ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
Published : Wednesday, 21 September, 2022 at 12:00 AM
জীবনবোধ ও জীবনদর্শনজুলফিকার নিউটন ||
পূর্ব প্রকাশের পর
৩০
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হবার কিছু পরেই আবিষ্কার করি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি অক্ষয় ভাণ্ডার। পকেট ভরতি খোসাসুদ্ধ চিনেবাদাম নিয়ে সোহরাওয়াদী হল থেকে হেঁটে আসি। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেকখনো পড়েননি তাঁদের পক্ষে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য মননের কী অমেয় স্বর্লোক এখানে রয়েছে। বৃত্তাকার সেই মহাকায় রোটান্ডায় নীচ থেকে সিলিং পর্যন্ত খোলা তাকের পরে তাকে সহস্র সহস্র মহামূল্যবান গ্রন্থরাজির সমাবেশ অপেক্ষা করে আছে আগ্রহী পাঠককে স্বাগত করবার জন্য। সেই অমৃতলোকের ঘরের মাঝখানে সারি সারি টেবিল, বসে পড়বার ব্যবস্থা। মনে পড়ে না খোলা তাক থেকে বই বেছে নিয়ে পড়া এবং নোট নেওয়ার পথে কোনো বিরক্তিকর বাধা নিষেধ ছিল। একমাত্র শর্ত, তাকের যেখান থেকে বই পেড়ে নেওয়া হয়েছে পড়ার শেষে সেখানটিতেই বইটি রেখে আসা। সঠিক স্থানে প্রত্যর্পিত না হলে সেই বিরাট বিচিত্র জগতে তাকে আবার খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব। তা সত্ত্বেও অনেক পাঠক টেবিলের ওপরেই বই রেখে চলে যেতেন। পাঠাগারের কর্মীরা যথাস্থানে সযত্নে তাদের তুলে রাখতেন। সেকালেও হয়তো কিছু বইচোর ছিল, কিন্তু সেজন্য পুরো পাঠক সমাজকে কেউ আসামি সাব্যস্ত করেনি। এমন আশ্চর্য অমৃতলোকে এত সহজেই স্বচ্ছন্দ বিচরণের ছাড়পত্র মেলা সম্ভব স্বপ্নেও পূর্বে তা অকল্পনীয় ছিল। আর্থিক অনটন, সাংসারিক নিরাপত্তাহীনতা, বিশ^ব্যাপী বিপর্যয় কোনো কিছুই এই সৌভাগ্যের জন্য আমার কৃতজ্ঞতাবোধকে দুর্বল করতে পারেনি। ক্লাসের অধিকাংশ বক্তৃতাতে আমি এমন কিছু পেতাম না যা সংগ্রহনা করতে পারলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান। প্রক্সির ব্যবস্থা করে প্রায়ই চলে যেতাম সেই অমিতবিত্ত গ্রন্থাগারে যেখানে অসংখ্য মহামনীষী আত্মীয় স্মিতহাস্যে আমারই জন্য প্রতীক্ষারত। প্রধান গ্রন্থাগারিক জনাব শামসুল আলমের শেখানো অভ্যাসটি তখনো ত্যাগ করিনি। ফলে খাতার পর খাতা পেন্সিলে লেখা খুদে খুদে অক্ষরে বিচিত্র নোটে ভরে উঠত। এখন আমার কাছে কাগজ-কলমের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বড় হরফে যে লিখতে পারি না, তার কারণ প্রথম যৌবনে খাতা পেন্সিলের সেই আকিঞ্চন। অনুবীক্ষণিক হরফে লিখতে শিখি, কারণ বেশি পৃষ্ঠার খাতা কেনবার পয়সা কোথায়?
কলেজে ছাত্রাবস্থায় কবছরে ভিক্টরিয়া কলেজ পাঠাগারে কত অসামান্য ভাবুক, কত আশ্চর্য গ্রন্থের সঙ্গেই না পরিচয় হয়। ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’, নিট্শের ‘দ বার্থ অব ট্র্যাজেডি’, দাস্্ ‘স্পেক জরথুস্ট্র’, ‘বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল’, ম্যাক্স হ্বোর-এর ‘দ প্রটেস্ট্যান্ট এথিক অ্যান্ড দ স্পিরিট অব্্ ক্যাপিট্যালিজ্ম্্’, হার্ডারের ‘রিফ্লেকশ্যন্্স্্ অন দি ফিলসফি অব্্ হিস্টরি অব্্ ম্যানকাইন্ড’, বুর্কহার্ট-এর ‘দ্য সিভিলাইজেশন অব্্ দ রেনেসাঁস’, বেরির ‘দ আইডিয়া অব্্ প্রগ্রেস’, শোপেনহাউয়ার-এর ‘দ ওয়ার্লড্্ অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়া’, বের্গসঁর ‘ক্রিয়েটিভ ইভলিউশ্যন’, স্পেংলার-এর ‘দ ডিক্লাইন অব দ ওয়েস্ট’, ওয়েল্্স্্-এর ‘আউটলাইন অব্্ হিস্টরি’, সান্টায়ানার ‘স্কেপ্টিসিজ্ম্্ অ্যান্ড অ্যানিম্যান ফেইথ’, কেইনস্্-এর ‘দ ইকনমিক কন্সিকোয়েন্সেস অব্্ পিস্্’, উইলিয়ম জেনস্্-এর‘দ উইল টু বিলিভ’ এবং ‘প্র্যাগ্ম্যাটিজ্ম্্’। যেসব বীজগ্রন্থ থেকে বিস্তর নোট্্স নিয়েছিলাম তাদের ভিতরে কয়েকটির মাত্র উল্লেখ করছি। এইসব বইসেই প্রথম যৌবনের কালে নানা রকমের প্রশ্ন জাগিয়ে, নানা রকমের পরস্পরবিরোধী উত্তরের ইঙ্গিত দিয়ে আমার মনের বিকাশে সহায়তা করেছিল।
এই সময়েই আমি প্রথমে ফরাসি এবং পরে জার্মান ভাষা চর্চা শুরু করি। এসব ভাষায় আলাপ করতে শেখা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, আমি চাইছিলাম অভিধানের সাহায্যে মূল রচনার স্বাদ গ্রহণের কিছুটা সামর্থ্য অর্জন করতে। পরে যখন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সহধর্মিণী মেহের কবীরের সঙ্গে আমার সুহৃদ্্ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখন আরো অনেক বিদ্যার মতো ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি আমার প্রধান সহায়ক হন। তাঁর কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। ভিক্টরিয়া কলেজ পাঠাগারে পাঠচর্চার সময়েই আমার মনে বিশ^সাহিত্য বিষয়ে ধারণা অনেকটা স্পষ্টতা এবং জ্ঞান বেশ খানিকটা পুষ্টি অর্জন করে। বালজাক, হুগো, জোলা, ফ্লবেয়ার, প্রুস্ত; পুশ্কিন, গোগোল, তুর্গেনিভ, ডস্টয়েভস্কি, টলস্টয়; হামসুন, সেলমা লাগারলোয়েফ, উনড্সেট, লাগার্কভিস্ট; টমাস মান, ফ্রানৎজ কাফ্্কা, হের্মান হেসে, কনরাড, জয়েস, লরেন্স, ভার্জিনিয়া উলফ্্, ফক্নার উপন্যাসের জগৎ যে কত বিচিত্র, মানুষের মন যে কত জটিল, আর ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি পরিবেশের সম্পর্ক যে একই সঙ্গে কত নিয়ন্ত্রিত, অসমৃণ আর ভঙ্গুর, এঁদের উপন্যাসই তো আমার অনভিজ্ঞ দৃষ্টির সামনে তা অনেকটা উন্মোচিত করেছিল। বিভিন্ন নাটকের সূত্রে এখানেই আমার সঙ্গী হন মেটারলিঙ্ক, র্গ্হাের্ট হাউপ্টমান, স্ট্রিন্ড্বার্গ, চেকভ, পিরান্দেল্লো, ও’কেসি, ও’নীল। আর অবচেতনার অন্ধকার আলোড়িত করে চেতনার একটির পর একটি দিগন্ত উন্মোচিত করে, পিপাসু মনকে নবরসে প্রসাদিত করে দেখা দিলেন মানুষী অমরতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রূপে একটির পর একটি নক্ষত্রপ্রতিম কবি ইয়েটস, হপকিন্স, পাউন্ড এবং এলিয়ট; গোয়েট, হাইনে, স্টেফান, গেয়র্গ, রিলকে; বোদল্যের, মালার্মে, র্যাঁবো, ভালেরি, প্যার্স, এলুয়ার; ব্লক, মায়াকোভ্স্কি, ইয়েসেনিন; লোরকা। আমার তরুণ বয়সে এবং তারপরও বার বার অনেক পরিচিত জন আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আচ্ছা, তুমি মানুষজন সমাজ সংসারের এত ওঠাপড়ার চাইতে নিরক্ত বইয়ের জগতে এমন কী পাও যা তোমাকে নিবিষ্ট করে রাখে? আর কী করেই বা তুমি এমন সংসারবিমুখ ছন্নছাড়া বোনা প্রকৃতির হলে? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষাকৃত সহজ। বইয়ের দেওয়াল ঘেরা জগতে আমার বাবার তন্ময় রূপ শিশু বয়স থেকেই আমার চেতনায় উৎকীর্ণ হয়ে যায়; এবং চিন্তায় এবং জীবনযাত্রায় আমি তাঁর থেকে ভিন্নপথে চলে গেলেও ওই আদল আমার নির্মীয়মাণ অস্মিতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তবে আমি সংসারবিমুখ এ অভিযোগ সত্য নয়। আমি যে কোনো বই হাতে এলেই যেমন পড়ি না, পড়তে পারি না, পাতা উলটে যদি বুঝি পড়ার উপযুক্ত তবেই অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করি, তেমনি যেকোনো মানুষ, যেকোনো ব্যাপারেই সময় দিতে আমার অনীহা যদি না তার সান্নিধ্যে আমার মনে ঝঙ্কার ওঠে। আমজনতার সঙ্গ, অথবা রক্তের বিবাহের, বা কর্মস্থলের সূত্রে যাদের সঙ্গে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাদের সঙ্গ আমি সাধ্যমতো এড়িয়ে চলি বটে, কিন্তু আমার জীবনে বন্ধুর কখনো অভাব ঘটেনি, সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশেও সহজে যথার্থ সুহৃদ্্ খুঁজে পেয়েছি। অসামাজিক বলে দুর্নাম থাকলেও আমি সম্পর্কবিমুখ নিঃসঙ্গ মানুষ নই। তাছাড়া শুধু বই নয়, আনন্দের আরো অনেক উৎসই আমার জীবনকে সরস করেছে। বন্ধুত্ব, প্রেম, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, অন্ধকার রাত্রের নক্ষত্রখচিত আকাশ, বিভিন্ন ঋতুতে গাছে গাছে শিউলি, চাঁপা, বকুলের সুরভিত ফুটে ওঠা, নদীর কলধ্বনি, বর্ষণস্নাত মাটির সোঁদা গন্ধআর্থিক দারিদ্র্যের ভিতরে বড় হওয়া সত্ত্বেও এ সবই আমাকে আকিঞ্চন, যূথচারিতা, পৈশুণ্য, নির্বেদ এবং হীনম্মন্যতা থেকে চিরকাল রক্ষা করেছে।
আর বইয়ের জগৎ? অল্পবয়স থেকেই আমার মনে নানা প্রশ্নের পর প্রশ্ন আমাকে পরম্পরা-নিয়ন্ত্রিত হতে দেয়নি। ন্যায়-অন্যায় কীভাবে নির্ণয় করা যায়? গুরুজনেরা যা বলেন কেন আমি অনেক ক্ষেত্রেই তা মেনে নিতে পারি না? আমি কি অন্যদের তুলনায় উদ্ভট? আমার মধ্যেই এত সব বিপরীত প্রবণতা কেন?আমার সঙ্গে পরিবারের এবং সমাজের কী সম্পর্ক?সংসারে যা কিছু ঘটে তার ভিতরে কি কার্যকারণ সম্পর্ক আছে? ইতিহাসে যে সব ঘটনাক্রমের কথা থাকে তারা কি কোনো নির্দিষ্ট ধারায় কোনো বিশেষ দিকে বহমান? জ্ঞানে কীভাবে নির্ভরযোগ্যতা আসে?যা কাল্পনিক তা কি একেবারেই মিথ্যা? আমার জীবন কীভাবে গড়ে তোলা সঙ্গত? নিজের ভিতরে এবং চারপাশে যা কিছু আমাকে পীড়া দেয়ভয়, ঈর্ষা, লোভ, গরিবের ওপরে বড়লোকের, দুর্বলের ওপরে সবলের অত্যাচার, এ সব থেকে কী করে আপনাকে এবং সমাজকে মুক্ত করা যায়? মানুষ মরে যাবার পর কি আত্মা বলে কিছু থাকে না! মৃত্যুতেই কি জীবনের পরিসমাপ্তি? পৃথিবীতে কি এমন কিছু আছে যা ভঙ্গুর, অপূর্ণ, ত্রুটিদুষ্ট নয়? গাছপালার প্রাণ আছে বুঝতে পারি, কিন্তু মানুষদের মতো বুদ্ধিও কি তাদের আছে? সূর্য চন্দ্র তারা এরা কি নি®প্রাণ? আমরা মানুষরা এলাম কোথা থেকে? জন্ম থেকেই কেউ লম্বা কেউ বেঁটে কেউ চালাক কেউ বোকা, কেউ ফরশা কেউ কালো, কেউ গরিব কেউ বড় লোক, কেউ বলশালী কেউ দুর্বল, কী করে হয়? মানুষে মানুষে অসাম্যের আদি কারণ কি? কাকে মনুষ্যত্ব বলে?
বই যখন পড়ি এসব প্রশ্ন মনে তীক্ষèতর হয়, বিভিন্ন ভাবুক নানা সম্ভাব্য উত্তরের কথা বলেন তারা হয়ে ওঠেন আমার শিক্ষক এবং সঙ্গী। আবার যখন গল্প-উপন্যাস-নাটক পড়ি কত প্রকৃতির স্ত্রীপুরুষেই না আমার মনের জগৎ ভরে যায়, চারপাশে যাদের দেখি তাদের চাইতে এই সব স্ত্রী-পুরুষ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, এদের সমস্যা সংকটের টানাপোড়েনে আমার চেতনাতেও বুননির কাজ চলতে থাকে। মনুষ্যত্ব নামে যে ঝাপসা শব্দটির সঙ্গে বালক বয়স থেকেই আমি পরিচিত তার অন্ধকার মর্মস্থলে কী সব বৃত্তি আর ক্রিয়াকলাপ চলে তার চেহারাটা ক্রমে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। রুদ্ধবাক্্ অসহায়তায় মহাবীর নিগ্রো নায়ক ওথেলোর বিপর্যয় দেখি, আনা কারেনিনার জন্য গভীর বেদনা অনুভব করি, প্রমিথিউসের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই অত্যাচারীর কাছে মাথা কখনো নত করব না, গৃহত্যাগিনী নোরাকে বলি, বোন তুমি একা নও, আমি তোমার সঙ্গে আছি, বুঝতে চেষ্টা করি তরুণ শিল্পী স্টিফেনের সামনে কেন মৌনব্রত, চতুরালি বা নির্বাসন ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। আর শিশু বয়সে শেষরাত্রের আলো-আঁধারিতে অবোধ্য ঋক্মন্ত্র চেতনায় যে গূঢ় রহস্যময় আনন্দের সঞ্চার করেছিল তাই সম্পন্নতর বৈচিত্র্যে বিকশিত হয়ে ওঠে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতায়। সে আনন্দ স্বাদে যারা বঞ্চিত কাব্যপাঠের অনন্য গুরুত্ব সম্পর্কে আমার কোনো কথাই তাদের গ্রহণীয় ঠেকবে না।
সে যাইহোক, যে তিনজন ভিনদেশী ভাবুক রামমালা পাঠাগারের সেই তরুণ পাঠকটির মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁরা হলেন যথাক্রমে বার্ট্রান্ড রাসেল, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও কার্ল মার্কস। তিন জনই অনন্যতন্ত্র, তিনজনের মনন আপন আপন বিশিষ্ট ধারায় প্রবহমান, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল (এবং এখনো মনে হয়) তিনজনই মেজাজের দিক থেকে র‌্যাডিক্যাল, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা রীতিনীতির গোড়া ধরে ধাক্কা দিয়েছেন, মানবজীবনের স্বরূপ নিয়ে নতুন করে অনুসন্ধানের অ্যাডভেঞ্চারে আমাদের যোগ দিতে ডেকেছেন। প্রচলিত ধ্যানধারণা, আচার-অনুষ্ঠান সমাজ সম্পর্কে আমার অবস্থা বেশ কিছুকাল ধরেই ক্ষয় পেয়ে আসছিল। এই তিন চিন্তকের মানস সান্নিধ্যে এসে নিতান্ত তরুণ বয়সেই আমি চিন্তায় এবং জীবনযাত্রায় র‌্যাডিক্যাল হয়ে উঠি।
বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাবনাচিন্তা শুধু নয়, তাঁর জীবনকাহিনী সম্পর্কে যতটুকু সে সময়ে পড়েছিলাম তাও আমাকে সবিশেষ আকৃষ্ট করেছিল। অভিজাত ঘরের সন্তান কিন্তু জীবনের বেশিটা সময়ই তাঁকে পরিশ্রম করে অর্থোপার্জন করতে হয়েছে। দাদার মৃত্যুর পর যখন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে আর্ল রাসেল হন তখনো দাদার রেখে যাওয়া দায়দায়িত্ব ধারদেনার চাপ জমিদারির আয়ের চাইতে বেশি। এদিকে দরাজদিলের মানুষ হওয়ার ফলে নিজের যা উপার্জন এবং সঞ্চয় তার অনেকটাই ব্যয় হত বন্ধুবান্ধব এবং স্নেহভাজন মানুষদের প্রয়োজন মেটাতেদার্শনিক সহকর্মী হোয়াইটহেড, কবি এলিয়ট, ঔপন্যাসিক লরেন্স, অনেকেই সংকটকালে রাসেলের কাছ থেকে নানাভাবে সহায়তা পেয়েছেন। নিজের ভাবনাচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনো রফা করেননি, বিশ^াস অনুযায়ী বাঁচবার চেষ্টা করেছেন, তার জন্য বারবার তাঁর ক্ষতি হয়েছে, চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, বিত্তবান পৃষ্ঠপোষক চুক্তিভঙ্গ করেছে, এমনকী প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য জেল খেটেছেন আর কারাগারে বসে লিখেছেন ‘ইন্ট্রোডাক্্শন টু ম্যাথাম্যাটিক্যাল ফিলজফি’। আমাদের যুগের দার্শনিক বটে, কিন্তু চরিত্রে এবং চিন্তায় অনেকটা আঠারো শতকের ইউরোপীয় র‌্যাডিক্যালদের উত্তরসাধক।
বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন বারবার বাঁক নিয়েছে। বেঁচেছিলেন আটানব্বই বছর, বিস্তর লিখেছেন, চিন্তায় অনেকবার অদল-বদল ঘটেছে। আশি বছর বয়সে এডিথ ফিন্্চ্্-কে বিয়ে করেন, পুরোধা হন পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনে, অহিংস অসহযোগে সক্রিয় নেতৃত্ব দেবার অপরাধে স্বামী এবং স্ত্রীর দুমাস কারাদণ্ডের আদেশ হয়, কর্তৃপক্ষ তাঁদের স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করে দুমাস জেলে রাখার বদলে এক সপ্তাহ জেলের হাসপাতালে তাঁকে আটক রাখে। আমার মুক্তচিন্তা ও মুক্তসমাজ গ্রন্থে রাসেলের দর্শন বিষয়ে আলোচনা আছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের সংশয়বাদ, সুখবাদ, বিশ^নাগরিকতা ও বিকেন্দ্রন তত্ত্ব, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মুক্ত সম্পর্কের সমর্থন, লোকমত, পরম্পরা, ধর্মগ্রন্থ বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশের চাইতে ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, যুক্তি এবং স্বভাবজ বৃত্তিকে পূর্বিতা দেবার প্রতিন্যাস প্রথম যৌবনে আমাকে বিশেষ প্রভাবিত করে এবং এই প্রভাবের অনেকটাই এ তাবৎ বজায় আছে। তবে তাঁর লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময় থেকেই অনুভব করেছিলাম রাসেলের চিন্তায় মানব অস্তিত্বের এমন কিছু দিক উপেক্ষিত যাদের বাদ দিলে জীবন অবোধ্য থেকে যায়। নিজের সেই অল্প বয়সের অভিজ্ঞতা থেকেই এই বোধ জন্ম নিয়েছিল, সাহিত্য-চর্চার ফলে এটি তীক্ষèতর হয়। জীবনের মধ্যে যে প্রগাঢ় ও প্রবল অন্ধকার শক্তি সক্রিয়, আলোকের জন্য মানুষের সাধনাকে যা আদিকাল থেকেই ব্যাহত করে আসছে, অথচ যা আছে বলেই আলোকে উত্তরণকে আমরা এতটা মূল্য দিই, আমার মনে হয় রাসেলের বীক্ষণে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। এই অন্ধকারের উপস্থিতি বাইরের প্রকৃতি পরিবেশে এবং সমাজ-সভ্যতায় প্রত্যক্ষ, কিন্তু মানুষের ভিতরে এটির দুরবগাহ বিদ্যমানতা শুধু দুরপনেয় নয়, হয়তো একবারেই অনপনেয়।
চলবে...