রণবীর ঘোষ কিংকর:
দেশের লাভ জনক ব্যবসার মধ্যে চামড়াও একটি অন্যতম শিল্প। বাংলাদেশে এ শিল্পের যতদূর প্রসার ঘটেছে তার অধিকাংশ চামড়ার যোগান দেওয়া হয় ঈদ-উল আযহার পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে। নানা সংকটে চামড়া ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা।
কোন কোন বছর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে নদীতে, খালে ফেলে বা মাটিতে পুঁতে দিতে হচ্ছে, আবার কোন সময় চওড়া দামে কিনে ট্যানারি মালিকদের কাছে পানি দামে বিক্রি করে ভিটে বাড়ি হারাচ্ছে। আর বছরের পর বছর ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া থাকায় সুদের বোঝা ভারি হয়ে পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
কুমিল্লায় চামড়ার বড় আড়ৎ চান্দিনা ও দাউদকান্দি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা ইলিয়টগঞ্জ বাজার। ওই বাজারে প্রায় ১২টি আড়তের মালিকরা চামড়া ব্যবসায় যুক্ত। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে জেলা জুড়ে তাদের অন্তত ২শ মৌসুমী ব্যবসায়ী রয়েছে। ওই মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বাড়ি, মহলা ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে আনেন। কোরবানির ঈদে ওই বাজারে প্রায় ৩০-৪০ হাজার চামড়া মজুদ করা হতো। কিন্তু এ বছর ওই বাজারে চামড়া মজুদ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার! ১২টি আড়তের মধ্যে ৯টি আড়তের মালিকই ওই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন! কেউবা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।
ইলিয়টগঞ্জ বাজারের চামড়ার বড় আড়তদার আজহারুল ইসলাম। পাশ্ববর্তী শব্দলপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সারা বছরই চামড়া কেনার পাশাপাশি কোরবানির ঈদে ১৫-২০ হাজার চামড়া কিনে থাকতেন। এ বছর তিনি ওই পেশা ছেড়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না। তার মতো এমন আরও অনেক ব্যবসায়ীই পেশা ছেড়েছেন।
ওই বাজারের অপর ব্যবসায়ী জুলহাস মিয়া জানান, আমার আড়তের প্রতি বছর ২-৩ হাজার চামড়া কিনতাম। এ বছর মাত্র ৬শ চামড়া কিনেছি। আজহারুল ইসলাম এর মতো বড় বড় ব্যবসায়ীরাও ট্যানারি মালিকদের দুঃখে চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
এ বছর কম কেনার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, লবনের দাম দ্বিগুন। শ্রমিকের মজুরিও অনেক বেড়েছে। আবার ট্যানারি মালিকরা অনেক চামড়া বাদ দিয়ে দেয়। তাই ঝুঁকি নেইনি।
শব্দলপুর গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান সিরাজ জানান, কোরবানি ঈদের রাত থেকে ইলিয়টগঞ্জ-বড়ইয়াকৃষ্ণপুর সড়কে প্রবেশ করতেই চামড়ার স্তুপের কারণে মানুষ ঠিকমত চলা ফেরা করতো পারতো না। ঈদের পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্তও প্রতিটি আড়তে চলতো চামড়ায় লবন মাখাসহ নানা প্রক্রিয়ার কাজ। দুর্গন্ধে মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসতো। এ বছর একেবারেই ফাঁকা। বুঝারই উপায় নেই যে এখান চামড়ার আড়ত রয়েছে।
চান্দিনা উপজেলার লতিফপুর গ্রামের চামড়া ব্যবসায়ী মিলন মিয়া জানান, ট্যানারি মালিকদের কারণে এ পেশা মানুষ ছেড়ে দিচ্ছে। ঢাকার বাহিরে সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল ৪০-৪৪ টাকা নির্ধারণ করেন। ওই নির্ধারিত টাকায় ট্যানারি মালিকরা শতকরা ৩৫-৪০টি চামড়া কিনে বাকি ৬০ শতাংশ চামড়া বিভিন্ন অযুহাতে বাতিল করে দেন। তখন আমাদের মতো আড়তদাদের কি করার থাকে। তখন বাধ্য হয়েই তাদের মনগড়া দরে বিক্রি করতে বাধ্য হই। আবার ট্যানারি মালিকরা বাকিতে চামড়া নিয়ে ওই টাকা বছরের পর বছর নানা অযুহাতে ঘুড়াইতে থাকে। ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা পাওনা নেই এমন চামড়া ব্যবসায়ী পাওয়া যাবে না। আমি নিজেও ৩-৪টি ট্যানারি থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা পাওনা আছি।
ওই ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি প্রতি বছর ১৫-২০ হাজার চামড়া কিনে ট্যানারিতে দিতাম। এ বছর মাত্র ৭ হাজার চামড়া কিনেছি।
একাধিক চামড়া ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, পত্রিকায় যদি আমাদের নাম আসে তাহলে আমাদের চামড়া কিনবে না ওই ট্যানারির মালিক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা নির্ধারিত ট্যানারিগুলোতেই চামড়া দিয়ে থাকি। তারাই আমাদের টাকা বকেয়া রেখেছেন, আবার তারা যদি আমাদের চামড়া না কিনেন তাহলে চামড়াগুলো নিয়ে আমরাও বিপাকে পড়ে যাব।
প্রায় অর্ধেক এর চেয়েও বেশি আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ না করায় চামড়া গুলো কোথায় বিক্রি হয়েছে এমন প্রশ্নে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, কোরবানির পর দেড় দুই লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়াও ৩-৪শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মূল্য না পেয়ে অধিকাংশ মানুষ নিকটস্থ এতিমখানা ও মাদ্রাসায় চামড়া পৌঁছে দিয়েছে। ওইসব এতিমখানা ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অনেকে নিজেরাই লবন দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আবার কেউবা নিজেরাই ঢাকায় নিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন (বিটিএ) এর সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্যাহ এর ব্যবহৃত ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।