ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
Published : Thursday, 13 October, 2022 at 12:00 AM
পূর্ব প্রকাশের পর-------
জীবনবোধ ও জীবনদর্শনজুলফিকার নিউটন ||
৩২
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) আয়োজিত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব’৯০-তে সভাপতির অভিভাষনে আমি হালকাভাবে বলেছিলাম, আমার কবিতা লেখার কারণ এই যে অন্য কিছু আমি পারি না। পরে আমার মনে হয়েছে, হালকা শোনালেও একটা গম্ভীরতা আছে কথাটার মধ্যে। কেননা মানুষ কিভাবে কী পারে সেই রহস্য এতে নিহিত। কেউ কখনো কখনো এমন কাউকে দেখা যায় যে, দুই বা ততোধিক জিনিস পারে আপনা থেকে। এই আপনা থেকে পারার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। তাকে বলতে পারি শিল্পের তাৎপর্য। সৃজনশলিতা, পৎবধঃরারঃু এর সঙ্গে যুক্ত। এটা ভেতরের ব্যাপার। এ পরিমাণ বা প্রবলতা বা বিশিষ্টতা অনুসারে ক্ষমতার তারতম্য প্রকাশ পায়, এবং আমরা কাউকে বলি মহৎ শিল্প, আবার কাউকে তেমন বড় মনে করি না। আপনা থেকে পারাটা আসে যদি সহজাত প্রবণতা থাকে তবে, নইলে আসে না। অর্থাৎ এ এক জন্মগত ব্যাপার। আমি মনে করি, স্বভাবের মধ্যে এই প্রবণতা থাকে তবে, নইলে আসে না। অর্থাৎ এ এক জন্মগত ব্যাপার। আমি মনে করি, স্বভাবের মধ্যে এই প্রবণতা না থাকলে কেউ কোনো শিল্পে ভিড়ে যেতে পারে না। একটা জিনিস তো সকলের কাছেই স্পষ্ট সবাই সব শিল্পে হাত দেয়া না। জন্মের পর ভেতর থেকে কাউকে টেনে নেয় সঙ্গীত, কাউকে সাহিত্য; কাউকে বা চারুকলা। একটা স্তরের বিজ্ঞানকেও আমার শিল্প মনে হয়, যে-স্তরে তার সৃজনশীল ভাবনা আমাদের নতুন দৃষ্টি খুলে দেয়।
আমি কবিতা লিখি যেহেতু অন্য কিছু পারি না, এ-কথা না বলে যদি বলি আমি কবিতা না লিখে পারি না তাহলেই বোধ হয় ঠিক বলা হয়। কেননা কবিতা লেখার ঝোঁক আমার অল্প বয়স থেকে। অর্থাৎ এ আমার এক জন্মগত প্রবণতা। আমি ছোট কবি না বড় কবি, নগণ্য না বরেণ্য, তা আমি জানি না। সে বিচারের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ও নেই। কেউ কি সত্যি বলতে পারে সে কোন দরের শিল্প? তাকে লোকে যেমন দেখে সে তেমন। অবশ্য সে দেখাটাও অনেক সময় নির্ভর যোগ্য হয় না। সেটা অন্য পর্যালোচনার বিষয়। তার মধ্যে এখন আমি যাব না।
কোনো লোক তার শিল্পী পরিচয় আর এককভাবেও তৈরী করতে পারে। শিখে বা পড়ে এবং ক্রমাগত অভ্যাস করে শিল্পচর্চার নিদর্শন সে উপস্থিত করতে পারে, তার ভেতরে কোন স্বাভাবিক প্রবণতা না থাকলেও। কিন্তু এ বোধ হয় যান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বহিঙ্গকে আয়ত্তে এনেই এটা করা হয়। যে অন্তরঙ্গ রূপ সৃষ্টিকে উদ্ভাসিত করে তা এত আমরা দেখতে পাই না। কবিতার দৃষ্টান্তে বলা যায়, কোনো রচনায় হয়তো দেখা গেল নিপুন ছন্দ বা ছন্দমুক্তি, সাহসিক শব্দসন্নিবেশ এবং আধুনিকতার লক্ষণাক্রান্ত বাক্য, কিন্তু লেখকের ভাবনার বা প্রকাশের কোনো বৈশিষ্ট্য না। এ-রকম শিল্পনিদর্শন প্রায়ই দেখি আমরা, কিন্তু তার চরিত্র সম্বন্ধে মস্ত বড় প্রশ্ন থেকে যায়।
স্বাভাবিক ঝোঁকের কথা যখন বলছি তখন আর একটা কথাও বলা দরকার এই সঙ্গে। শিল্প-সৃজন এবং শিল্প অনুরাগ দুয়ের মূলেই জন্মগত প্রবণতা। কেউ বিশেষ ভাবে সাড়া দেয় কবিতায়, কেউ ছবিতে, কেউ সঙ্গীতে। এই রকম। সব শিল্প সবাইকে সমান ভাবে আকর্ষণ করে না। এই উন্মুখতায় বিদ্যা বা শিক্ষার মূলত কোনো ভূমিকা নেই। ভূমিকা থেকে পরবর্তী পর্যায়ে। সৃজন এবং অনুরাগ, দুই ব্যাপারেই আসল হল স্বভাবগত সংবেদনা। অধীত বিদ্যা কবিতার উৎস নয়, কবিতার উৎস কবি স্বভাব। যার এই স্বভাব আছে, বিদ্যা Í সৃজনকে আরো সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু যার তা নেই, বিদ্যা তাকে সত্যিকার সৃজনে কোনো সাহায্য করতে পারে না। কবিতায় সাড়া দেওয়াটাও ঐ রকমই। যার মধ্যে এই সংবেদনশীলতা জন্ম থেকে আছে, বিদ্যা তাকে গ্রহণ-ক্ষমতায় আরো সম্পন্ন করে তোলে। কিন্তু যার নেই, হাজার কবিতা পড়লেও কবিতার প্রবেশদ্বার তার কাছে বন্ধই থেকে যায়। এর প্রমাণ তো আমরা প্রতিনিয়তই পাই। তথাকথিত শিক্ষিত যারা, তাঁরা কজনই বা কবিতা পড়েন? অধিকাংশই পড়েন না আর যখন আগ্রহ দেখানোর মনোভাব নিয়ে পড়তে যান তখনি ধাক্কা খান এবং স্বভাবগত অনাগ্রহকে ঢাকবার জন্যে শিক্ষিতের অভিমানে দায়ী করেন আধুনিক কবিতার ‘দুর্বোধ্যতা’কে। এ দেশের কবিদের বিশেষ দুর্ভাগ্য এখানকার এক শো জনের মধ্যে সত্তর জন মানুষ অক্ষরই চেনে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই বিপুল সংখ্যক নিরক্ষরের মধ্যে এমন বহু রয়েছে যারা কবিতার দ্বারা স্পষ্ট হবার মন নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু তার সংস্পর্শে আসার পথ তাদের কাছে রুদ্ধ। আমি এক এক সময় ভাবি তারা যদি এ কালের কবিতা শোনার সুযোগ পেতে তাহলে অপরিচয়ের ব্যবধান সত্ত্বেও এক অস্পষ্ট সাড়া দিত তারা সবজান্তা কৌতুকের জায়গা নিত সহানুভূতি।
এই অবস্থার মধ্যে আমি কবিতা লিখি। অবস্থাটা খুব উৎসাহজনক নয়। তবু লিখি। সংখ্যা গরিষ্ঠের উদাসীনতায় আমার দুঃখ নেই। কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারণা আছে। কবিতার মুষ্টিমেয় আত্মীয় তো রয়েছে। তারা যদি উদাসীন হয় তাহলে আমি দুঃখ বোধ করি। কিন্তু আমি নিরুৎসাহ হই না। বরং সেটাকে এক চ্যালেঞ্জ বলেই ধরে নিই। মনে মনে বলি, শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক না কতদিন এ উদাসীনতা (বা কখনো হয়তো বিরোধীতা) থাকে। অবশ্য এটা বাইরের ব্যাপর, এর দ্বারা আমার কবিতা লেখা নিয়ন্ত্রিত হয় না। কারণ কারো মুখ চেয়ে আমি কবিতা লিখি না। না লিখে পারি না বলেই লিখি। আমার বিশ্বাস, আমার স্বর যদি আন্তরিক হয়, আমার অনুভব এবং অভিজ্ঞতার প্রকাশ যদি আমার নিশ্বাসের মত প্রাণচিহ্ন হয়ে ওঠে তাহলে একদিন মানুষ তা শুনবে। সে-শ্রোতার সংখ্যা কম বেশি, তার ভাবনা অবান্তর, অন্তত সমকালীন অবস্থায়। এ সত্ত্বেও স্বীকার করি আমি আগে কোনো কোনো সময় থামিয়ে দিয়েছি কবিতা লেখা। বাস্তবের প্রতিকূলতায় যেমন নানা ভাবে বা সময়াভাবে যে থামা, সেটা এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। সে রকম বাধাকে মানিয়ে নিয়ে আবার কবিতায় হাত দেওয়া দুঃসাধ্য নয়। বারবারে ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে। আসল বাধা এসেছে আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। কবিতা লিখে কি হবে, মনের এই প্রশ্ন অতীতে এক এক সময আমাকে খুব অস্থির করেছে। এছাড়া, গতানুগতিক উপায় অথবা অনুসরণের পথে আমার কথা আমি ঠিক বলতে পারছি না, এই ব্যর্থতা বোধ আমাকে বিতৃষ্ণ করেছে। তবু সম্পূর্ণ নিবৃত্ত না হয়ে আমি অন্য পথের সন্ধান করেছি এবং নতুন ভাবে কথা বলার ইচ্ছে নিয়ে আবার এসেছি কবিতায়। প্রথম দিকে যে অন্ধ চলন ছিল তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। সার্থকতার প্রশ্নটাও বড় গতানুগতিক ছিল। এবং স্থূল। পরে বুঝেছি, কোনো শিল্পের স্বার্থকতা নগদবিদায়ে নয়, অন্তত এখনকার সমাজে। তার ক্রিয়া অলক্ষ্যে দৃষ্টির যে উন্মীলন ঘটায়, যে জাগতিক চেতনা ও আত্ম উপলব্ধি আনে, তার মূল্য অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। এবং আমি কবিতা আবার না লিখে পারিনি।
এটাই আসল ব্যাপার কবিতা না লিখে থাকতে না পারা। এ থেকে একটা মূল কথাও এসে পড়। স্বাভাবিক প্রবণতা মানেই তো এই যে, কোনো উদ্দেশ্যের দ্বারা তা চালিত নয়। আমার কবিতা লেখাও তেমনি। তা উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। উদ্দেশ্যমূলক রচনার আমি নিন্দে করি না, অনেক ক্ষেত্রে তার ব্যবহারিক প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা সৃজনের পর্যায়ে যেতে পারে না, কারণ তা পূর্বনির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে থাকে। কোনো বিশেষ দৃষ্টি বা মনোভাব তখনই সৃজনের স্তরে প্রসার সীমাহীন হতে পারে সে দৃষ্টি বা মনোভাব কবির জীবনানুভূতির সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় তা কোনো উদ্দেশ্য হিসেবে আর থাকে না, হয়ে যায় কবির আন্তর অস্তিত্ব।
আমি যে কবিতা লিখি তার কারণ ঐ ভাবে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য আমার স্বভাব পীড়াপীড়ি করে। সেটাই প্রাথমিক তারপর একটা আগ্রহ বোধ করি সঙ্গ লাভের জন্যে। আমার স্বর অন্য তন্ত্রীকে অনুরণন তোলে কিনা তা জানার জন্যে একটা প্রত্যাশা থাকে। নইলে লেখা ছাপা কেন? কিন্তু সে-প্রত্যাশা এমন নয় যে, তার পূরণ না হলে আমি নিরুদ্যম হয়ে যাব। কারণ আমি জানি এখানে অধৈর্য হওয়া অর্থহীন এ এলাকায় প্রচলিতের ভূমিকা বড় প্রবল এবং সাড়া পাওয়ার আগে একটা অপেক্ষার কাল থাকে, যা কখনো হস্ব হয় কখনো-বা দীর্ঘ, অনেক সময় এমন দীর্ঘ যে আত্মীয়দের আর চেনা হয় না শেষ পর্যন্ত। এর সঙ্গে অর্থাৎ এই নিজেকে প্রকাশ করা এবং সাড়া পাওয়ার জন্যে অনির্দিষ্ট প্রতীক্ষার সঙ্গে কবিতার এমন এক প্রশ্ন জড়িত, যা নিয়ে বির্তকের শেষ নেই। তা হল বিশুদ্ধ অবিশুদ্ধ কবিতার প্রশ্ন। বিশুদ্ধ কবিতা বলতে ঠিক কী বোঝায় এবং তার মহাত্ম্য কী তা আমার বোধগম্য নয়। কবিতার বিশুদ্ধ বলে কি কিছু হতে পারে? কবিতার বিশুদ্ধিকরণের চেষ্টা ফরাসী কবি মালার্মে যেমন করেছিলেন তেমন বোধহয় আর কেউ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন, “জনগোষ্ঠীর শব্দাবলীকে আরো শুদ্ধ এক অর্থ দিতে” এবং সে জন্যে তিনি তার কবিতায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দ থেকে মানুষী আবেগ মুছে দিয়ে এক নিরপেক্ষ শব্দজগৎ নির্মাণের চেষ্টা করেন। কিন্ত সেখানে মানুষের পক্ষে নিঃশ্বাস নেওয়া অসাধ্য ছিল। আজ মালার্মের মৃত্যুর প্রায় শবর্ষ বছর পরে তার প্রতিভার স্বীকৃতি সত্ত্বেও ক’জন কবিতার টানে তার কাছে যায়? মানবিক অস্তিত্বের তাপ যদি কবিতাকে অশুদ্ধ করে তবে তার শুদ্ধতা কি কখনো সম্ভব যতদিন মানুষ কবিতা পড়বে?
আমি পৃথিবীর বাসিন্দা অন্য মানুষদের কাছে! আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখা এই পৃথিবীর সব কিছু-নিসর্গ প্রাণী মানুষ, পরিবেশ পরিস্থিতি, প্রেম, অপ্রেম-সব কিছু আমার অভিজ্ঞতা অনুভূতি ও উপলব্ধি আমি মেলে ধরি সবার সামনে। আমার এই উন্মোচন যদি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া নাও জাগায়, তবু কোনো এক সময় তা কবিতা-অভিমুখী মানুষের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও উপলব্ধিকে নাড়া দেবে এবং এক আত্মীয়-জগৎ রচনা করবে, এই প্রচ্ছন্ন প্রত্যাশা তো থাকেই। এই আত্মীয়তা যদি কবিতার অশুদ্ধতা হয় তবে তা-ই আমার কাম্য। শুধু নিজে বাস করাই এক ‘সন্ধ্যা’-জগৎ গড়ার বাসনা যদি থাকে তাহলে কবিতা না লিখে নির্জনে ধ্যানমগ্ন হওয়া বেশি ব্যাঞ্জনীয় নয় কি?
আমি যখন কবিতা লিখি সেই মুহূর্তে অবশ্য এ সব বিচার বিবেচনা বিশ্লেষণ অজ্ঞাতবাসে যায়। তখন শুধু আমার আন্দোলিত হৃদয় মস্তিস্ক আর আমার হাতের এই কলম।
চলবে...