ড. ফরিদুল আলম ||
পদত্যাগে রাজি হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে গোতাবায়া রাজাপক্ষে বলেছিলেন, ১৩ জুলাই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করবেন। এর কারণ বোঝা গেল ১২ জুলাই তাঁর দেশত্যাগের চেষ্টার মাধ্যমে। তিনি চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজেই দেশত্যাগ করতে। প্রবল প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষও এবার তোয়াক্কা করল না প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ইচ্ছাকে।
কলম্বো বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশত্যাগের চেষ্টার প্রাক্কালে পরিবারসহ তাঁকে আটকে দেওয়া হলো। গতকাল বুধবার তাঁর পদত্যাগ করার কথা ছিল। ওই দিনই তিনি সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। জানা গেছে, তিনি পদত্যাগপত্রে সই করে গেছেন। আগের দিন আটকে দেওয়া হয় তাঁর ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষেকেও। শ্রীলঙ্কার পরবর্তী সরকার এসে রাজাপক্ষে পরিবারের এই সদস্যদের কিভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এদিকে প্রতিবাদে উত্তাল শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট আগামী ২০ জুলাই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। সে দেশের পার্লামেন্টে এখন পর্যন্ত রাজাপক্ষের দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সেই দিক বিবেচনায় রাজাপক্ষে পরিবারের বা দলের কেউ এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন তাঁকে অবশ্যই রাজাপক্ষের দল পোদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) আস্থাভাজন হতে হবে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল সামাগি জন বালাবেগায়া (এসজেবি) নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে বিষয়টি সম্ভব করতে হলে তাঁকে অবশ্যই এসএলপিপির সমর্থন পেতে হবে। আর এটি হলে রাজাপক্ষের দলের গৃহীত নীতিগুলোকেই প্রকারান্তরে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাস্তবায়ন করে যেতে হবে।
একদা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সচ্ছল দেশ শ্রীলঙ্কা বর্তমানে বহির্বিশ্বের কাছে এক করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। মাত্র দুই মাস আগে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে তাঁর পদ ছেড়ে দেওয়ার পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় কোনো রকমে পালিয়ে জনরোষ থেকে রক্ষা পান। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এর আগে তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা রনিল বিক্রমাসিংহে। যিনি রাজাপক্ষে পরিবারের ঘনিষ্ঠ। সে যাত্রায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে ক্রমাবনতিতে জনগণের অসন্তোষের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে এবং সারা দেশের মানুষ কলম্বোতে একত্র হয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ আক্রমণ করে বসে। পরিস্থিতি এমন হবে আঁচ করতে পেরে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টকে আগের রাতেই নিরাপদে সরিয়ে নেয়। এবার রক্ষা পেল না নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের নিজস্ব বাসভবন। বিক্ষোভকারীরা সেখানে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্টের বিছানায় শুয়ে আছে, রান্নাঘরে রান্না করে, সোফায় বা ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে, বারবিকিউ করছে এবং সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছে, উল্লাস করছে।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী অজ্ঞাতবাসে থাকা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে গত ১৩ জুলাই পদত্যাগ করেছেন। এর আগে তিনি পার্লামেন্টের স্পিকারের মাধ্যমে তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানান। মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগ যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, সেই সময়েই প্রেসিডেন্ট নিজেও যদি বুঝে থাকেন যে দেশের ক্রমাগত মন্দা পরিস্থিতিতে তাঁর আসলে সহসাই খুব কিছু করণীয় নেই, সে ক্ষেত্রে ওই সময়েই তাঁর পদত্যাগ অন্তত ‘তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন’ এমন অপবাদ থেকে তাঁকে রক্ষা করে কিছুটা স্বস্তির বিদায় নিশ্চিত করতে পারত। তিনি সেটা করেননি, এর কারণ হিসেবে বলা যায়, আসলে তিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। বিক্রমাসিংহে দায়িত্ব গ্রহণের পর খুব দ্রুতই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। ভারত শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায়। তীব্র জ্বালানি সংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে অতিরিক্ত জ্বালানি এবং তাদের ক্রেডিট লাইন থেকে এর আগের এক বিলিয়ন ডলারের বাইরে আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করে। আলোচনা চলতে থাকে চীনের সঙ্গেও। আইএমএফও তাদের এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইএফএফ) আওতায় শ্রীলঙ্কা সরকারকে নতুন করে ঋণ প্রদানের বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী রনিল জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাহায্য চেয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কায় মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর পতন ঘটল। সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে তৎপরতা চলছে, এর মধ্য দিয়ে এই সংকটের কতটুকু সমাধান সম্ভব হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, বিশেষ করে যখন দেশটির রাজনীতিতে এসএলপিপি সর্ববৃহৎ দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। দেশটিতে সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ও ২০২০ সালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সংবিধান অনুযায়ী ২০২৪ সালের আগে প্রেসিডেন্ট ও ২০২৫ সালের আগে সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয়, যদি না পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রেসিডেন্টকে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের ব্যবধানে পদচ্যুত করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দেন। পরিস্থিতি এখন যা, এই অবস্থায় এসএলপিপি এই ঝুঁকিতে যাবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে সংকট মোকাবেলায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে যে আলোচনা চলছে, রাজাপক্ষের অনুপস্থিতিতে সেই একই ফরম্যাটের আলোচনাই চালিয়ে যেতে হবে নতুন কারো নেতৃত্বে। অর্থাৎ এখানে শুধু ব্যক্তিরই পরিবর্তন হচ্ছে, নীতিগুলো সেই আগের জায়গায়ই ঘুরপাক খেতে থাকবে। এ অবস্থায় জনগণ যে আবারও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশন্স কমিটি এক টুইট বার্তায় রাজাপক্ষে সরকার ব্যর্থ উল্লেখ করে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে এক জাতীয় সরকার গঠনের ওপর জোর দিয়ে আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনের বিষয়টির কথা উল্লেখ করেছে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় আজকের যে অবস্থা সেটির জন্য রাজাপক্ষের দলের দায় বেশি, এটা নিয়ে সন্দেহের যেমন কোনো অবকাশ নেই, একইভাবে ৫০ বছর ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে দেশটিতে সেভাবে কোনো আর্থিক শৃঙ্খলাই গড়ে ওঠেনি। প্রায় ২৬ বছর ধরে তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধের বাইরে আর্থিক খাত বলতে যে জায়গাটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছিল, সেটি হচ্ছে পর্যটন খাত। যদিও সেভাবে দেশটিকে আজকের মতো এমন অর্থনৈতিক সংকটে কখনো পড়তে হয়নি। তামিল বিদ্রোহ অবসানের পর মাহিন্দা রাজাপক্ষে সরকারের আমলে নেওয়া মেগাপ্রকল্পসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার ধারণ করার মতো অবস্থায় যে দেশটি নেই, সেটি কখনো অনুধাবন করেনি এসএলপিপি নেতৃত্ব। ব্যাপক জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মতো করে অনেকটা নিজেদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়নের মোড়কে ফেলতে গিয়ে যখন আর পেরে উঠল না, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। দেশকে বিকল্প কোনো উপায়ে টেনে তোলার সব চেষ্টাই কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
এ কথা এখন সর্বজনবিদিত যে শ্রীলঙ্কা সরকারের রিজার্ভ এখন শূন্য। সর্বত্র খাদ্য, ওষুধ আর জ্বালানির তীব্র সংকট। আগের আমদানি ব্যয় অপরিশোধিত থাকায় নতুন করে আমদানি সংকট বিরাজ করছে। আইএমএফসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে যেকোনো আলোচনা শুরু করার মতো কার্যকর নেতৃত্ব দ্রুত আসতে যাচ্ছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, ২০ জুলাই পার্লামেন্টের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসজেবি নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা আগ্রহী, কিন্তু তিনিই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী নন, রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান শরত ফনসেকা, অনুরা কুমারা দেসানায়েকে, চম্পিকা রানাওয়াকা, প্রফেসর জি এল পেরিসসহ বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণ করা এবং অন্তত আগামী দুই বছর পর্যন্ত দেশকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আস্থা অর্জন—এ সব কিছুই ভীষণ কঠিন বিষয়।
এখন তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এত সব হতাশার মধ্যে কি কোনো আশার বিষয় নেই? এ ক্ষেত্রে একমাত্র আশা থাকতে পারে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কার এই সংকটকে নিজেদের দায় হিসেবে স্বীকার করে নেয়। সে ক্ষেত্রেও নতুন প্রশ্ন আসবে এশিয়ার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং ভারত—যারা এত দিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে, তারা কি তবে হাল ছেড়ে দেবে? পরিস্থিতি কিন্তু বলছে, শ্রীলঙ্কার রাজনীতি এখনো চীনের প্রভাববলয়ের মধ্যেই রয়েছে, আর পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এটা সবচেয়ে বড় অস্বস্তির বিষয়। চীন কিন্তু এত সব সংকটের মধ্যে এখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। অন্যদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাই বাধা হয়ে আছে চীনের বর্তমান ভূমিকা। এই অসন্তোষের ম্যাজিকাল কোনো সমাধান নেই। শ্রীলঙ্কার এখন দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা জোগান দিতে কোনো পক্ষই আগ্রহ দেখাবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন যুদ্ধময়। সবার মনোযোগ ইউক্রেন-রাশিয়ার দিকে, সেই সঙ্গে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোও এখন অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে। যদি বলা হয়, শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি ক্রমে গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে, সেটাও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]