
জুলফিকার নিউটন ||
আকাশে মেঘ করেছে। দূরের গ্রামগুলো কেমন যেন অন্ধকারে ছায়াচ্ছন্ন হয়েছে। বাতাস বইছে, খুব প্রবলভাবে না হলেও, একটু পরে প্রবল হবে মনে হচ্ছে। গাছের পাতা নড়ছে, শব্দ হচ্ছে। অস্পষ্টতায় পাতার রং আর সবুজ নেই, কেমন যেন ধূসর এবং কালো। কতকগুলো কুকুর দৌড়ে ছুটে গেল। ছেলেটি তখন বাড়ির পিছনের দরজা খুলে তাদের শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টি দেখে তার ভালো লাগে, নিরবধি প্রবাহিত নদীর স্রোত তার ভালো লাগে। সুযোগ পেলেই সে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ায়, আবার কখনও পুকুর পেরিয়ে ঢালু জমির নিচে দিয়ে যে নদী বয়ে চলেছে, সে নদী সে দেখতে যায়। নদীটিা দেখবার মতো। একটি করে নৌকো চলে যাচ্ছে-পূর্ব থেকে পশ্চিমে অথবা পশ্চিম থেকে পূবে। পানিতে নৌকো চলার শব্দ একটু অদ্ভুত ধরনের। নৌকো যখন চলে পানি তখন ছলছল করে ওঠে। বৈঠার টানে পানিতে আবার অন্য রকম শব্দ হয়। পিছনে মাঝি যখন দাঁড়টা ঘুরায় তখন অন্যরকম শব্দ হয়। ছেলেটি এসব শব্দ ভালোবাসে। আজকে সে বেরিযেছে পুকুরে বৃষ্টি পড়া দেখবে বলে। বৃষ্টি যখন আসে তখন একসঙ্গে সবটা আসেনা, দূর থেকে কেমন একটি বেগে ছুটে আসতে থাকে, তারপর সব জায়গায় ছেয়ে যায়। পুকুরের উপর যখন বৃষ্টি পড়ে তখন তা দেখতে খুব সুন্দর দেখায়। কিছুটা উপরে দৃষ্টি দিলে ঘােলাটে রং দেখা যায়, কিন্তু দশ/বিশ হাত উপর থেকে বৃষ্টির ধারাগুলো ঝকঝকে বিদ্যুতের মতো দেখা যায়। ধারাগুলো যখন একসঙ্গে পুকুরে পড়ে, তখন পুকুরের পানিতে যেন অজস্র বেলি ফুল ফুটে ওঠে। ছেলেটি এগুলো দেখে এবং খুশি হয়। আজও সে দেখছিল।
ছেলেটির বয়স তখন আট কি ন’ বছর। বাড়ির লোকেরা তাকে খুব শাসনে রাখতে পারে না। সে বৃষ্টি ভালোবাসে, পানি ভালোবাসে। রোজ পুকুরে সাঁতার কাটে সকাল বেলা। সহজে সে পুকুর থেকে উঠতে চায় না। পানি যখন তাকে জড়িয়ে ধরে তখন তার ভালো লাগে। নিজেকে তার মাছ বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। একদিন সে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, মাছের দেশ কোথায়? ওদের দেশে যাওয়া যায় না?” ওর মা উত্তরে বলেছিলেন, “মাছের দেশ তো নদী এবং পুকুর। আরও বড় হলে জানবে সমুদ্র বলে একটি পানির রাজত্ব আছে, সেখানে লক্ষ কোটি মাছ থাকে।” ছেলেটি সন্তুষ্ট হয়নি। ছেলেটি একটি গল্পের বইতে পড়েছিল, সমুদ্রের তলায় মাছদের রাজধানী আছে। সেখানকার বাড়িঘরগুলো মণি-মুক্তার এবং রাজপথগুলো রূপায় মোড়া ঝকঝক করছে কিন্তু দেশটি কোথায়? সে নদীর তীরে বসে মাছের গতিবিধি লক্ষ্য করত দেখতো, বড় বড় মাছ কেমন সুন্দরভাবে পানির অনেক তলায় চলে যায় কোথাও তো যায়! কিন্তু, কোথায় যায় এ প্রশ্নের উত্তর সে কখনও পায়নি, তবে সে আসে নদীর তীরে। বৃষ্টিতে আসে, এমনি সময়েও আসে। সে ভাবে, একদিন না একদিন নদীর রহস্য উদ্ঘাটিত হবে এবং সে হয়তো সুযোগ পাবে মাছের ঝকঝকে রূপালি রাজ্যে বিচরণ করবার।
গ্রামে আষাঢ় যখন আসে, তখন সত্যিই বোঝা যায় যে একটি বৃষ্টির জীবন এসেছে। শহরে এই বৃষ্টির বোধটা নেই। গ্রামে পর্যাপ্ত গাছপালা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে; এক ধরনের বিরল সবুজ রং-এ নিজেদেরকে উদ্ভাসিত করে। বিশেষ করে কলা গাছের বড় বড় পাতা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে হালকা সবুজের উজ্জ্বলতায় যেন জেগে ওঠে। কলাপাতা কখনও পানি ধরে রাখেনা। সেজন্য পানি পড়ার পর কলাপাতাগুলো চকচক করে। গ্রামের প্রকৃতি বৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে একটি নতুন পরিচয় যেন পায়। এ পরিচয়টি সে আমাদের দান করে। প্রকৃতি কখনও কৃপণ নয়, তার মধ্যে সৌন্দর্যের অজস্রতা আছে, এ সৌন্দর্য তার নিজের জন্য নয়, এ সৌন্দর্য যারা দেখতে জানে তাদের জন্য। বৃষ্টি যখন থাকে না তখন ধূলোর পৃথিবী সবুজের উপরও ধূলো বিছিয়ে দেয়। বাতাসে এ ধূলো সরে যায়। কিন্তু বৃষ্টি এসে সবকিছু ধৌত করে দেয়। একজন মানুষ যখন এই সৌন্দর্যের সহযাত্রী হয় তখন সে আনন্দের মধ্যে মুক্তি পায়। এই আনন্দের মুক্তি যে কত অসাধারণ, তা ভাষায় বুঝিয়ে বলা যাবে না। সকাল বেলা যখন অরুণ আভা জাগে, তখন সে আভা কার তা বলে দিতে হয় না। আমরা সবাই স্বাভাবিক বোধ থেকেই জানি, এ অরুণ আভা আমাদের, বৃক্ষপুঞ্জের যে শ্যামল শােভা তা আমাদের। গাছে যে ফুল ফুটে থাকে তা আমাদের। আকাশ কখনও নীল, আবার বৃষ্টির সময় ঘােলাটে, এই অনন্ত ব্যাপ্ত আকাশ আমাদের জন্য বিচিত্র বর্ণের এবং বিচিত্র শব্দের চাঁদোয়া। মহাপুরুষরা একেই বোধ হয় আনন্দ রূপ বলেছেন।
আষাঢ়ে বৃষ্টির অভিঘাতে আমরা একটি জগতজোড়া আয়োজন লক্ষ্য করি। এই আয়োজন এক ধরনের শান্তির উৎসবের আয়োজন, মানবন্যার আয়োজন। গাছপালালতাপাতা সকলেই এ আয়োজনে যোগ দেয়। আমাদের বালকটিও এ আয়োজনে যোগ দিতে চেয়েছিল। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি আসা সে দেখছিল। সে ভাবছিল, এই যে এল, এই যে এল এবং অবশেষে সত্যিই বৃষ্টি এল।
তার চোখ জুড়িয়ে গেল, প্রাণ ভরে গেল এবং বর্ণে-গন্ধে ও স্নেহে সে মিশে গেল প্রকৃতির সাথে। এ সময় সবাই থাকে ঘরের ভেতরে, কিন্তু আমাদের বালকটি সকলের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে পুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজবে বলে এবং প্রকৃতির সমগ্রতার একজন হবে বলে। এখন পরিণত বয়সে অনেক দিন আগের কথা ভেবে সে তার শৈশবে ফিরে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু শৈশবে ফিরে যাওয়া যায় না। সময় আমাদের অসহায় করে এবং আমরা পুঞ্জীভূত কর্মভারে, শৈশবের উৎকণ্ঠাকে ভুলে যাই। শৈশবের সেই নির্জনতা তো এখন একক আর নেই। তখন আষাঢ়ের বৃষ্টি একটি নির্জন সময়কে আলোড়িত করত এবং সে সময়ে একটি বালক প্রকৃতির সাথে সত্যিই এক হতে পারত। বৃষ্টির সময় সে পাখিগুলোকে দেখবার চেষ্টা করত। তখন পাখিগুলো গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে শব্দ করত। চড়ুই পাখিগুলো এমনি সময়ে এত অজস্র যে বলা যায় না। কিন্তু বৃষ্টির সময়ে তারা ঝােপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তো। শুধু মাটির তলার কেঁচোগুলো কিলবিল করে বেরিয়ে পড়তো। ছেলেটি বুদ্ধি করে শান বাঁধানো ঘাটে আসতো। সেখানে কেঁচোরা আসত না। বৃষ্টির সময় নানা সুরের সংগীত উঠত প্রকৃতিতে। এ সংগীত বুঝবার বয়স তার ছিল না। কিন্তু সে আনন্দিত হতো। আজ পরিণত বয়সে সে তাঁর স্মৃতি অনুসন্ধান করে ভাববার চেষ্টা করছে যে, সেদিনকার নানা সুরের সংগীত তার জন্যই ছিল।
বড় হয়ে সে আষাঢ়ের বর্ণনা পড়েছে অনেক কাব্যে। বর্ষার ঘনঘটার কথা পড়েছে পদাবলীতে। এখন সে আষাঢ়ে বিরহিনীর অনুভূতিটা বুঝবার চেষ্টা করে। সন্দেশরাসক’ কাব্যে কবি বলছেন যে রমণীয় তাপদাহন গ্রীষ্ম অতিক্রম করেছে, আকাশ থেকে বৃষ্টি পতিত হয়ে নদীকে এমনভাবে উপচে তুলেছে যে, নদীর জল, পথ-ঘাট প্লাবিত হচ্ছে। নিবিড় লহরীতে ঘনান্তর সংযোজনের কারণে দুস্তর হয়ে নদী কলকল শব্দে গর্জন করছে। যেভাবে রমণী প্রিয়তম সঙ্গমের পর শরীরে চন্দনের প্রলেপ লাগায়, লজ্জাবশত শরীরকে আবরিত করে, নয়ন মুদিত করে, অন্ধকারের অভিলাষ করে এবং কুসুম্ভী রঙের বস্ত্র ধারণ করে, সেভাবে পৃথিবী মেঘরূপী পতির আগমনের সময়ে বিচিত্র রূপে সজ্জিত হয়। বিদ্যুতের চকিত প্রকাশে জলভরা মেঘের ছায়ায় পৃথিবীকে লজ্জাবতী বধূর মতো মনে হয়। বক জলাশয় ছেড়ে বৃক্ষের শিখরদেশে বিরাজমান হচ্ছে, উচ্চ পর্বতশিখরে ময়ুর নৃত্য করে শব্দ করছে, আম্রশিখরে উঠে কোকিল কুহু কুহু শব্দ করছে। দশদিক থেকে বাদলের সমাগমে আকাশ আচ্ছন্ন হয়েছে। ঘাের গর্জন করে সঘন কৃষ্ণ মেঘ উল্লসিত হয়ে এসেছে। আকাশপথে চঞ্চল বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রমণী তখন আষাঢ়ের বর্ষার ঘনঘটা দেখে বলছে, নব মেঘমালা থেকে সম্পন্ন, ইন্দ্রধনু থেকে রক্তিম চতুর্দিকে ঘন বাদলে আচ্ছাদিত চন্দ্রমার কারণে এ বর্ষাকাল দুঃসহ। বাকরুদ্ধ আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বললাম : ‘আমি কোথায় আর প্রিয় তুমিই বা কোথায়? সরোবরে জল শতপত্রিকায় শােভিত হলো এবং নদীর প্রবাহ শােভিত হলো বিবিধ তরঙ্গে।
বৃষ্টিধারায় চিত্তের যে ব্যাকুলতা তা একটি উচ্ছলতার মতো। বর্ষার প্রবল প্লাবনে মনে হয়, এমন একজন আছেন যিনি সর্বব্যাপী, যিনি নিখিল ভুবনে আছেন, যিনি বনস্পতিতে আছেন, যিনি আমাদের চৈতন্যের মধ্যে আছেন, তিনিই আমাদের মধ্যে বর্ষার আনন্দ জাগিয়ে দেন। এটা যেমন ভক্তির কথা, তেমনি উপলব্ধির কথা। পরিণত বয়সে মনে হয় বিশ্বব্যাপী চৈতন্যের মধ্যে নিজেকে সেদিন হারিয়ে ফেলেছিলাম। বৃষ্টিধারায়। সিক্ত হয়ে সেদিনের বালক উদ্ভিদের বন্ধু হয়েছিল, আজ কর্মের পৃথিবীতে তার স্মৃতির বোঝা অনেক। বহু প্রহরের বহু কর্মসাধনা তাকে এখন একটি সময়ের প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু যখন সে ভাবে তার শৈশবের সময়কালের কথা, তখন সে নতুন সময়ে। উজ্জীবিত হতে চায়। আবার সে শৈশবে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু তা কোনোদিন ফিরে আসবে না। তখন শৈশবে বিঘ্ন ছিল না। অথবা বলা যায় বিঘ্নের কোনো বোধ ছিল না। বালকটি তখন জানত না কোনটি ক্ষয় হবে এবং কোনটি লয় পাবে। সে প্রকৃতির আয়োজনের মধ্যে পরিপূর্ণ আনন্দ খুঁজে পেয়েছিল। সে পরিপূর্ণ আনন্দ এখন আর নেই, কিন্তু না থাকলেও শৈশবের স্মৃতির সম্ভার আছে যা কখনও কখনও তাকে অন্যমনা করে এবং সেদিনের প্রহরকে ফুলের মতো দু'হাতের মুঠোয় ভরে নিতে চায়। জ্ঞানের বোঝা মানুষকে আবেগ থেকে সরিয়ে আনে; যুক্তির নিয়ম মানুষকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনয়ন করে, কিন্তু এখনও কখন কখনও বৃষ্টির শব্দ শুনলে পুরাতন প্রহরগুলো নদীর তরঙ্গের মতো দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা একটি অক্ষয় আনন্দের অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা সবুজের পত্রচ্ছায়ায় নদীর স্রোতের কলগুঞ্জনের এবং পাখির কাকলির সাথে মিশেছিল বৃষ্টির বরাভয় এবং শীতল স্পর্শ।
ভারতীয় সাহিত্যে মধ্যযুগের কবিরা বারমাস’ বর্ণনা করেছেন এবং এ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিরহিনীর ওপর প্রতিটি ঋতুর প্রভাব পড়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন। মালিক মোহাম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবত' কাব্য বারামাসা’র প্রারম্ভিক মাস হচ্ছে আষাঢ়। কবি বলেছেন : ‘আষাঢ় মাসে বাদলের গর্জন আরম্ভ হলো। এ মাসে বিরহের দুঃখ অধিক অনুভূত হলো। ধূসর এবং শ্বেত রং বাতাসের রং-এ ছেয়ে গেল। চতুর্দিকে শ্বেত বক কেমন এক ধরনের পংক্তি নির্মাণ করে উড়ে যেতে লাগল, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, যেন আকস্মিকভাবে উন্মুক্ত তরবারী। প্রতীত হচ্ছিল যে বর্ষা হবে এবং চতুর্দিক পানি ছড়িয়ে যাবে। এই বাতাবরণের মধ্যে নাগমতির চিত্তে পতি বিরহ জাগছিল। সে ভাবছিল, বর্ষার এই মৌসুমে পতি-অভাবে কে তাকে আনন্দ দেবে। চতুর্দিকে বাদলের ঘনঘটাকে মনে হচ্ছিল যেন কামদেবের সৈন্যদল। সে তাই তার প্রিয়কে যাচঞনা করছিল যেন সে এসে তাকে রক্ষা করে। কোয়েল ও পাপিয়া পাখিরা শব্দ করছিল এবং নাগমতির হৃদয় কম্পিত হচ্ছিল। আজকের দিনে সেই স্ত্রী সৌভাগ্যশালিনী যার পতি তার সমীপে আছে। আমার পতি তো আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। এ কারণে আমার সকল সুখ নষ্ট হয়ে গেছে।
কবি কালীদাস আষাঢ়ের প্রথম দিবসকে বিরহিনীর দিবস বলেছেন। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে চতুর্দিক যখন ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসে তখন মেঘমালার সন্নিবেশ বিরহিনীর চিত্তকে আকুল করে। বাতাসের শব্দ, মেঘের গর্জন এবং অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন প্রকৃতি চিত্তে বিরহের ভাব জাগিয়ে তোলে। সে মুহূর্তে মনে হয় কোথাও কেউ নেই। এক নিঃসঙ্গ পরিবেশে বিরহে আতুরা রমণীর দুঃখ জাগছে। সংস্কৃত কাব্যে এবং তাকে অনুসরণ করে হিন্দি অবধি কাব্যে আষাঢ় মাসের প্রভূত বর্ণনা আছে। হিন্দি অবধি কাব্যকে অনুসরণ করে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে বারমাসা তৈরি হয়েছে এবং সেখানে আষাঢ়ের বর্ণনা আছে। কবি আলাওল তার ‘পদ্মাবতী' কাব্যে মূল কাব্যের অনুসরণ করে, ষট ঋতুর বর্ণনা করেছেন। এসব বর্ণনা কোনো প্রকার বাস্তববোত্মে সাথে যুক্ত নয়, এগুলো সবই কাব্যিক রীতি-প্রকরণের সাথে যুক্ত। দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করতে হলে বিয়োগ ব্যথার কথাও বলতে হবে এবং সে বিয়োগ ব্যথা একেক ঋতুতে একেক রকম ভাবের প্রকাশ পাবে। এদিক থেকে হিন্দি অবধিতে বারামাসা বা ঋতু বর্ণনা যত মনোজ্ঞ, বাংলাতে ততটা নয়।
বাংলাতে এই ঋতুবোধটি নতুন করে জাগলো রবীন্দ্রনাথের কাব্যে। তিনি কালীদাসের সময়কালের আনন্দ চিত্র আঁকতে গিয়ে আষাঢ়ের বর্ণনা দিলেন। এই আষাঢ়ের বর্ণনা আমরা পাই তার ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাই নাহি রে’-এই চরণের মধ্য দিয়ে। তিনি কালিদাসের সৌন্দর্যকে প্রাচীন বলয় থেকে তুলে এনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করলেন। একটি শিহরণ, একটি চঞ্চলতা এবং একটি আনন্দ উদ্বেলতা তার বর্ণনায় আছে। রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ দক্ষতার সাথে পুরাতনকালের জীবনকালের সাথে বর্তমানকালের জীবনকালকে অভিনিবেশের সাথে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। আধুনিক সময়ে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মতো করে আষাঢ়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ আর কেউ দিতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বর্ণনায় স্বপ্ন আছে, কামনার দীপ্তি আছে, আকাক্ষার আতুরতা আছে এবং প্রকৃতি বিষয়ে একটি বোধ আছে। আমাদের জীবনে আষাঢ় যে হারিয়ে যায়নি রবীন্দ্রনাথ তা নতুন করে বুঝিয়ে দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের আষাঢ় বিষয়ক এ সুখানুভূতি আমাদের কল্পনায় বেঁচে থাকুক-এই প্রার্থনাই করি।