ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ইতিহাসের অনন্য এক নারী
Published : Friday, 5 August, 2022 at 12:00 AM
 
   ইতিহাসের অনন্য এক নারী ড. মীজানুর রহমান  ||

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হওয়ার পথে এই পুণ্যবান নারী আজীবন পাশে থেকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু, পরামর্শক, সমর্থক এবং সহায়ক।

বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এমন বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালি জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি অনুঘটক হিসেবে ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবন্দি থাকার সময়ে কিংবা জাতির সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এমনকি দলের নেতা না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তখন তিনি সাহসী ও বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব হতো, যদি বেগম মুজিব তার সাথে না থাকতেন। বেগম মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই তিনি তার পিতা-মাতাকে হারান এবং তার দাদার ভাইয়ের সংসারে ভবিষ্যৎ শাশুড়ির কাছে পালিত হন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার বয়স যখন দশ বছর তখন তার বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর (শেখ মুজিব আমার পিতা,পৃ:২৭) । বঙ্গবন্ধুর ভাষায়’...যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছিল ছোট বেলায়।

১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ: ২১)। ৩৩ বছর বিবাহিত জীবনে প্রায় ১৩ বছর বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। মুক্ত দাম্পত্য জীবন মাত্র ২০ বছরের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের সেই বন্ধন অটুট ছিল।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে উইনি ম্যান্ডেলার (১৯৩৬-২০১৮) রাজনৈতিক কার্যধারার তুলনা করলে কয়েকটি বিষয়ে মিল পরিলক্ষিত হবে। উভয়ই ছিলেন বিশ্বের কিংবদন্তি দুই রাজনৈতিক নেতার যোগ্য জীবনসঙ্গী। উইনি ম্যান্ডেলা ছিলেন সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ, ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ তাকে ‘জাতির মাতা’ হিসাবে অভিহিত করে থাকেন।

তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জেল খাটা, একের পর এক প্রতিক‚ল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়ার সময় নেলসন ম্যান্ডেলার পাশে ছিলেন উইনি। নেলসন ম্যান্ডেলার দাম্পত্য জীবনের (১৯৫৭-১৯৯৬) ১৯৬২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল দুর্ভোগ ও দুর্দশাময়।

বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্বদানের কারণে ১৯৬২ সালে নাশকতার অভিযোগ তুলে নেলসন ম্যান্ডেলাকে পুরে দেয়া হয় কারাগারে, একটানা ২৭ বছরের কারাবাস ছিল যন্ত্রণার। অর্থাৎ নেলসন ম্যান্ডেলাকে বিয়ের পর ৩৮ বছরব্যাপী বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাদের আলাদা থাকতে হয়েছে। দুঃসময়ে উইনি একাই তাদের দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন।

অন্যদিকে সরকারের অত্যাচার ও দমন-পীড়নের মধ্যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নেলসন ম্যান্ডেলার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে বের হন। স্বামী কারাবন্দি থাকার সময় স্পষ্টবাদী উইনি কঠোর পরিশ্রম করে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘সব ধরনের পরিস্থিতিতেই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।’ বেগম মুজিব নিজের আত্মজীবনী লিখে যাননি। লিখলে সেটা হত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য দলিল। তবে জাতির জনকের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস, তা পেয়েছি কিন্তু বেগম মুজিবের কারণেই।

রাজনীতির কারণে পারিবারিক জীবনে একটার পর একটা আঘাত এসেছে। কিন্তু বেগম মুজিব কখনো ভেঙ্গে পড়েননি বা মুজিবকে বলেননি ‘তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও।’ সংসারটা বেগম মুজিব একাই চালাতেন। টাকা, শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি কোনো কিছুর জন্যই কখনো বঙ্গবন্ধুকে বিরক্ত করেননি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে যখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন তখন মন্ত্রিত্বের সকল সুযোগ-সুবিধা ছাড়তে হয়েছিল।

পরিবারের এই সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার ঘটনাটাও বেগম মুজিব হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। এখনকার দিনে কোনো মন্ত্রীর পক্ষে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কেবল দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিলে নিশ্চিত করে বলা যায়, ভাবিরা হালকা হলেও ঝগড়াঝাটি করবেন। কিন্তু বেগম মুজিব এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা (এমনকি আওয়ামী লীগেও) তাদের স্ত্রীদের জন্য রাজনৈতিক পদপদবি হাতিয়ে নেন।

মূল দলের মহিলা ফ্রন্টের উচ্চ পদ অথবা সংরক্ষিত আসনে এমপি অথবা দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পদে স্ত্রীকে বসাচ্ছেন অথবা স্ত্রীর পদের জন্য বাহানা ধরছেন। এমনটি বেগম মুজিব কখনো চিন্তাই করেননি। এটা যে কেবল ইদানীং হচ্ছে বা কেবল আমাদের দেশে হচ্ছে এমনটি নয়।

বার্মার জাতীয়তাবাদী নেতা অং সান এর স্ত্রী শযরহ শুর (মিয়ানমারের বর্তমান নেত্রী অং সান সুচির মা, যিনি পেশায় একজন নার্স ছিলেন এবং ১৯৪২ সালে অং সান বার্মা ক্যাম্পেইনের সময় আহত হয়ে রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে যার সাথে পরিচয় হয়) বার্মার স্বাধীনতা উত্তর পার্লামেন্টে (১৯৪৭-১৯৪৮) স্বামীর ছেড়ে দেয়া রেঙ্গুনের খধহসধফধি এলাকার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৫৩ সালে বার্মার প্রথম সমাজকল্যাণমন্ত্রীও হয়েছিলেন।

১৯৬০ সালে তাকে নয়া দিল্লিতে বার্মার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া যে কোনো একটি আসনে বেগম মুজিব অনায়াশেই এমপি হতে পারতেন। কিন্তু বেগম মুজিব এমন পদ পদবির কথা কখনো চিন্তাই করেননি। স্বাধীনতা উত্তর কালে বঙ্গভবন বা গণভবনের বিশাল পরিসরে থাকার সুযোগ সত্ত্বেও ৩২নং বাড়ির ছোট্ট পরিসরেই থেকে গিয়েছিলেন, নিজের পরিবারে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন চিন্তাও তার মাথায় আসেনি।

সাড়ে তিন বছরের ক্ষমতাকালে এ বাড়িতে কোনো জমকালো পার্টিও আয়োজন করেননি। যেমনটি করতেন আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক-এর স্ত্রী খধঃরভব ঐধহরস। কামাল আতাতুর্ক ৪২ বছর বয়সে ২৪ বছর বয়সী খধঃরভব-কে বিয়ে করলেও মাত্র দুই বছর (১৯২৩-১৯২৫) স্থায়ী হয়েছিল তাদের বিবাহিত জীবন।

এই অল্পসময়ের মধ্যেই আঙ্কারার ‘Cankaya Manson’-এ ব্যাপক সাজসজ্জা করেন Latife Hanim, অসংখ্য জমকালো সংবর্ধনা ও পার্টির আয়োজন করেন। এ সময়ে তিনি আতাতুর্কের সকল সফরে সঙ্গী হতেন এবং বক্তৃতা দিতেন। দলীয় রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত না থেকেও দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থাকা রাজনৈতিক কর্মীদের পরিবারকে দেখাশোনা করতে হয়েছিল বেগম মুজিবকে।

তিনি দুঃসময়ে কর্মীদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ দিতেন। কর্মীদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাদের পরিচালনা করতেন। এমনকি তিনি অলঙ্কার বিক্রি করে সংগ্রহ করা তহবিল দলের কাজে সরবরাহ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সংকটের সময়ে তিনি জনতা ও নেতাদের নির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার লেখায় আরো স্পষ্ট হয়েছে বিষয়টি- ‘জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তার মাধ্যমেই দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা আম্মা নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিতেন। আব্বা কারাবন্দি থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা যোগাড় করতেন। তিনি কখনো ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি।

একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।’

কয়েকটি ঘটনা স্মরণ করলে বেগম মুজিবের অবদান আরো স্পষ্ট হবে। বেগম মুজিবের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তিনি সবই মনে রাখতে পারতেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধু তাকে ‘সারাজীবনের জীবন্ত ডায়েরি’ বলেছেন। বেগম মুজিবের আরেকটি সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধু তার দলের সদস্যদেরও কাছ থেকে কী বলবেন এবং কী বলবেন না সে সম্পর্কে বিভিন্ন পরামর্শ ও মতামত পেয়েছিলেন। এগুলো তার মনে একধরনের বিভ্রান্তি ও চাপ সৃষ্টি করেছিল। তবে, বেগম মুজিব তাকে অন্য কারও চেয়ে বেশি বুঝতেন, তাই স্বামীকে স্নেহ দিয়ে বলেছিলেন: ‘আপনার মনে যা আছে তাই বলুন।

আপনার কথা হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আপনি যা বলতে চান, নিজের মন থেকে বলুন।’ যা বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগকে এড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য একটি জাদু হিসেবে কাজ করেছিল। এমনটি না করলে অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশকে সাম্প্রতিক কালের কাতালোনিয়ার ভাগ্যবরণ করার সম্ভাবনা ছিল।

স্বামী-সংসার ভালোভাবে আগলে রেখেও এই বাঙালি নারী শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গমাতা তার বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং রাজনীতি সম্পর্কে বাস্তবচিত মূল্যায়ন এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের কারণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘তিনি বাবাকে শত দুঃখ-কষ্টেব মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে মা‘র ইতিবাচক সমর্থন ছিল।’ (‘আমার মা ফজিলাতুন্নেছা’, শেখ রেহানা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনায় ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বৈশাখী প্রকাশনী, ১৯৯৮,পৃ-২৪’)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়- ‘জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকরা আমার বাবাকে হত্যা করল, তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।’ এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন’ (‘আমার মা: বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব’, শেখ হাসিনা, ৮ আগস্ট, ২০১৬, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ )

লেখক: সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।