
মোঃ রফিকুল ইসলাম সোহেল ||
আমার
ইচ্ছে ছিল হুইলচেয়ারে বসেচলমান কর্মজীবনের এক বছর পূর্ণ হলে আপনাদের
আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবো কারন আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমি সহ শারিরিক অক্ষম
জনগোষ্ঠীকে কোনভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় পাশাপাশি আমার এই পথচলা আমাদের
সমাজের জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরন হিসাবে আপনাদের অনুপ্রাণীত করবে বলে আমার
বিশ^াস। আজকেদৈনিক কুমিল্লার কাগজের মাধ্যেমে আপনাদেরকে জানাতে পেরে আমি
ভীষনভাবে আনন্দিত। সেই সাথে গভীর কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা দ্রুত এগিয়ে চলা
দৈনিক কুমিল্লার কাগজের প্রতি।আমাকে কাজের এই সুযোগটি সৃষ্টি করে দেওয়ার
জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। সেইসাথে কুমিল্লা ইপিজেডস্থ
ইতালিয়ান “কোম্পানী গোল্ডেন মুন বাংলাদেশ লিমিটেড” এর ব্যবস্থাপনা
কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে কোম্পানীর সত্ত্বাধীকারী মিস্টার বোলজোনারো, সুযোগ্য
কন্যা মিসেস ফাবিওলা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আশেকুল ইসলামের প্রতি গভীর
কৃতজ্ঞতা আমার পাশে থেকে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি
কারখানার প্রতিটি কর্মীর মানবিক আচরন ও সহযোগীতাকাজের ক্ষেত্রে আমাকে দারুন
ভাবে প্রনোদিত করছে। যদি প্রতিটি কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আমার
মতো করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় ্এবং সমাজের
দায়ীত্বশীল ব্যক্তিরা যদিভিন্ন ভিন্নব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের চাহিদা
মোতাবেক প্রতিবন্ধীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারে তাহলে প্রতিবন্ধীবান্ধব
সমাজ গঠন অনেক সহজ হবে।
মেরুরুজ্জের আঘাতে শারিরিক প্রতিবন্ধীকতা জীবনের
শুরু - মানুষের চলমান জীবন নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।
আমারচলমান জীবনের একটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আমার ৫০ বছর
জীবনের ছয় বছরেরও অধিককাল আমি পার করছি হুইলচেয়ারে। এক আয়ুষ্কাালে দুই
ধরনের জীবনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা কম মানুষের জীবনে ঘটে থাকে।আমার জীবনের
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি যাতে অন্য কোন মানুষের জীবনে না ঘটে বিধাতার কাছে সেই
প্রার্থনাই করি।দূর্ঘটনার সময়পেশাগত ভাবে আমি ছিলামপ্রশাসনিক
ব্যবস্থাপক,কর্মস্থান কুমিল্লা ইপিজেডের “কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড”
এ। ২০১৪ সালের ১৭ই জুলাই,কুমিল্লা দ্বিতীয় মুরাদপুরস্থ বাসা থেকে
মোটরসাইকেল যোগে ইপিজেডের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েকুমিল্লা সদর
উপজেলা গেট সংলগ্ন এলাকায় আসা মাত্র চলন্ত মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পতিত
হইএবং হঠাৎ চেতনা হারিয়ে ফেলি। পরবর্তীতে দুর্ঘটনার পর যারা উদ্ধার করেন
তাদের কাছে জানতে পারি আমার মোটর সাইকেলটি রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে একটি
গাছের সাথে আছড়ে পড়ে।গুরুতর আহত অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা
হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরচিকিৎসকপরিবারকে জানান দুর্ঘটনায় আমার মেরুরুজ্জু
মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক চলার ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলি। দুর্ঘটনা পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য পাঠানো হয় ঢাকার
অদূরে সাভারে অবস্থিত পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে। সেই
পুনর্বাসন কেন্দ্রে শারীরিক সক্ষমতা হারানো ব্যক্তিদেরকে পরিবর্তিত জীবনের
সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যে মানসিক শিক্ষা দেওয়া হয় তা তুলনাহীন। সাত মাসের
পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষে বাসায় ফিরে আসি এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায়
প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে থেমে যাওয়া জীবনকে পুনরায় সচল করার সংগ্রামে
লিপ্ত হই। সেই সংগ্রামে যাদেরকেসবচেয়ে বেশী কাছে পাই তারা হলেন আমার
প্রিয়তমা স্ত্রী শিরিন সুলতানা চৌধুরী, সুপুত্র সাব্বির আহম্মেদ ও সুকন্যা
রিফা ওয়াসিমা। একজন ব্যক্তির জন্য পরিবার কতটা সহায়ক হতে পারে তা অনুধাবন
করতে পেরেছি আমার পক্ষাঘাতগ্রস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে।
সংগ্রামের শুরু
ঃস্বাভাবিক জীবনের সক্ষমতা হারিয়ে হুইলচেয়ারে বসেই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে
যাওয়ার সংকল্প্্্্ই আজ আমাকে এই পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত জীবনে চলার পথে আমার মনে হয়েছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখনও
শারীরিকভাবে নানাদিকে অক্ষম মানুষদের জন্য অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
হুইলচেয়ার নিয়ে আমাদের সামাজিক পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গমন এবং ঘুরে
বেড়ানোর একমাত্র উদ্দেশ্যেই হচ্ছে আমাদের সামাজিক পরিবেশকে
প্রতিবন্ধীবান্ধব করা ও শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের প্রতি আরো সহনশীল আচরণ
সৃষ্টির মাধ্যমে একটি মানবিক সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা। হুইলচেয়ার জীবনে
কাজের মাধ্যমে নিজেকে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টার প্রথম ধাপের শুরু মূলত নিজের
ছেলেমেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমকে দেখভাল করার মাধ্যমে। তাদের সার্বিক শিক্ষা
কার্যক্রমকে দেখভাল করার পাশাপাশি তাদের ইংরেজি শিক্ষার বিষয়টি আমি
ব্যক্তিগতভাবে দেখাশোনা শুরু করি হুইলচেয়ারে বসেই। দ্বিতীয়ধাপেহুইল চেয়ার
নিয়ে ঘর থেকে বের হতে আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যোগায় আমাদের সংগঠন
"আলোকিত বজ্রপুর"।এই সংগঠনটির প্রধান সমন্ময়কারী জনাব মাসুদ রানা চৌধুরী
তাদের সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে আমাকে সম্পৃক্ত রেখে আলোকিত ও ও
হুইলচেয়ারবান্ধব সমাজ গঠনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তৃতীয়ধাপেআমার
পরিবারের পরমবন্ধু ফয়জুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েরর প্রধান
শিক্ষকা রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার, সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর,অনুর্দ্ধ-১৯
বিশ্বকাপজয়ী দলের বোলিং কোচ মাহবুব আলী জাকি, লেখক ও ইতিহাস গবেষক এডভোকেট
গোলাম ফারুক উনারা সবাই ব্যক্তিগতভাবে আমার বাসায় এসে আমাকে উজ্জীবিত করেন।
আমার চলমান অদম্য মানসিক শক্তিআমার তিন বন্ধুকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তারা
আমাকে একটি ইলেকট্রিক হুইলচেয়ার উপহার দেয়। তাদের দেয়া এই উপহার আমার
মানসিক শক্তি কে আরো বেগবান করে। এই হুইলচেয়ারে আমি একাই এক জায়গা থেকে
অন্য জায়গায় চলাচল শুরু করি এবং এর মাধ্যেমে সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করছি যে
যদি আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসি তাহলে হুইলচেয়ারের জীবন ব্যবস্থা
কোন বাধা হতে পারে না। চতুর্থধাপেআমার হুইলচেয়ার জীবনে চলার পথে
কুমিল্লাজেলা ক্রিকেট কমিটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। আমি কুমিল্লাজেলা
ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে আমার প্রতি তাদের প্রেরণা অনুকরণীয় হয়ে
থাকবে।উক্ত কমিটি আমাকে কুমিল্লা জিলা স্কুল মাঠে ২০২১ সালে কুমিল্লাজেলা
ক্রিকেট কমিটি কর্তৃক আয়োজিত টি-১০ ক্রিকেট টুর্ণামেন্টে হুইলচেয়ারে
বসেইআম্পায়ারিং করার সুযোগকরে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হুইলচেয়ারে বসে
আম্পায়ারিং করার এই অনন্য রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে রইলো কুমিল্লাজেলা ক্রিকেট
কমিটি। আমি ভীষনভাবে কৃতজ্ঞকুমিল্লা জেলা ক্রিকেট কমিটির সম্পাদক জনাব
সাইফুল আলম রনির কাছে। পঞ্চমধাপেআমার এই জীবনের চলার পথের আরেক শক্তির নাম
"দৈনিক কুমিল্লার কাগজ" এর সম্পাদক জনাব আবুল কাশেম হৃদয় ও উপ-সম্পাদক কবি
জহির শান্ত। হুইলচেয়ারে চলাচলকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে আমার পাশে থাকার
জন্য “দৈনিক কুমিল্লার কাগজে” এর কাছে আমি ভীষণভাবে ঋনী।আমি “দৈনিক
কুমিল্লার কাগজে” এরঈক-২৪ টেলিভিশনের একজন নিয়মিত ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার।
আমাকে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়ে সমাজেরপ্রতিবন্ধী
মানুষদের প্রতি“দৈনিক কুমিল্লার কাগজ” ভালবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন
করলো। এই আলোকিত দৈনিকটিহুইলচেয়ার মানুষদের পাশে থেকে আবারো প্রমাণ করলো
আগামীর আলোকিত সমাজ নির্মাণে তারা কতটা সংকল্পবদ্ধ।
হ্্ুইলচেয়ার জীবনে
কর্মময় সময়-হুইলচেয়ার নিয়ে আমার স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল যখন সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে দৃশ্যমান তখন তা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দুর্ঘটনার প্রায় ৫ বছর পূর্বে
(২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত) কুমিল্লা ইপিজেডে মানবসম্পদ
ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করে যাওয়া আমার কোম্পানি“গোল্ডেন মুন বাংলাদেশ
লিমিটেড” এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। দীর্ঘ প্রায়পাঁচটি বছর আমার রেখে
যাওয়া সুকর্মের গল্প কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার গাব্রিয়েল
ফাসিনাকে আকর্ষণ করে এবং তিনি আমার বাসায় ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করতে
আসেন।তাকে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করেনকোম্পানীর প্ল্যানিং
বিভাগেরএর সহকারী মহাব্যবস্থাপক জনাব মোহাম্মদ সাফিউল আলম। ইলেকট্রিক
হুইচেয়ারে বসে তাঁর সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে হুইলচেয়ারে বসেই
কোম্পানির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হিসবে পুনরায় কাজে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন।
পরবর্তীতে কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আশেকুল ইসলামের সাক্ষরিত
নিয়োগ পত্র গ্রহণ করি এবং২০২১ সালের ২রা অক্টোবর থেকে কুমিল্লা ইপিজেডস্থ
ইতালিয়ান কোম্পানী“গোল্ডেন মুন বাংলাদেশ লিমিটেড” এর মানবসম্পদ
ব্যবস্থাপকহিসেবে পুনরায় কাজে যোগদান করি। প্রতিদিন সকালবেলা কোম্পানীর
নির্ধারিত ইজিবাইক চালক আব্দুর রহিম আমাকে বাসা থেকেফ্যাক্টরীতে নেয়ার জন্য
আমার বাসায় আসে। আমার ছেলে ও আমার স্ত্রী আমাকে পোষাক পরিয়ে তৈরী হতে
সাহায্য করে। পরবর্তীতে আমার ছেলে সাব্বির ও ইজিবাইক চালক আব্দুর রহিম
হুইলচেয়ার থেকে ইজিবাইকে উঠতে সাহায্য করে। বাসা থেকে ইজিবাইকে ফ্যাক্টরির
সামনে আসার পর ফ্যাক্টরীর নিরাপত্তাকর্মীর সাহায্যে ইজি বাইকের চালক আব্দুর
রহিম আমাকে পুনরায় ইজিবাইক থেকে হুইলচেয়ারে বসতে সাহায্য করে। পরবর্তীতে
ব্যাটারি চালিত হুইলচেয়ারে বসার পর আমি নিজেই ফ্যাক্টরীর ভিতরে প্রবেশ
করি।ফ্যাক্টরীর ভিতরে পর্যাপ্ত জায়গা থাকায় আমার মোটর চালিত হুইলচেয়ারটি
নিয়ে নীচতলার সর্বিক বিষয় সহজেই মনিটরিংকরতে পারি। অনলাইন যোগাযোগ
ব্যবস্থার জন্য কোম্পানি আমাকে একটি ল্যাপটপ দিয়েছে।চারতলা বিশিষ্ট
ফ্যাক্টরীটিতে কোনো লিফট না থাকলেও আমি বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্লোর মনিটরিং এর
জন্য ফ্লোর গুলি ভিজিট করতে পারি। তাছাড়া আমার সামনে সিসিটিভি
ক্যামেরাযুক্ত সার্বক্ষণিক দুটি মনিটর থাকে যার মাধ্যমে আমি সহজেই ফ্লোরে
চলমান বিভিন্ন কাজের বিষয়গুলো মনিটর করে থাকি।
সমাজের প্রতিবন্ধী
মানুষদের কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রতিকুলতা ও উত্তরণের উপায়-আমাদের সমাজে
প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
সমাজ এখনও প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। পারিবারিক ও সামাজিক
নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে
পড়ছেন। পাশাপাশি অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আর্থিক দুর্বলতার কারণে
পরিবারগুলো তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
প্রতিবন্ধী জীবনে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সরকারি এবং বেসরকারি
পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্টান প্রতিবন্ধীদের কর্মমুখী শিক্ষা, জীবনের মান উন্নয়ন
নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্টানগুলোর কাজের গতি-প্রকৃতি প্রতিবন্ধীদের কাজের
সুযোগ সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভ’মিকা রাখতে পারছে বলে আমি মনে করি না।
প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদেরকে কর্মমূখী করার জন্য আমাদের
মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। পরিবারকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে
হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করছে তাদেরকে আরো
গতিশীল ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী নিয়োগ করছে তাদের
সাথে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ যারা প্রতিবন্ধী মানুষদের মান
উন্নায়ন নিয়ে কাজ করছে তাদের একটি সমন্বিত, অত্যন্ত মানবিক ও আন্তরিক
আলোচনার ক্ষেত্রতৈরি করতে হবে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের জন্য
কাজের ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবন্ধীতার ধরন অনুযায়ী তালিকা
নির্ধারণ করেতারা কি কি কাজের জন্য উপযুক্ততা নির্ধারণ করে যথাযত
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে
সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এবং তাদেরকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে একটি
সুদৃঢ় ও পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা উক্ত
প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজে সংযুক্ত হয়ে কাজে কতটা সফল হচ্ছে সে বিষয়টিও
মনিটরিং করতে হবে। কারণ কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি কাজে সফল
হয় তাহলে সে প্রতিষ্টানে আরেকজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে উৎসাহ
বোধ করবে।আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি এভাবে যদি সকল পদক্ষেপগুলো
সঠিকভাবে বা¯তবায়ন করা যায় তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের ক্ষেত্রে সকল
প্রতিবন্ধকতা ধীরে ধীরে দুর করা সম্ভব।চাকুরীর পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের ধরন
অনুসারে আমরা অনেক প্রতিবন্ধীদের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের
স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারি যেমন কম্পিউটার, মোবাইল ও টেলিভিশনের
যান্ত্রিক ত্রুটির মেরামত ও নানামুখী অনলাইনভিত্তিক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে
আমরা তাদেরকে চাকরির পাশাপাশি ভিন্ন আয়োজনে আয়মূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত
করতে পারি এবং এই কাজগুল্্্ োপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঘরে বসে সহজেই করতে পারবে
যদি সে সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দিতে পারি।
সমাজের মূলধারার মানুষদের সাথে
প্রতিবন্ধী মানুষদের কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে আমাদের করনীয়ঃপ্রতিবন্ধীতার
নানাধরন যেমন-শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবন প্রতিবন্ধী,বাক
প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী,বহুবিধ প্রতিবন্ধীমানুষদের প্রতিবন্ধীতার
ধরন ও মাত্রার উপর ভিত্তি করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব আমাদের মূল
ধারার মানুষদের। কারণ যিনি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মী নিয়োগ করেন কিংবা
কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন তিনি অবশ্যই একজন পরিপূর্নভাবে সক্ষম মানুষকেই
কাজের জন্য চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু একজন প্রতিবন্ধী মানুষের পক্ষে
সুস্থ ও সক্ষম মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব
নয় সেহেতু প্রতিষ্ঠানের মালিকের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে একজন প্রতিবন্ধী
মানুষকে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে। আর তাই প্রতিবন্ধী মানুষকে কাজের
সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে কুমিল্লা ইপিজেডে আমার বর্তমান কর্মস্থল গোল্ডেন মুন
বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি
আলোকিত উদাহরণ হয়ে থাকবে চলমান সমাজের কাছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
থেকে মনে হয়েছে চলমান সমাজের যানবাহন, রাস্তা কিংবা আবাসস্থল
প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। বেশীর ভাগ অবাসস্থলে লিফট নেই। আবার কোন কোন
আবাসস্থলে লিফট থাকলেও হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। সরকারি,
আধা-সরকারি অফিস-আদালত, বিপনী বিতান গুলিতে সিড়ির পাশাপাশি রেমের ব্যবস্থা
না থাকায় হুইলচেয়ারে চলাচলকারী ব্যক্তিদের নানা অসুবিধায় পড়তে
হচ্ছে।হুইলচেয়ারের একজন মানুষ রাস্তায় কিংবা যানবাহনে চলাচল করবে সামাজিক
পরিবেশে এরকম এই দৃশ্য দেখতে সাধারন মানুষ অভ্যস্ত নয়। সমাজে নানা
প্রতিকূলতার মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষদের কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা
আমাদের মত সমাজের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বর্তমানে
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে উত্তরণের পথে। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ
প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা চিন্তা না করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে
গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি
বাংলাদেশের সরকার অবশ্যইউন্নয়ন কাঠামোতে প্রতিবন্ধী মানুষদের উন্নয়নের
বিষয়টি মাথায়রেখে সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেনসেই সাথে
প্রতিবন্ধীদের জীবন মান উন্নয়নে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ হবে একটি রোল মডেল।
লেখক-মেরুরুজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত হুইলচেয়ার সারভাইভার
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক: গোল্ডেন মুন বাংলাদেশ লিমিটেড, কুমিল্লা রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা