষ পরেও তার প্রাসঙ্গিকতার কোনো ঘাটতি বা কমতি নেই। যখনই মানবতা লাঞ্ছিত হয়, জাতীয় বিপর্যয় ঘটে, বিপদে-সংকটে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তখন অস্ত্রের ভাষায় প্রতিরোধের ভূমিকায় অকুতোভয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। মাভৈঃ ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়। নিকট অতীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছিল সাময়িক বিপন্ন বাঙালি জাতির প্রেরণার মনোগত শক্তি, যার প্রচন্ড প্রবাহ ছিল পাকহানাদারবাহিনীর বিপক্ষে একঘ্নীবান। দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, হাজার বছর পরও অথবা যতদিন মানবতা লাঞ্ছিত হবে, অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, ‘বিদ্রোহী’র প্রচন্ড আঘাতে তা ধুলায় মিশে যাবে।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫