বিশেষ প্রতিনিধি
॥ ‘..ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি/ সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর
ধোঁয়াশায়/ মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-/ কিন্তু তিনি
আজ সগৌরবে/ এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্ত উচ্চারণে/ সাধারণ মানুষের প্রখর
চৈতন্যে/ শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের আন্দোলনে/ রৌদ্রঝলসিত
পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।’
স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবর রহমানের স্মরণে প্রয়াত দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তার ‘তিনি
এসেছেন ফিরে’ নামক কবিতায় এভাবেই হন্তারকদের অভিসম্পাত করেছেন।
গভীর
হয়েই বসেছে শোক। ৪৬ বছর পর আজও মুহুর্মুহু কাঁদাচ্ছে মানুষকে। যে বাঙালির
জন্য এত ত্যাগ, এত তিতিক্ষা, বারবার ফিরে আসা মৃত্যুর দুয়ার থেকে সেই
সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতাকে গুটিকয় লোভাতুর নরপিশাচরা এমন নির্মমভাবে
হত্যা করবে- এমন ভাবনা অবিশ্বাস্য ছিল বাঙালির কাছেও। আর তাই বারবার মনে
করে মুখ, উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি, আজও শ্রদ্ধায়, নৈবেদ্যে,
প্রতিদিন-প্রতিক্ষণে ফিরে আসেন পিতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান।
পুবের আকাশে এখনও রোজ রক্তিম সূর্য ওঠে। নতুনের কেতন উড়িয়ে মানুষ
স্বপ্ন জয়ের প্রত্যয়ে এগিয়েও চলে প্রতিদিন। কিন্তু সে স্বপ্লে অপূর্ণতা
রয়ে যায়। সে অপূর্ণতা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাণপুরুষ জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধুকে হারানোর।
বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করল নরপিশাচ
ঘাতকরা, ঝলমলে ঝলমলে আগস্টের উজ্জ্বল আকাশে, সেদিন ডানা মেলল মন খারাপের
মেঘ। ছেঁড়া মেঘ কান্না হয়ে ঝরল মানুষের চোখ বেয়ে। আগস্ট এলেই সে মেঘ এখনও
উড়ে এসে বসে বাঙালীর ঘরে ঘরে। পোড়ে অনুশোচনা ও অনুতাপের আগুনে।
জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু হৃদয়ের আবেগকে যথেষ্টভাবে ধারণ করতে সক্ষম হন। এর
পেছনে ছিল মানুষের ভালবাসা ও সাহায্য করার তাঁর দরদি মন। নিজ দেশের মানুষকে
অসম্ভব বিশ্বাসও করতেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন- ‘সাত কোটি
বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের
মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না।’
কোন বাঙালী তাঁর জীবনের হুমকি হতে
পারে, কখনও ভাবেননি এমনকি বিশ্বাসও করেননি বঙ্গবন্ধু। তাই সুরক্ষিত
রাষ্ট্রপতির ভবন ছেড়ে বসবাস করতেন প্রিয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের যে বাড়িটি একদিন স্বাধীনতার প্রশ্নে একই পথে নিয়ে
এসেছিল বাঙালীকে, সেই বাড়িটিই সেই বাঙালীকে কাঁদালো একদিন অঝোর ধারায়।
বাড়িটির
ব্যালকোনিতে দাঁড়ানো দৃঢ়চেতা যে নেতার অঙ্গুলি হেলনে বুকের ভেতর জ্বলতো
মুক্তির দ্রোহ, ঘাতক নরপিশাচদের কারণে সেই পিতাই একদিন মুখথুবড়ে পড়লেন
বাঙালীর অনিবার্য সেই বাড়ির মেঝেতেই। সিঁড়ি গড়িয়ে বইল রক্তের ধারা। ঘাতকের
বুলেট বিদ্ধ করল কালজয়ী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে- সপরিবারে। বিদ্ধ হলো গোটা
বাঙালী, স্বাধীন বাংলাদেশ। রচিত হলো পৃথিবীর এ যাবতকালের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও
জঘন্যতম ইতিহাস।