উৎপলকে হারিয়ে যেন সর্বহারা তার পরিবার
Published : Sunday, 3 July, 2022 at 12:00 AM
বলা
হয়ে থাকে বিল দেখতে হলে যেতে হবে চলনে। ঢাকার অদূরবর্তী সাভারের আশুলিয়ায়
নিজেরই ছাত্রের মারধরে নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের বাড়ি এই চলনবিলের
একপ্রান্তের একটি গ্রাম এলংজানীতে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী
মোহনপুর থেকে উৎপলের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বর্ষাকালে নৌকার কোনো বিকল্প নেই।
শুক্রবার সকালে ওই বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়াবার আগেই কানে এল কোনো এক নারীর
বুকফাটা আর্তনাদ। কাঁদছিলেন উৎপলের মা অশীতিপর বৃদ্ধা গীতা রাণী সরকার।
কান্না অবশ্য এক সপ্তাহ ধরে বাড়িটির সবার বুকে জমে আছে।
আশুলিয়ার
চিত্রশাইল এলাকার ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল সরকার নিজ
শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতুর মারধরের শিকার হন গত শনিবার দুপুরে। একদিন
পর সোমবার ভোরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়
তার মৃত্যু হয়।
সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকে অন্তত ৩০ কিলোমিটার দূরে
উল্লাপাড়া উপজেলায় পড়েছে উৎপলের গ্রাম দত্তপাড়া এলংজানী। ওই গ্রামে যেতে
হলে উল্লাপাড়ার শ্যামলীপাড়া বাস টার্মিনালে নামতে হবে। সেখান থেকে ১০
কিলোমিটার দূরে লাহিড়ী মোহনপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়ার জন্য ভাড়ার মোটর
সাইকেলই সবচেয়ে সহজপ্রাপ্য বাহন। এই স্টেশন লাগোয়া চলনবিলের ঘাট থেকে আরও
অন্তত পাঁচ কিলোমিটার নৌকায় পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এলংজানী গ্রামে।
শুক্রবার
সকালে উৎপলদের বাড়িতে ভেতরে ঢুকতেই নজরে আসে গীতা রাণী সরকার তার ছেলের
ছবি বুকে জড়িয়ে কান্না করছেন। কাঁদতে কাঁদতে কথা জড়িয়ে আসছে তার। বিলাপ করে
চলনবিলের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, “তোমরা আমার ছোট ছায়াওলরে (ছেলেকে) আইনা
দেও। আমার ছায়াওল কোনে (কোথায়) গেল রে। উৎপল আমার সবচে আদরের। ওয়াক (ওকে)
ছাড়া আমি কিচ্ছু বুঝি না।”
উৎপলের মায়ের বিলাপের মধ্যেই আলাপ হয় তার
বৌদি ইতি রাণী সরকারের। কাঁদছিলেন তিনিও। কান্না চেপে বলেন, “শাশুড়ি প্রায়ই
ভুলে যাচ্ছেন, তার ছোট ছেলে আর নেই।” ছেলের বউয়ের কথায় হয়ত সম্বিত ফেরে
গীতা রাণীর। আবার বিলাপ জুড়েন তিনি, “আমার ওই ছায়াওলের মাতায় (মাথায়) বেশি
বুদ্দি আছিল। বাড়ির সবেই ওয়াক বালবাইসতো। কিছুদিন আগে বাড়িত থাইক্যা যাওয়ার
সময় কইলো মা তুমি দাদাগোরে হাতে (সাথে) থাইকো। আমি ফের আসমু, কিন্তু আমার
হেই ছাওয়াল কোনে গেল রে। তোমরা আমার ছাওয়ালেক আইনা দেও।”
দেবর উৎপলকে
মায়ের আদরে বড় করেছেন সবার বড় বৌদি ইতি রাণী সরকার। উৎপল তা ভুলেননি।
ভাতিজা অভিষেক সরকারকে পড়াশোনা করিয়েছেন যত্ন করে। অভিষেক এখন চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যেখানে পড়ে এসেছেন উৎপলও।
অতীতের নানা স্মৃতি
হাতড়ে এখন কান্না করছেন বৌদি ইতি রাণীও। তিনি বলেন, “আমাদের সংসারের মাথা
চলে গেছে। উৎপল পরিবারের সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতো, বুদ্ধি দিতো। সে
(উৎপল) সবার ছোট হলেও আমাদের কাছে ছিল বটগাছের মতো। আমার ছেলে অভিষেক
ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। এখন কাকা ছাড়া এই ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে? উৎপলের হারিয়ে
সর্বহারা হয়ে গেছি আমরা।”
উৎপলের জন্ম ১৯৮৭ সালে। গ্রামের দত্তপাড়া
এলংজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর মেজো
ভাই অসীম কুমার সরকার নাটোরে নিয়ে যান উৎপলকে, ভর্তি করে দেন সেখানকার
দয়রামপুর ক্যান্টমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। নিজে দর্জির দোকানে কাজ করে
ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন তিনি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই
পড়েছেন উৎপল। এরপর বাড়ি ফিরে এসে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন লাহিড়ীমোহনপুর
কে,এম উচ্চ বিদ্যালয়ে।
অসীম কুমার সরকার বলেন, “এখন শুকনার দিনে
সাবমারসিবল হওয়ায় বাড়ির কাছ পর্যন্ত ভ্যান, মোটর সাইকেল আসে। আমাদের
ছোটবেলায় পুরোটাই হাঁটা লাগত। ছোট ভাইটা এই পথে হেঁটে স্কুল করেছে।”
বর্ষায়
পানিতে ডুবে থাকা পথকে সামবারসিবল বলা হয়। স্কুল শেষে উৎপলের পথ বেড়েছিল
অনেকখানি। উপজেলা সদরে অবস্থিত উল্লাপাড়া আকবর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস
করেন তিনি। কলেজ শেষে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন ২০১১ সালে।
অর্থাভাব দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে টিউশনি করেছেন। ২০১৩ সালে চাকরি
নেন আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল ও কলেজে। সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিভাগের প্রভাষক হিসেবে ১০ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন তিনি। উৎপল ওই
প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। এ দায়িত্ব পালন করতে
গিয়ে বিভিন্ন সময় উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শাসন করতে হয়েছে তাকে। এই শাসনই
কাল হয়েছে তার জীবনে। ‘বখাটে’ শিক্ষার্থী জিতুর হাতে জীবন দিতে হলো তার।
আট
ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট হলেও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে থাকা উৎপল কুমার সরকার
পরিবারের অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন বলে জানালেন তারই বড় ভাই অসিত কুমার
সরকার। উৎপলদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়জন অসিত। তিনি বলেন, “উৎপল
আশুলিয়ার কলেজে চাকরি নেয়ার পর আমাকে আর মেজো ভাই অসীম কুমার সরকারকে সঙ্গে
নিয়ে যায়। তার কলেজের পাশেই হাকিম মার্কেটে আমাকে ‘দীপ্ত টেইলার্স' নামে
একটা দর্জির দোকান করে দেয় সে। মেজো ভাই অসীম পাশেই একটি টেইলার্সে চাকরি
করেন। আমরা তিন ভাই পাশাপাশি থাকতাম। ঘটনার দিন সকালেও ছোট ভাইকে কলেজে
দেখেছি। আর দুপুরের পর জানতে পারি তাকে মারধর করা হয়েছে।”
তিনি আরও
বলেন, “ছোট ভাইয়ের ভরসাতেই আমরা ওখানে থাকতাম। ওরা আমার ভাইটাকে মেরে
ফেলেছে। শুনেছি হত্যাকারীরা প্রভাবশালী, ওই এলাকাতে গিয়ে আমরা এখন কিভাবে
ব্যবসা করবো? চাকরি-বাকরি চালাব? কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে?”
মামলার
বাদী উৎপলের মেজো ভাই অসীম কুমার সরকার বলেন, “আমার ছোট ভাইকে
পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেননা মারধরের সময় স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ ও
সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আসামির পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় ওই
এলাকায় থেকে মামলা পরিচালনা করতে ভয় পাচ্ছি। আমরা এখন কী করব, সিদ্ধান্ত
নিতে পারছি না। আশা করি সরকার আমাদের নিরাপত্তা দেবে।”
উৎপলদের সবার বড়
ভাই অজয় কুমার সরকার ও চতুর্থ ভাই আশুতোষ সরকার ঢাকায় আলাদা দুটি টেক্সটাইল
মিলে চাকরি করেন। তাদের দুজনের চাকরিও উৎপলের জোগাড় করে দেওয়া। আশুতোষ
সরকার বলেন, “অভাবের সংসারে ২০০৩ সালে বাবা মারা যাবার পর জমি বিক্রি করে
তিন বোনকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট ভাইকে মানুষ করেছি। ছোট ভাইয়ের চাকরি
হওয়ার পর সেও আমাদের কর্ম জোগাড় করে দিয়েছে। উৎপল ছিল পরিবারের মাথা, সংসার
পরিচালনাসহ সবকিছু সেই মেইনটেইন করত। তার কাছে না শুনে আমরা কেউ কিছু
করতাম না। অথচ সেই ভাইকে ওরা খুন করেছে। আমরা এতিম হয়ে গেছি। কে আমাদের
আশা-ভরসা দেবে। ওর বউটার ভবিষ্যৎ কি হবে কিছুই ভাবতেই পারছি না।”
তিন
বছর আগে ২০১৯ সালের ৩০ জুন শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গুদিবাড়ি গ্রামে বিয়ে
করেন উৎপল। তার স্ত্রী বিউটি রাণী নন্দী ঢাকায় চাকরি করেন। তাদের সংসারে
এখনও কোনো সন্তান হয়নি। স্বামীর লাশের সঙ্গে বিউটিও এসেছেন দত্তপাড়া
এলংজানী গ্রামে।
গ্রামটিতে ৩০টি হিন্দু পরিবারের পাশাপাশি বাস করে
মুসলমানরা। উৎপলের মৃত্যুতে প্রতিবেশী আছিয়া খাতুনও ভীষণ ব্যথিত বোধ করছেন।
নিজে এগিয়ে এসে আছিয়া বলেন, “উৎপলের মোতন এ্যাতো বালো একটো ছওয়ালকে ওরা
হত্যা কোরছে, আমরা গ্রামবাসী এইড্যা মাইন্যা নিতে পাইরত্যাছি না।”
উৎপলের এক কাকাতো ভাই পেশায় শিক্ষক সৌরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, “পরিবারটির পাশে না দাঁড়ালে ওরা শেষ হয়ে যাবে।”
সিরাজগঞ্জ
শহরের এস বি রেলওয়ে কলোনি স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই শিক্ষক হত্যাকারীর
শাস্তির পাশাপাশি দরিদ্র এ পরিবারটির জন্য সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার
দাবি পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেন।