প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেছেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড়
বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পক্ষে আর কোনও লোক নেওয়া সম্ভব নয়, তাদের
অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সম্প্রচার হওয়া ওয়াশিংটনে
ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা সার্ভিসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা
বলেন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের কাছে বারবার বাংলাদেশের আহ্বানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত
বিশাল জনসংখ্যার (সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রায়) দায়িত্ব একা একটি দেশের
পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। শুধু আশ্রয় দেওয়াই নয়, এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য
জীবিকার ব্যবস্থা করাও একটি বড় দায়িত্ব, যা কোনও দেশ একা বহন করতে পারে না।
তিনি
উল্লেখ করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এবং
চলমান কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয়
জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে, যা বিশ্ববাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে।
তিনি বলেন, “যারা (রোহিঙ্গাদের) সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল (স্থানীয়
জনগণ), তারা এখন নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য কতটা আর করতে পারে, কারণ এর বিশাল জনসংখ্যা এবং
দেশটিকে তার জনগণের কথাও ভাবতে হবে”। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা
জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোররা এখন ঘিঞ্জি বস্তিতে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) লালিত-পালিত
হয়ে বড় হচ্ছে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও সুস্থতার সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ
খুবই সীমিত।
বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আর কোনও লোক নেওয়ার অবস্থানে নেই
উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান
কক্সবাজারের বন ধ্বংস করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্টের পাশাপাশি বিপুল
সংখ্যক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের চরম দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে এবং এলাকার আবাদি
জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গা মানবপাচারের
পাশাপাশি মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে এবং ক্যাম্পের অভ্যন্তরে
তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয়
দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সময় হত্যা ও ধর্ষণসহ অমানবিক
নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
কাজেই আজকে তারা (বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা) যখন একই ধরনের নির্যাতনের শিকার,
সে কথা চিন্তা করেই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা নিজের চোখে (১৯৭১ সালে) সেই দুর্ভোগ দেখেছি।’
এ
প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি বাংলাদেশির পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষের
(রোহিঙ্গাদের) দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার ছোট বোন শেখ রেহানার আবেদনের কথাও
স্মরণ করেন।
শেখ রেহানাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘আপনি ১৬ কোটি লোককে
খাওয়াতে পারেন, আর কয়েক লাখ লোককে খাওয়াতে পারবেন না?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন,
তিনি ইতিবাচক জবাবে বলেছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা একবেলা খাবার খেয়ে
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরেক বেলার খাবার ভাগ করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি জনগণ,
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রচুর খাবার নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে
দাঁড়িয়েছে, যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের
সাহায্য করতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে
যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। এ সফরে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম
অধিবেশনে ভাষণ দেওয়াসহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের
স্থানীয় সময় শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারটি নেয়
ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ।
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট
ছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নানা অভিযোগ, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ডিজিটাল
সিকিউরিটি অ্যাক্ট, মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পথে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ,
গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ তার সরকারের নেওয়া নানা কল্যাণমুখী নীতি ও
কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী,
ট্রান্সজেন্ডারদের কল্যাণে নেওয়া নানা পদক্ষেপ, জিয়া-এরশাদ আমলের সামরিক
শাসন, আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।
এছাড়াও
বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দাদের গোপন রিপোর্ট-এর ওপর
ভিত্তি করে প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টস বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার
প্রেক্ষাপট নিয়েও তিনি কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা পরিস্থিতি,
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ
কীভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে
প্রধানমন্ত্রী তার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেন।
ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া।