সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুমগ্ন কবিতাআরিফুল হাসান ।।
মৃত্যুকে
ক্রমাগত অস্বীকার করে ফুলের গন্ধের মতো থেকে যান সৈয়দ শামসুল হক। তবু
মৃত্যু তাঁকে ধরা দেয়। পৃথিবীর সব বন্ধন ত্যাগ করে ২০১৬ সালের ২৭ শে
সেপ্টেম্বর পাড়ি জমান অনন্তলোকে। গুপ্ত জীবন প্রকাশ্য মৃত্যুর মতো চেলেঞ্জ
ছুড়ে দেন স্থবির আবহমানতার পাথর দেয়ালে আর বলেনÑ ‘আমার যে মৃত্যুতেও মৃত্যু
নেই।’
শেষ ভাগের কবিতাগুলোতেও তিনি পরাক্রমশালী মৃত্যুবিরোধীÑ ‘ভুলে
যাও সন্ধ্যে বলে কিছু আছে/ একটি তারার ফুল অন্ধকার গাছে/ ভুলে যাও লকেটের
মতো চাঁদ/... সারারাত সারারাত/ তোমার হাতের দিকে একখানি হাত।’ এভাবেই
মৃত্যুমানের ছদ্মবেশের আড়ালে চিরন্তন জীবনের কথা বলেন, বলেন মৃত্যুমানে
যতিচিহ্ন নয়, এক অনন্ত ইনফিনিটি। কবি এবং কবিতার মৃত্যুর আপেক্ষিকতা নিয়ে
দ্বান্দ্বিকতার ভেতর পাঠককে ঠেলে দিয়েছেনÑ ‘কিন্তু যে কবিতা নামে কলমের
মুখে অগ্নিফুল/ শব্দ আর ধ্বনিতে শোনিতে যার সমুদ্রের রোল/ তারও কি বয়স
বাড়ে? কবিতারও হয় শাদ চুল? কীর্তনিয়া খোল?’ তবু দিনশেষে ভরা পালে চলে যায়
সময়ের নৌকো। বাঁকাজলের বেষ্টনির ভেতর নিঃসঙ্গতা আরও গাঢ় হলে বলতে হয়Ñ
‘লাইনে দাঁড়িয়ে আছি-/ নামধাম বিস্তারিত দরখাস্তে আছে।/ পাসপোর্ট চাই।’
জীবনকে
সর্বোচ্চ সত্যতায় নিয়ে যেতে আজন্ম ধ্বনিমগ্ন সৈয়দ হক শোনান বেঁচে থাকার
জয়গান। প্রাণের প্রফুল্লতায় জগতের আনন্দধামে একাকার হয়ে যাপনকে উদযাপনের
ঈঙ্গিত রাখেন বিপুল রচনাসম্ভারে। মানুষের জয়, মানবতার বিজয়সূচক রেখা
চিত্রিত হয় সাহিত্যের আকাশে। মন খারাপের ছুটি দিয়ে দেন নির্জন রেস্তোরায়
নিঃসঙ্গ দুপুরে। কিন্তু কী ক্লান্তি আয়ুকে অবসাদে টেনে নেয় মহাকালিন কালো
গহ্বরে আর সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেয় নির্দয় অবাস্তবতার ভেতর। এই দৃশ্য ও
পরমদৃশ্যের (বস্তুত অদৃশ্য) ভেতর এক অনিবার্য যুগসূত্র এঁকে দুটোকে করেছেন
সমান্তরাল। তাই গুপ্ত জীবন প্রকাশ্য মৃতুর মতো গুপ্ত মৃত্যু ও প্রকাশ্য
জীবনও হয়ে উঠে সমান সহচল।
‘কয়েকটি তাস’ কবিতায় ‘উপরে নদীর মতো দীর্ঘ
আকাশ’ দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়, ‘জানালায় রঙিন রুমাল নিয়ে’ ছেলেগুলোর
তাকিয়ে থাকা নিছক তাকিয়ে থাকা নয় আর শুকনো কপি নিয়ে বেড়ালের খেলা আসলে
ক্রীড়াচক্র নয়, অন্যকিছু। তাই তিনি বলেনÑ কিন্তু এই যাকে তুমি মৃত্যু বলো,/
আসলে তা মৃত্যুরই শেষ। জন্মের মুহুর্ত থেকে তারা ছুটে ও-আকাশে,/ দীর্ঘ এক
অবিরত দিন,’। তখন চঞ্চল হরিণির ক্ষুর আর যুদ্ধশ্রান্ত অশ্বের হ্রেসা
মিলেমিশে বনে ও জনপদে এক আকাক্সিক্ষত সত্যের মতো কাব্যবিভাব সৃষ্টি করে।
প্রতিটি দিন গুজরান তখন হয়ে উঠে নিরীক্ষণের এক্সরে আইস। তখন ফুল থেকে মধু
আর ভ্রমরার গুঞ্জরণে কাব্যউদ্যান হেসে উঠলে অন্যপৃষ্ঠায় জীবনের এক পরিপাঠ
খেলা করে। তাই অগ্রাহ্যের পরও মৃত্যু এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ত
নাছোড়বান্দা। আর এ জন্যই সৈয়দ হক চলে যাওয়াতেও রেখে যান থেকে যাওয়ার বৈভবÑ
‘কিন্তু আমরা সৃষ্টি করি আমাদের মৃত্যুকে/ আর জীবনকে ফেলে রাখি ছুরির মতো
বিপদজনক বাতাসে।’
সময়ের খেলাঘরে একসময় সবকিছু ভেঙেচুড়ে পড়ে। আর বাতাস
এসে উড়িয়ে যতসব পথের ধূলো। তখন আকাশ থেকে জমিনে কিংবা বায়ু থেকে মানুষের
শ্বাসে শুধু বিচরণ করে কবিতার অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। তাই জীবন মধুময়। তবে
কাঁটার আঘাত ছাড়া কি পুষ্পের প্রকৃত গন্ধ পাওয়া যায়? তাই কণ্টকিত
যাপনকাষ্ঠার ভেতর বরণ করে নিতে হয় জীবনের পরিভাষ্য। আর এ রপ্তকৃত নবভাষার
প্রয়োগেই আক্ষরিক অর্থে মানুষ মৃত্যুকে ভুলে থাকে। যেনো পালিয়ে বাঁচা, যেনো
অস্বীকার করে বেঁচে থাকা, যেনো মানুষের মৃত্যু নেই! তবু তো মৃত্যু আছে,
তাই সৈয়দ হক যখনই মৃত্যুকে আনেন প্রসঙ্গে, তখনই তাকে গভীর রেখায় করে তুলেন
দৃশ্যময় এবং দেন সলিল সমাধির এক নতুনতরো সংজ্ঞা। তাই কবিতা সংগ্রহের ‘কবিতা
২২৩’ এ তিনি বলেনÑ মৃত্যু শাদা পাখি/ জীবনের তৃণ দিয়ে আকাশকে ভরে।/ আর
কোটি কোটি মৃত্যু দিয়ে একজন/ গড়ে তুলে স্বর্গ কি নরকের ঘর।’
কিছু মৃত্যু
অন্তরে দাঁগ দাঁগ কাটে প্রবলভাবে, কিছু মৃত্যু চিত্রিত করে মর্শিয়া। মূলত
সকল প্রস্থানই বেদনার চোরাবিষ ঢেলে দেয় জীবন্ত মানুষের মর্মেÑ ‘একদা
যাচ্ছিলাম আত্মহত্যা করতে,/ হাতে এসে ঠেকল হার্টক্রেনের বই/ যখন বিষ নেবো
হাতে।/ যেনো বিষের অদৃশ্য হাত দিল বইটাকে ছুড়ে।/... পায়ের নীচে ভাঙা শার্সী
জানালার। কাফনের মতো শাদা মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে জোছ্না।’
এক জীবন
অফুরন্ত রচনাসম্ভারে তিনি মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলেন বহু অভিধায়।
ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দেখেন, দেখান অপার রহস্য। উদঘাটনের আনন্দে তাই মধ্য
রাতেও চাঁদ হেসে উঠে আর দুপুরের রোদে তপ্তশ্বাস, বিচুর্ণ বাতাস তখন আলগোছে
আলো হাতে এগিয়ে আসে। তখন জীবন সুন্দর হয়ে উঠে। হাসে ফুল-পাখি, লতাগুল্ম,
জলের মাছেরা ঢেউ খেলে চলে যায়। এভাবে অপরের অপর, এক মৃতু, এক বিভিষীকা
আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকে। আমরাও আনন্দযজ্ঞে মেতে চিরজীবিতের ছদ্মবেশে
মিশে। কিন্তু ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায় আকাশবীনার সাতসুরে। তাই মানুষের
অনিবার্য আনন্দের ভেতর অনিবার্য কান্নাও প্রাসঙ্গিকÑ সে কি এক সঙ্গীতের শেষ
পর্ব শুনব বলে? নাকি, কবে/ শহরের রঙিন মাথায় দুরন্ত রিবনগুলো খুলে যাবে
ঘূর্ণিত ঝড়ে,/ দুঃশীল আশায় তার বসে আছি অতিশয় অসুস্থ একজন,/ নিজের দু’চোখে
কবে জ্বলে উছবে আসন্ন মৃত্যুরা?’
‘এ কেমন মৃত্যু এই নেয় কিন্তু ফেলে
রেখে যায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। দেহঘড়ি ছেড়ে দমের পাখি কোন সুদূরে
উড়ে যায় তা তো জানা নেই। আসন্ন মেঘে কোথায় কী ঝড় হবে তা কি বলতে পারে
সহস্রাব্ধের মল্লার। নোঙর ফেলে তাই ঠাঁই বসে থাকা যায় না। মৃত্যু অনিবার্য
জেনেও মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তখন জীবন কিংবা মৃত্যু
দুটোই হয়ে উঠে উৎসবের সমার্থকÑ মৃত্যুকে জীবন দেয়, জীবনের মৃত্যুকে ভোলায়;/
কি কান্তি! তোমার তনু এ-হৃদয়-আসন্ন সন্ধ্যার পটে/ নাচায় নিয়ন।’
নদী বয়ে
চলে। কালো স্রোত ছেয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ভাসায় আত্মীয় পরিজন। মানুষের
দুঃখবোধ তখন চাঙর দিয়ে উঠে। ভুলতে পারে না মানুষ মৃত্যুকে। ভুলতে চাইলেও
মৃত্যুই নিজ যোগ্যতায় তাকে স্মরণের কাছাকাছি রাখে, একদম শাহরগের নিকটে। আর
এই করুণ মৃত্যুর তরজমা করতে পারে না কোনো অনুবাদক। তাই অনিশ্চিত যাত্রাপথের
এই নাক্ষত্রিক বিচ্যুতি অবকাশে হাহাকার হয়ে উঠে মন। কবির অনুজা যেদিন মারা
যান, কবর দিয়ে এসে তিনি লেখেনÑ ‘অনুজার মৃত্যু হলো; সে আমার ছিল না আর
কেউ।/ কবর দিতে গিয়ে/ কাফনের দেখলাম/ গায়ে প্রজাপতি Ñ/ একেবারে হৃদয়ের
পরে...যা স্তব্ধ;/ যেনো তরঙ্গের ফুল চক্রের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত কেন্দ্রের
দিকে।’
আবার অনুজার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীকে কবি লেখেনÑ মৃত্যুই নিয়ত
টানে। মৃতগণ কখনো কখনো।/ আমি অবিরাম জন্ম থেকে মৃত্যুতে আর/ আবার নিয়েছি
জন্ম...বারবার।’ এ কবিতারই আরেক জায়গায় সৈয়দ হক বলেনÑ অথচ মৃত্যুই যেন
একমাত্র অচেনা এখানে।/ যেনো...অচেনা।/ কারণ অত্যন্ত কাছে যা থাকে তা
অত্যন্ত দূরের।’ এভাবেই জীবনের প্রজ্ঞা লেখকের কলমকে করেছে বিচিত্রমৃত্যুর
তুলি। কখনো ক্যানভাসে একেছেন সাদামাটা, কখনো এঁকেছেন গাঢ় রেখাÑ ‘শ্যামলের
বোন আত্মহত্যা করে কোন/ দুঃখে দূর কুরিগ্রামেÑআজো, রোজ করেÑ/ আজো মাঝে মাঝে
রাত দুপুরের গাড়ি/ এইখানে বাঁশি দেয়।’
একান্ত আলাপচারিতায় একদিন
আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন কীভাবে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও কবিতার জন্য সৈয়দ
শামসুল হক ছিলেন ব্যকুল-বেকারার। তাগাদা দিয়ে কাগজ আনান হাসপাতালের
বিছানায়। নিজ হাতে লেখতে না পেরে স্ত্রীকে অনুরোধ করেন শ্রুতিলিখন করতে।
মৃত্যুমগ্নসময়েও এমন কবিতামগ্ন থাকা তা শুধু সম্রাটের মতো এসে সম্রাটের মতো
চলে যাওয়া সৈয়দ শামসুল হকের পক্ষেই সম্ভব। তাই তার কবিতার কথায় বলতে হয়Ñ
‘স্বপ্নবান বারবার মরে/ আমার যা অবশিষ্ট আছে তার মৃত্যু যখন হবে/ তখন তুমি
বলবে/ মৃত্যু হলো তোমার একটি অংশের’।
মধুরীম দ্যোতনাসফিকুল বোরহান ।।
বিমুর্ত
শৈল্পিক সৃষ্টিতে শিল্পী তার সবটা মনন দরদী আকুলতায় ঢেলে দিয়েছে নীল পানির
গভীরে আধশোয়া মৃত শিশুটির সমস্ত স্বত্বা জুড়ে। শিশুটির হাত এমনভাবে
মুঠিবদ্ধ যেন ছিটকে হারিয়ে যাওয়া মায়ের তর্জনীটা শক্তভাবে ধরে রাখা। আশপাশে
জলজ মাকড় কিংবা মৎস্য প্রজাতিদের কম্পিত বিচরণ। কোথায় মা, কোথায় মানবিকতা,
কোথায় যূথবদ্ধ ধরণীর ত্রাতারা! প্রদর্শনীর মায়াবী আলোর ঘোরে পলাশ আকুল
ডুব-সাঁতারে সেই শিশুটির গভীরে কী অত খুঁজছিল, সে কি নিজে জানে তা? অতি
নিকটে গভীর প্রশ্বাসের বায়ুবীয় শব্দে ফিরতেই হয়।
কতদিন পর চিনুর সাথে
চমকানো দেখা। ঠোঁটকোনে সেই প্রাণকাড়া হাসি। চোখের প্রান্ত কি একটু ভারী
হয়েছে? গলার নীচেও তো। শাড়ির কুচি গলে ফর্সা ধবধবে পায়ে দামী সেন্ডেলের
ফাঁক দিয়ে নখে নেইলপলিশ পরা বিন্যস্ত আঙ্গুল ঠিক আগের মতোই পলাশকে মোহিত
করলো। ঘন চুলের গভীর থেকে দু’একটা রেশমি চুল জানান দিল সময় পেরিয়েছে। হালকা
লিপস্টিক আকাশরঙা শাড়ির সাথে কেমন মানিয়ে গেছে। ওর সাজগোজ একটুও বদলায়নি।
ওর দাঁড়ানো ভঙ্গি একটুও বদলায়নি। ওর গভীর চাহনী একটুও বদলায়নি। আলতো করে
বলে উঠলো চিনু, ‘কেমন আছো পলাশ?’ পলাশ কি একটু বিবশ হয়ে উঠল? পলাশের দু’চোখ
কি একটু ভিজে আসতে চাইল? পলাশ কি একটু নড়েচড়ে উঠল?
‘কেমন আছো পলাশ?’ আবার চিনুর নরোম উচ্চারণ।
‘চলো, কোথাও বসি।’
সামনে
তো বসার জায়গা নেই। এসব প্রদর্শনীর পরিসরে বসার জায়গা থাকে না। নরোম আলোর
বিক্ষেপে প্রদর্শনীর মুর্তমান ছবি কিংবা ভাস্কর্যগুলো গভীরভাবে দেখতে দেখতে
বসা কিংবা ক্লান্তির কথা একেবারেই আসে না। কিন্তু এই মুহূর্তে পলাশের
দু’পা, শরীর, মন কেমন নেতিয়ে আসছে।
‘তুমি অসুস্থ্য বোধ করছো? চলো
বেরোই।’ চিনু পলাশের বাম হাতের কনে আঙুলটা আঁকড়ে ধরে একরকম তাড়াহুড়া করে
বাইরে চলে এলো। দাঁড়ানো গাড়িতে উঠেই ক্রসরোডের প্যারাডাইস গার্ডেনে
ড্রাইভারকে চালাতে বললো।
‘কপালটা মুছে নাও, অকারণ ঘামছো।’ বলেই হাতব্যাগ থেকে গোলাপি টিস্যু বের করে দেয় চিনু। ড্রাইভারকে এসিটা বাড়িয়ে দিতে বলে।
‘আগের
মতোই আছো। স্বাস্থ্য একটু ভাল হয়েছে। বেশ হ্যান্ডসামও হয়েছ। সব একটু
পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু কথা সেই আগের মতোই কম বলো। ভাল আছো তুমি?’
‘হ্যাঁ, ভাল।’
‘তুমি?’
‘আমাকে তো দেখতেই পাচ্ছ, খুব ভাল আছি।’
‘কোথায় থাকছো?’
‘রিনির বাসায়।’
’রিনির বাসায় কেনো?’
‘কোথায় থাকবো?’
পলাশ উত্তর দেয় না।
‘তুমি কোথায় থাক?’
পলাশ উত্তর দেয় না।
করিডোর
পেরিয়ে লিফটে সোজা রুফটপ গার্ডেনে। হেমন্তের অবারিত খোলা আকাশে ভরা
পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ আর তারাদের ঝিকিমিকি। তিরতির হালকা ঠান্ডা বাতাস,
প্যারাডাইসের মনোরম গোছানো মৃদু আলো আর চাঁদজোসনা মিলে অরূপ পরিবেশ যা
পলাশের খুবই প্রিয়। চিনু তাড়া দেয়, ‘বসোতো।’
গার্ডেনটা ওরা এমনভাবে
সাজিয়েছে মনে হয় প্রতিটা জায়গা একেকটা গাছ দেয়ালে বিন্যস্ত লন। বসলে পরে
ওপাশের কাউকে তেমন দেখা যায় না। টুংটাং চামচের শব্দ আর মৃদু আসা কথাবার্তা
ছাড়া একরকম একান্ত পরিধি। চিনু পলাশ মুখোমুখি বসা। চিনু আবার একটা টিস্যু
এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘চোখটা মোছো।’
‘আমরা এখানে দু’আড়াই ঘন্টা বসবো। টাইমিং
চার্জ পেমেন্টের সাথে। সময়মতো খাবার অর্ডার দেবো। এখন দু’কাপ কড়া কফি
দেবেন। চিনি আলাদা।’ সার্ভিসম্যানকে একদমে কথাগুলো বলে গুছিয়ে বসলো চিনু।
ওর বসার ভঙ্গিমাটা কোনো বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা দামি উপন্যাসের দরদি প্রচ্ছদ
যেন।
চিনু, পলাশের আত্মার একটা অবিভাজিত অংশ। চিনু মানেই পলাশের জীবনের
সহগামী অধ্যায়। চিনু আছে বলেই পলাশ রাতের আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখে, শুকতারা
দেখে, কালকেতু দেখে। চিনু থাকে বলেই বসন্তপাখির সুরেলা গান মধুময়ী হয়ে ওঠে।
চিনুর মধুরীম দ্যোতনা পলাশের জেগে ওঠার প্রধানতম উপকরণ।
কতদিন পর চিনুর
সাথে দেখা। কত বছর পার হয়ে গেল। কী আশ্চর্য চিনু একই রকম আছে কি করে!
মানুষকে কতভাবে বদলাতে দেখেছে। চিনুর একটু বয়স হওয়া ছাড়া আর কোনভাবেই
বদলায়নি।
নিজের চোখটাতে টিস্যুর হালকা চাপ দিয়ে ডান-বামের পরিবেশটায় চোখ
বুলিয়ে বলে ওঠে চিনু, ‘আমি জানতাম তোমার সাথে দেখা হবেই। আমি কিন্তু
তোমাকে একটুও খুঁজিনি, তুমি বলেছিলে তোমাকে যেন একবারের জন্যও না খুঁজি,
কোনো যোগাযোগের চেষ্টা যেন না করি। করিনি পলাশ। যে জীবন আমার জন্য
বিচ্ছিন্ন হলো, তোমাকে কেন দূরত্বের অসীমে অকারণ বাঁধার ইচ্ছা করবো। তুমিও
তা-ই করেছো। তুমি তোমার জীবনকে পুড়িয়ে খাক করেও আমার কাছে কোনো কৈফিয়ত
চাওনি। শুধু বিষাদময়ভাবে বলেছিল কখনো যেন যোগাযোগটা না হয়।’
‘এসব কথা না আসলে কি নয়? তুমি ভাল ছিলে শুনেই আমি খুশি। রিনির বাসায় কেনো বললে নাতো।’
‘বাবা
শেষদিন পর্যন্ত বলেছিলেন, দেশের বাইরে এসে তোর জীবনটা আমি নষ্ট করে
ফেললামরে মা! বাবাকে বোঝাতে পারিনি বাস্তবতার পরমতম আলিঙ্গনকে অস্বীকার করা
যায় না। যতই উচ্ছল হতে চাইতাম বাবা ততই আমার গভীরে প্রবেশ করে বোঝাতে
চাইতেন বড়ো সর্বনাশ হয়ে গেল। কী তছনছ যে হয়ে গেল পলাশ!’
‘বাবা-মা, ভাই-বোনরা কোথায়?’
‘বাবা-মা সম্ভবত আমার জন্যই তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। মিনু বিয়ে করে আমেরিকাতেই থাকে, রুমি কানাডায়।’
‘তুমি?’
‘আমি তো এলাম তোমার কাছে।’
চমকে ওঠে পলাশ। ‘বিয়ে করোনি কেনো? কি করছিলে এতোদিন? দেশে কেনো এলে? কীভাবে থাকছো? কবে যাচ্ছো?’
‘এত
প্রশ্ন করছো কেনো? তুমি অনেক কথা বলা শিখে গেছো। আমার যাওয়া আটকাওনি কেনো
পলাশ? তখনকার তুমি আমাকে কেনো একবারও বলোনি- থেকে যাও, যেওনা। জানি
পরিবারের দায়িত্বশীল সদস্যকে আবেগী হতে হয় না। আমি বুঝতাম আমাকে নেবার সময়
তখন হয়ে উঠছিলো না তোমার। আমি জানতাম আমাকে নিতে গেলে তোমার অনুগামী
স্বত্বার মরন হতো, তোমার পরিধি বিবর্ণ নীল হতো। ভাঙচুর হতো দুটি আত্মার
সাথে চৌমুখী প্রভাগুলো।’
‘আমি কি, কেমন থাকছি না জেনেই চলে এলে?’
‘বাহ্,
জানবো না কেনো? তুমি যে আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে আজকের দিনটায় আসতে, মহুয়ার
নীচে জাগরণী গান হতো, বিভাময়ী জীবনের প্রতিটা স্তরে তোমার আমার বিচরিত
অধ্যায়গুলোতে তুমি থাকতে পারছো, আমি পারবো না কেনো? আমি তো জানতামই, না
খুঁজেই আমাদের স্পর্শিত জায়গাগুলোতে তোমাকে পাওয়া যাবেই। তোমার দেয়া কথা
আমি রেখেছি। আমি জানি তুমিও নিজের দেয়া প্রতিজ্ঞা থেকে একচুলও সরোনি।’
‘এতটা বছর পার করতে কতটা জ্বলেছো তুমি চিনু! কেনো নিজের জীবনটা গোছাওনি?’
বাঁধভাঙ্গা
কান্নায় ডুবে যায় চিনু। পলাশ অবাক হয়ে দেখছিল চিনুকে। একটুও কান্না থামাতে
বাধ সাধলো না। কেঁদে হালকা হলে কথারা সহজ হয়ে আসে।
‘কে বলেছে গোছাইনি।
একটা প্রফেশনাল কোর্স করেছি, নামকরা একটা কোম্পানীতে চাকরি করেছি, অনেক
পয়সা জমিয়েছি। প্রতিটা স্পট, সেন্টার, সমুদ্র, আকাশ চড়ে বেরিয়েছি তোমাকে
মনে করে। নিয়মতান্ত্রিক অধ্যায় পার হবার পর সূযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি আমার মনে যেন শুন্যতা ভর না করে, আমি
কামনা করেছি সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফিরিয়ে দিওনা, আমি যেন কোনওভাবে পলাশকে
একবারের জন্য হলেও পাই।’
‘আর আমি কেমন ছিলাম জানতে ইচ্ছা হয়নি একবারও।’
বিষণ্ন পলাশ বলে ওঠে- ‘আমিওতো তন্নতন্ন করে চাঁদকণায়, ইথারে, কুয়াশা মদিরে,
জোনাক ভরা রাতে হন্যে হয়ে খুঁজেছি তোমাকে। তুমি আসবে কখনোই ভাবিনি কিন্তু
তোমার আরতিতেই কাটিয়ে দিলাম জীবনের মহুয়াসময়। তুমি তুমি করেই বাবা-মায়ের,
ভাই-বোনের সব আর্তিকে নীরবে পাশ কাটিয়েছি। সব পূর্ণতা সবখানে বিলিয়ে দিয়ে
যখন নিজের পূজার থালা পূর্ণ করার প্রয়াস এলো তখন আর নিজকে ধরে রাখতে
পারছিলাম না- তখনই তুমি কোন রূপময় পরি হয়ে চলে এলে।’
ধরে এলো গলাটা, কথা
আর এগুলো না। চিনুর কম্পিত মুঠিতে উঠে এলো পলাশের মুঠি। দুই স্বত্তা
একপ্রাণ হয়ে নবণী গীত গেয়ে উঠলো দেখে শুন্য অতীত অনিন্দ্য হয়ে উঠলো কি?
সফিকুল বোরহান
অন্বেষা, রানির দিঘির পূর্ব পাড়, কুমিল্লা।