স্টাফ
রিপোর্টার।। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে কুমিল্লা শহরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে
বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চারজনসহ মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। র্যাব বলছে,
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে
একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও
ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায়
র্যাব। সংস্থাটি বলছে, র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১-এর
অভিযানে তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
র্যাব
বলছে, গ্রেপ্তার সাতজন হলেন হোসাইন আহম্মদ (৩৩), মো. নেছার উদ্দিন ওরফে
উমায়ের (৩৪), বনি আমিন (২৭), ইমতিয়াজ আহমেদ ওরফে রিফাত (১৯), মো. হাসিবুল
ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪), মো. সাবিত (১৯)। এর মধ্যে ইমতিয়াজ ও
হাসিবুলের বাড়ি কুমিল্লায়। হোসাইন, নেছার, বনি ও সাবিতের বাড়ি পটুয়াখালীতে।
রোমানের বাড়ি গোপালগঞ্জে।
কুমিল্লা থেকে নিঁখোজ ৬ যুবকের সাথে নিঁখোজ
হওয়া ঢাকার শারতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় ভুল বুঝতে পেয়ে ফিরে আসার পর তার দেওয়া
তথ্যে অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই নিলয় ও অন্য যুবকরা কুমিল্লার চৌয়ারা
বাজারের একটি হোটেলে মিলিত হয় সেখান থেকে চাঁদপুর হয়ে পটুয়াখালী যায়। পরে
ফিরে আসে।
শারতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় বলেছে, কুমিল্লা শহরে ফ্রান্সে হজরত
মুহাম্মদ (স.)কে নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদে একটি সংগঠন ফ্রান্স বিরোধী
বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেও তাদের সাথে
জড়িয়েছিল।
কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া রিফাত ও হাসিবুল গত এক বছর ধরে
কুমিল্লা শহরের নজরুল এভিনিউ রোডস্থ মসজিদুল কোবার ইমাম হাবিব উল্লাহর
সংস্পর্শে ছিলেন। হাবিব উল্লাহই তাদের উগ্রবাদে দীক্ষিত করেন, পরে গত ২৩
আগস্ট তারা বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরে তাদের সঙ্গে গোপালগঞ্জ ও ঢাকার উত্তরা থেকে
নিখোঁজ হওয়া হাসিবুল ও সাবিতের দেখা হয়। তবে হাবিব উল্লাহর সন্ধান র্যাব
এখনও পায়নি। হাবিব উল্লাহ নিঁখোজের বিষয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা
কোতয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার বড়ভাই শাহ মো: অলিউল্লাহ।
ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে হাবিব উল্লাহ শাশুড়ির কাছ
থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদে যান। তার আত্মীয় মোসলেম উদ্দিন জানান, পরে স্ত্রীকে
ফোন করে সন্তানরা কেমন আছে জানতে চেয়ে ফোন রাখার আগেই কেউ ফোন নিয়ে নেয়।
সংবাদ
সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন
বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির কর্মপদ্ধতি,
প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা, উগ্রবাদী বই, ভিডিওসহ ট্যাব উদ্ধার
করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, হোসাইন পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা
করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, নিষিদ্ধঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কতিপয়
সদস্যদের একীভূত করে ২০১৭ সালে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়।
এই
দলে জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য রয়েছেন। ২০১৯
সালে সংগঠনটির নামকরণ করা হয় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।
হোসাইন সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন
তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত
করে তুলতেন।
নেছার ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরত করা
সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও বিভিন্ন
তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত
করে তুলতেন।
বনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পটুয়াখালীতে ব্যবসা করতেন। তিনি
২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সদস্যদের আশ্রয় ও
তত্ত্বাবধানের কাজ করতেন।
রিফাত অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকে অধ্যয়নরত। হাসিব
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যয়নরত। তিনি একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত
ছিলেন। তাঁরা গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। তাঁরা কুমিল্লার একটি
মসজিদের ইমামের কাছ থেকে নতুন সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পান।
রোমান
গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক ও স্যানিটারির কাজ করতেন। তিনি অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও
দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন। স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি সংগঠন
সম্পর্কে ধারণা পান। প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন।
সাবিত
উত্তরা এলাকায় একটি ছাপাখানায় স্টোররক্ষকের কাজ করতেন। তিনি তাঁর এক আত্মীয়
ও অনলাইনে ভিডিও দেখে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। প্রায় এক মাস আগে তিনি
নিখোঁজ হন।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “এই নতুন জঙ্গি সংগঠনটি ২০১৭
সালে গঠিত হয়। ২০১৯ সালে এর নামকরণ করা হয়। র্যাব এখন পর্যন্ত এই আঞ্চলিক
নেতা ও নিচের সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এর প্রধান কে বা সুরা
সদস্য কারা সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।”
এ সংগঠনের নামে ‘হিন্দাল’ শব্দটি
কেন জানতে চাইলে র্যাবের পরিচালক বলেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা
বিষয়টি বলতে পারেনি। সংগঠনের ওপরের সারির নেতারা হয়ত বলতে পারবেন।
খালাতো
ভাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা
ছেড়েছিলেন শারতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় (২২)। পরে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন।
হিজরতকালে পটুয়াখালী থেকে পালিয়ে বাসায় ফিরে আসেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে নিজের জঙ্গিবাদের জড়িয়ে
পড়া ও পরবর্তী সময়ে ভুল বুঝতে পারার কথা সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন
শারতাজ।
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে কথিত হিজরতের নামে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চারজনসহ মোট
সাতজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত সাংবাদিকদের জানাতে আজ র্যাবের
মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্থাটি। সেখানে শারতাজও
উপস্থিত ছিলেন।
জঙ্গিবাদে জড়ানো সম্পর্কে শারতাজ বলেন, ‘এটা একটা ভুল
পথ। কোনো কিছু করার আগে জেনেবুঝে করা উচিত। কেউ আমার মতো না বুঝে এমন ভুল
করবেন না।’
শারতাজ বলেন, পরিবার ছেড়ে কথিত হিজরতে যাওয়ার পর তিনি নিজের
ভুল বুঝতে পারেন। তাই সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। সুযোগ বুঝে তিনি
পালিয়ে বাসায় ফিরে আসেন।
শারতাজ বলেন, ‘আমি চার থেকে পাঁচ দিন হিজরতে
ছিলাম। তার মধ্যেই বুঝতে পারি, এটা ভুল পথ। আসলেই এটা ভুল পথ। এই ভুল পথে
কেউ যাতে পা না বাড়ায়, সেই অনুরোধ আমি জানাই।’
র্যাব জানায়, জঙ্গিবাদে
জড়িয়ে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চারজনসহ
গ্রেপ্তার সাতজনকে তারা গতকাল বুধবার গ্রেপ্তার করে। গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা
সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হন। তাঁদের মধ্যে শারতাজ ছিলেন। তিনি গত ১
সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের বাড়িতে ফিরে আসেন।
শারতাজকে তাঁর
পরিবারের হেফাজতে রেখে বাকি নিখোঁজ সাতজনসহ অন্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে
র্যাব। এভাবেই তারা গতকাল সাতজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।