গোলাম কবির ||
সাধারণ বিবেচনায় বয়োবৃদ্ধির একটা
পর্যায়কে বার্ধক্য বলা হয়। অনেকে গাণিতিক হিসাব না মিলিয়ে মানসিক চেতনার
হিসাব দেখিয়ে বার্ধক্য নির্ণয় করতে চান। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সবখানেই আছে।
কাজী নজরুল ইসলাম মানসিক বিক্ষেপের আলোকে তারুণ্যের সীমারেখা টেনেছেন।
বয়সের
তুলাদণ্ডে বার্ধক্যের নির্ণয় করতে চাননি। আবার তিনিই জানিয়েছেন, ‘পরজনমে
যদি আসি এ ধরায়, ক্ষণিক বসন্ত যেন না ফুরায়। ’ সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা
জানিয়ে আমরা বলতে চাই, বয়সের মূল নির্ণায়ক অবশ্যই বার্ধক্য।
প্রাকৃতিকভাবে
মানব-অঙ্গের সব কিছুই ক্রমহ্রাসমানতার দখলে চলে যায়। মানুষ তখন কর্মক্ষম
থাকে না। অসহায় হয়ে পড়ে। এই অসহায়ত্ব ধনী-নির্ধন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এখান থেকেই বিড়ম্বনার সূত্রপাত।
আমরা মধ্যবিত্ত মানসিকতার তথাকথিত
শিক্ষিত মানুষ-প্রবল সুখসন্ধানী। সুখ কিসে, তা নিয়ে প্রচুর দার্শনিক চেতনার
সন্ধান মেলে সাহিত্যে-দর্শনে। অবশ্য ধর্মে ঐহজাগতিক সুখকে প্রাধান্য দেওয়া
হয়নি। আমরা এসবের কোনোটা নিয়ে বিতর্কে যাব না। তাই বলে ভাবনা আমাদের
আক্রান্ত করবে না, তা নয়।
দরিদ্র বা অতিদরিদ্র মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে
পরিবারে-সমাজে অনেকটা আবর্জনার বস্তু হয়ে পড়ে, যা সরানো কঠিন হয়ে যায়।
ভুক্তভোগী বোঝে, কিন্তু বোঝানোর ভাষা সে হারিয়ে ফেলে। এ যেন ‘হৃদয় ভরিয়া
কথার কাকলি কেহ নাই শুনিবার। ’ অনাদিকাল ধরে চলে আসছে এই অবস্থা।
সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের নানা চিন্তকের আবির্ভাব হয়েছে যুগে যুগে। কখনো
ধর্মের লেবাসে, কখনো আবার সমাজবিজ্ঞানের আলোকে। ফলে উন্নত দেশগুলোতে
বার্ধক্যজনিত অক্ষম মানুষের আংশিক দুর্ভাবনা কেটেছে।
আমরা
বক্তৃতা-বিবৃতিতে উন্নত দেশ হতে চলেছি। সেটা শতকরা কত ভাগ মানুষের দেখার
সুযোগ হবে, তার হদিস রাখি না। আমরা হতদরিদ্ররা সরকারের সহায়তা পাই, তার
কিছু অংশ অনেক সময় প্রায় পুরোটাই মধ্যস্বত্বভোগীদের ‘বেগমবাড়ি’ গড়ার সুযোগে
আসে। যত বিড়ম্বনা মধ্যবিত্তের। তারা সাহায্য-সহযোগিতা পায় না বললেই চলে।
আবার নিজের বিড়ম্বিত জীবনের বেদনার ভাষা হারিয়ে ফেলে। ফলে রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় ‘দীর্ঘ জীবন, দীর্ঘ অভিশাপ’-এ রূপান্তরিত হয়।
কল্পিত স্বর্গ কখনো
বাস্তব ধরায় এসে ধরা দেয়নি, আর দেবেও না। কেবল আত্মশ্লাঘার বীজ হয়েই
মানুষকে মরীচিকায় ধাবিত করতে থাকবে। প্রত্যেক মানুষ চায় স্বাচ্ছন্দ্যে
থাকতে। সেখানে বাধা এলে সব প্রেম, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ নিষ্ক্রিয়
হয়ে যায়।
কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে, বসবাসের স্থান সংকুলানের অভাবে
একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে শুরু করে। এর সঙ্গে মানবভাবনাবর্জিত
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই রোগ যেন
অবিচ্ছিন্ন। ওই যে বলা হয়, স্নেহের ধর্ম অধোগামী। প্রাণী তথা মনুষ্য প্রাণী
তার সন্তান-সন্ততির জন্য প্রাণপাত করে। অনেক সময় জনক-জননী অন্তরালে রয়ে
যায়। মানসিক বিড়ম্বনার সূত্রপাত এখানেই। এমন ঘটনা আবহমান। এই বিড়ম্বিত
বিষয়টি যত কম প্রাধান্য পাবে, ততই মঙ্গল।
যাঁরা বয়োবৃদ্ধ, হয়তো আফসোস
করেন, মা-বাবার জন্য কিছুই করতে পারেননি। কেউ আর্থিক অনটনের জন্য, কেউ আবার
পারিপার্শ্বিক চাপে। এতে বিড়ম্বিত ব্যক্তির অন্তিমযাত্রার বিড়ম্বনা বহুগুণ
বৃদ্ধি পায়। এ যন্ত্রণা থেকে সহজ মুক্তির দিগন্ত নেই। আছে অন্তিমযাত্রা।
বার্ধক্যের
বিড়ম্বনার জন্য আমরা বয়োবৃদ্ধিকে প্রধান চালক হিসেবে দেখতে পাই। ছেলেবেলায়
‘সারকাসি কা সামরাহ’ নামের একটা লেখা পড়েছিলাম। সেখানে মস্তিষ্কের
প্রাধান্যের দর্পকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মস্তিষ্ক নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবলেও
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল্য যে কম নয়, তার একটা প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করা
হয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেদিন এক মাসে বিদ্রোহ করল ক্ষমতা কতটুকু প্রলম্বিত!
এরও একটা পরিধি আছে। সেই ক্ষমতা অতিক্রান্ত হলেই শুরু হয় বিড়ম্বনার।
বার্ধক্য সেই বিড়ম্বনার দিশারি। আমরা কোথায় গিয়ে এখান থেকে মুক্তি পাব। যদি
হয়, তবে সৃষ্টির পসরা না থাকার কথা।
শোনা যায়, আদি মানুষ বয়স্কদের
ভোজনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর কষ্টের অবসান ঘটাত। এটা মানবিক না হলেও এক ধরনের
মুক্তি। তিল তিল করে জ্বলতে জ্বলতে জীবনীশক্তি নিঃশেষ না করে, একেবারে
মুক্তি! শুভবুদ্ধির নয়! আমরা সে বিতর্কে যাব না। দেখব বয়োবৃদ্ধির বিড়ম্বনার
রকমফের। একি কেবল অর্থনীতির সংঘাত, নাকি সভ্যতার অবিবেকী অভিশাপ। আমরা মনে
করি, সভ্যতার অশুভ দিকগুলো যদি সংযত হতো, তবে বিড়ম্বনার উনিশ-বিশ বিচার
করা হতো সহজ। আর সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায় মানুষ পরস্পরের পানে চেয়ে যে
সান্ত্বনা অনুভব করত, একদা তা নিয়েই চোখ মুদতে পারত। এতে কষ্ট ছিল, কিন্তু
আজকের মতো শারীরিক ও মানসিক বিড়ম্বনায় মধ্যবিত্তকে ফেরি করতে হতো না। শুনতে
হতো না অন্তঃসারশূন্য বোগাস বক্তব্য।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ