ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
Published : Thursday, 8 September, 2022 at 12:00 AM
জীবনবোধ ও জীবনদর্শনজুলফিকার নিউটন  ||
পূর্ব প্রকাশের পর
২৯
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে প্রবেশের অল্প পরেই ইংরেজি চর্চা শুরু হয়। মন কাড়ে উপহার পাওয়া গ্রীস ও রোমের পুরাণ কাহিনী। শাহনামা, আলিফ লায়লা মহাভারত রামায়নের পরিচিত জগৎ থেকে এ কোন আনকোরা অথচ তৎকালিক, অনেকধা ও সমাকর্ষী, সূর্যকরোজ্জ্বল এবং অভিশপ্ত ত্রিভুবনে প্রবেশ করলাম আমি। প্রজারপিনা (পার্সিফোনি) আর প্লুটো, আপোলো আর ডায়ানা, ভিনাস (আফ্রদিতি) আর মিনার্ভা (পেলাস আথেনি), জুনো আর জুপিটার, পার্সিউস, মেডুসা আর আন্ড্রোমিডা, একো আর নার্সিসাস, সন্তান শোকে প্রস্তরীভূত নিওবি, যেসন এবং আর্গোনটস, মহাবীর হারকিউলিস (হেরাক্লিস), আদিকবি অর্ফিউস। খেলাধুলোর দিকে কোনোদিনই আমার বিশেষ টান ছিল না। অল্প বয়স থেকেই এই সব বই আমার কল্পনার জগৎকে অপ্রমেয়, গহীন, অভিব্যাপ্ত, জনাকীর্ণ, রূপ-গন্ধ-ধ্বনি-ঘটনাসংকুল, রহস্যপরিবৃত করে তোলে। আমার কখনো ধর্মবিশ^াসের প্রয়োজন হয়নি, সাহিত্যই আমার অস্তিত্বকে পুষ্ট করেছে। আর্থিক অনটনের যত চাপই পড়ুক, আমার পঠনপাঠনে কখনো শিথিলতা আসেনি। নানা মানুষ নানা উৎস থেকে খুঁজে বই সংগ্রহ করে মনের ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করেছি।
স্কুল ছাড়বার কিছুটা আগেই আবিষ্কার করি ইংরেজ রোম্যান্টিক কবিদের জগৎ। দাদা পালি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর শোবার ঘরে বইয়ের শেলফে ত্রিপিটক, থের-থেরি গাথা এবং মিলিন্দপহ্নের পাশে গলা জড়াজড়ি করে সানন্দে বিরাজ করতেন ওয়র্ডস্্ওয়র্থ, কোলরিজ, বায়রন, শেলী এবং কীটস্। ওয়র্ডস্্ওয়র্থের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধের বয়স সেটা নয়; কিন্তু কোলরিজের কুবলাই খান আমাকে নিয়ে গেছেন এক রহস্যময় স্বপ্নালোকে; বায়রনের দুর্বার কৌতুকক্ষিপ্র, ক্ষুরধার বহমানতা আলোড়িত করেছিল আমার হৃদয় বুদ্ধি ও কল্পনা; শেলি আমাকে ডাকছিলেন উদার মহাকাশে স্কাইলার্কের মত ডানা মেলে উড়তে, স্ফুরিত করলেন বিদ্রোহের বীজ। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সেই কম্পমান, অতিমাত্রায় সংবেদনশীল প্রহরে, দেহের রহস্য যখন মনকে উতলা করতে শুরু করে, যে মহাকবির সান্নিধ্য আমাকে মহাসুখে শিহরিত ও উদ্বেলিত করেছিল তিনি যুবক কবি জন কীট্্স্। তাঁর হৃদয়হীনা রূপসী, ফসলকাটার মাঝখানে আফিংফুলের গন্ধে নিদ্রাতুর হৈমন্তিকা, মধ্যরাত্রে মৃত্যুঞ্জয়ী বিহঙ্গের সঙ্গীতে অনন্তনিদ্রার প্রতীক্ষা এক কম্পমান যবনিকার অন্তরালে অজ্ঞাত লোকের ইঙ্গিত করত। শেষ রাতের শুকতারার মতো, সুরভিত দ্বীপপুঞ্জের মতো, মৃগাক্ষী মঞ্জুকেশিনী সুতনুকার মতো তাঁর প্রতিটি ওড এবং সনেট। কীট্্স্্ এর কাছে এই শিহরিত হৃদয় বঙ্গসন্তান বয়ঃপ্রাপ্তির সন্ধিক্ষণ যার সামনে আপনাকে সমর্পণ করলো। তাঁর ডেথ মাস্কের একটি ফটো সংগ্রহ করে সেটি সযত্নে বাঁধিয়ে রাখলাম আমার পুঁথিপত্রের কুলুঙ্গিতে, কখনো শিউলি কখনো বকুলের মালা, কখনো একটি রক্তকাঞ্চন সেখানে নিবেদিত হতো। নাস্তিকেরও কিছু কিছু দেবতা থাকে। আমার জীবনে দেবতারূপে প্রথম বৃত হন বেদনাগর্ভ রূপাবলীর যুবক কবি জন কীট্্স্। অমৃতস্বাদ বলে যদি কিছু থাকে দীর্ঘজীবনে বারবার তার পরিচয় পেয়েছি নানা দেশের নানা যুগের নানা ভাষায় কবিতা পাঠ করে। মহৎ কবিতা পাঠ আজো আমাকে অব্যর্থ আসবে প্রাণিত করে।
কিন্তু পরিপাশের্^র অভিজ্ঞতা মনে যে সব প্রশ্ন তুলেছিল কবিতার স্বয়ংসম্পূর্ণ জগতে তারা অনেকটাই অবান্তর। শিল্পের অমৃতস্বাদব্যক্তিকে মর্তুকাম প্রবণতা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু পরিপাশর্^ তাতে বদলায় না। প্রশ্নের কোনো সঙ্গত উত্তর না পেয়ে মনে বিদ্রোহের ভাব ক্রমে প্রবল হয়ে উঠছিল। এই সময়ে স্কুলের প্রায় শেষ ধাপের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন সৌভাগ্যবশত কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ আমার মনের সম্পোষনে সহায়তা করেন। প্রথমেই মনে পড়ে শিক্ষক অলীন্দ চক্রবর্তীর কথা মানুষটিকে স্মৃতির পর্দায় এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই। ছিপছিপে চেহারা, বয়স ষাটের কোঠায়, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কিছুটা অন্যমনস্ত, ক্লাসের দুরন্ত প্রকৃতির ছেলেদের উৎপাতে গৌরবর্ণ মুখসহজেই রক্তাভ হয়ে উঠত, ইংরেজিতে অনার্স কিন্তু কোনো রহস্যময় কারণে উঁচু ক্লাসে বাংলা পড়াতেন, খুব রেগে গেলে তাঁর একটি মাত্র ভৎর্সনা-শব্দের সম্বল ছিল : “দন্তমানিক।” শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক, বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও আমাকে তিনি সৌহার্দ্যরে গৌরব দিয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত লক্ষ করেছিলেন স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে মন না থাকলেও আমার প্রকৃতিতে জ্ঞানের ক্ষুধা সাধারণের চাইতে অনেক বেশি প্রবল। স্কুলের কাছেই তাঁর বাসস্থান, সেখানে আমাকে অনেকদিন স্কুলের পরে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, পড়বার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বেঁছে একটি একটি করে বই দিতেন, শর্ত ছিল বইটি পড়ে আমাকে বইটির বিষয় এবং সে সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া ফুলস্ক্যাপ কাগজের এক পৃষ্ঠার মত লিখে তাঁকে দেখাতে হবে। সৎ সাহিত্য কীভাবে পড়তে এবং আত্মস্থ করতে হয় সে শিক্ষা তাঁর কাছেই প্রথম পাই। অলিন্দ্র চক্রবর্তী নিজে ইসাডোরা ডানকানের আত্মজীবনীর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। আমার বয়স যখন সম্ভবত তেরো কি চৌদ্দ, তিনি আমার কাছে খুলে দিলেন ইবসেন, ইয়োহান বোইয়ের, তুর্গেনিভের জগৎ। পাশে ইংরেজি-বাংলা অভিধান রেখে রাতের বেলা পড়ি। তারিফ করি পুতুলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসা নোরা হেল্মারকে, ভাবি আমাদের দেয়ালঘেরা পুরুষশাসিত সমাজে নোরাদের সামনে আত্মসম্মান বজায় রেখে বাঁচবার কোন্ পথ খোলা আছে। পিতার পাপ কী ভাবে পুত্রে বর্তায়, লম্পট আলভিং-এর গোপন যৌনব্যধি শিল্পী সন্তান অস্্ভাল্্ড্কে উত্তরাধিকার সূত্রে কীভাবে জীর্ণ করে মতিবিভ্রংসের দিকে ঠেলে দেয় তার মর্মন্তুদ কাহিনী আমাকে মুহ্যমান করে, ভেবে পাই না মা কি শেষ পর্যন্ত ছেলের প্রাক্বিভ্রংশ নির্দেশ মেনে তাকে সত্যিই মর্ফিন দেবেন। নিহিলিস্ট বাজারভের কথাবার্তা, আচার-আচরণ মনে ধাক্কা দেয়, আকর্ষণ-বিকর্ষণ দুই-ই বোধ করি, মনস্থির করতে পারি না দুই প্রজন্মের সংঘাতে আমার সহানুভূতি কোন দিকে। অপরপক্ষে দুর্বলচিত্ত বিপ্লবী নেঝ্্দানভের আত্মহত্যায় চোখের জল ফেলি, আভাস পাই সমাজের রূপান্তর কত কঠিন কাজ। এইভাবে কীটস্্, শেলি এবং বায়রণের পাশাপাশি ইবসেন, তুর্গেনিভ হয়ে উঠলেন আমার ঘনিষ্ঠ জন। যেমন সৌন্দর্যের তেমনই নৈতিক সামাজিক সমস্যার জগতে আমার ঘোরাফেরা সহজতর হয়ে উঠল।
বস্তুত আমার মানস বিকাশে স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় বা শিক্ষকদের চাইতে গ্রন্থাগারদের ভূমিকা অনেক বড়। রামমালা পাঠাগারে তার সূচনা, তারপর সে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী, শান্তিনিকেতন, আরো পরে বিলেতের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ইন্ডিয়া অফিস, বোডলিয়ান; পারীর বিবলিওতেক্্; ওয়াশিংটনে লাইব্রেরি অব দ কংগ্রেস, স্ট্যানফোর্ডে হুভার ইন্সটিটিউট, নিউইয়র্কে পাবলিক লাইব্রেরি; মেক্সিকোর হেমেরোটিকা নাসিওনাল; কোপেনহাগেন, স্টকহোম, আমস্টারডাম, ফ্রাঙ্কফোর্ট, জুরিখ, ক্যানব্রা, মেলবোর্ন কত মহাতীর্থেই না পুণ্যসলিল পান করে মন পুষ্ট ও পবিত্র হয়েছে। ঘোর নাস্তিকেরও সংসারে তীর্থস্থানের অভাব নেইএ সেই সব তীর্থে কোনো দেবতা বা পুরোহিতকে ঘুষ দিতে হয় না, শুধু লাগে জ্ঞানের ক্ষুধা, গ্রহণের সামর্থ্য।
বয়ঃসন্ধির সূচনা থেকে নিজের ভিতরেও নানা অন্ধকার প্রবণতার সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করতে হচ্ছিল। ঋষিকল্প পিতার আদর্শ সামনে থাকা সত্ত্বেও অন্তত নিজের কাছে স্বীকার না করে উপায় ছিল না যে আমার মা যে ষড়রিপুর কথা বারবারই বলতেন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য তারা প্রত্যেকেই আমার ভিতরে বিদ্যমান, এবং মনকে আলোকমুখী করবার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বশে আনা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অপর পক্ষে চারপাশে বিস্তর স্ত্রীপুরুষ দেখছিলাম এবং ঘটনা ঘটছিল, তারাও তমসানিমগ্ন। মানুষের অন্তর্লোক এবং পারস্পরিক সম্পর্কের যে পরিচয় আধুনিক সাহিত্যের অনেক দিক্্পালই উদ্্ঘাটিত করছিলেন সেখানেও আশ^াস ছিল না। শেলি, ব্রাউনিং, হুইটম্যানের পরে যখন পড়লাম বোদল্যের এর ফ্লর দু মাল, এলিয়টের দ ওয়েস্টল্যান্ড; ডিকেন্স, উগো, তুর্গেনিভের পরে ফক্নার, কাফ্্কা, লাগার্কভিস্ট্্ (দ্য হ্যাংম্যান, ইভিল টেল্্স); বার্নাড শ-এর পরে ও’নীল চাঁদের অন্ধকার পিছন দিকটি, যা আমাদের মধ্যেই আছে, তার ছবি চেতনাকে আলোড়িত করে তুলল। সেই দুস্থিত, কুটাভাসবিমথিত, প্রশ্নার্ত মনে প্রবেশ করলেন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্ক্স। প্রথম জন উদ্্ঘাটিত করলেন অন্ধকার অবদমিত নির্জ্ঞানের জগৎ; আর সমাজসংস্কৃতির উপর-কাঠামোর অন্তরালে যে দ্বন্দ্ব সংঘাত আর উল্লম্ব শক্তির প্রেষ বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটালেন দ্বিতীয় মনীষী। গোয়েটের মত মার্কস-কে নিয়েও আমার বিভিন্ন গ্রন্থে এবং প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে যদি পর্বে পর্বে আমার অন্বেষার কাহিনী লিখে উঠতে পারি তবে নীটশের মত ফ্রয়েডও সে কাহিনীতে বিশেষ স্থান পাবেন।
চলবে...