বাংলাদেশে প্রতিবছর রোগাক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা যায়, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই মারা যায় বায়ুদূষণজনিত কারণে। পৃথিবীতে যে কটি দেশ বায়ুদূষণের শীর্ষে রয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর পৃথিবীর রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হলো ইটভাটা ও যানবাহন।
বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কালো ধোঁয়ার ৩৮ শতাংশই নির্গমন হয় ইটভাটা থেকে। যানবাহন থেকে নির্গত হয় ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ইটভাটার অর্ধেক। দেশে বৈধ ইটভাটার তুলনায় অবৈধ ইটভাটাই বেশি। এগুলোতে ব্যবহার করা হয় সনাতন পদ্ধতির ড্রাম চিমনি, যেগুলোর দূষণ অনেক বেশি। এসব ইটভাটা শুধু বায়ুদূষণই করছে না, কাঠ পুড়িয়ে দেশের বৃক্ষসম্পদ উজাড় করে দিচ্ছে। টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে নিয়ে কৃষিজমির উর্বরাশক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু ইট পোড়ানোর আধুনিক পদ্ধতি কিংবা ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়ানোর জোরদার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
ইটভাটা নিয়ে দেশে নানা রকমের খেলা হয়। আইনে সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার দূরে থাকবে ইটখাটা। অথচ বাস্তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহু ইটভাটা। প্রশাসন থেকে সেসব ইটভাটা লাইসেন্স পাচ্ছে, লাইসেন্স নবায়নও হচ্ছে। একইভাবে লোকালয় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ইটভাটা তৈরির নিয়মও মানা হয় না। উচ্চ আদালত থেকে একাধিকবার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসন অভিযানও চালায়। ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, কিছুদিন পরই বিশেষ যোগসাজশে সেই ইটভাটাগুলো আবার চালু হয়ে যায়। ইটভাটা এমন ছোট কোনো জিনিস নয় যে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায়। অথচ বিভিন্ন সময় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কোনো কোনো জেলা বা উপজেলায় বৈধ ইটভাটার চেয়ে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৮-৯ গুণ পর্যন্ত বেশি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়ও ৩০টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে অনুমতি আছে মাত্র পাঁচটির, বাকি ২৫টি অবৈধ। অন্য এক খবরে দেখা যায়, কুষ্টিয়া জেলায় ইটভাটা আছে মোট ১৯১টি। এর মধ্যে ১৭১টিই অবৈধ। যেসব ইটভাটা শুরুই হয় অবৈধভাবে, তারা আর কি আইন-কানুন মানবে! অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে বৈধ ইটভাটা ছিল সাত হাজার ৮৮১টি। আর অবৈধ ইটভাটা ছিল এক হাজারের বেশি। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ হলেও দেশের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বা দেড় হাজারের বেশি ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হয়। তাদের তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার পরও প্রশ্ন থাকে যে হাজারের বেশি অবৈধ ইটভাটা চলে কী করে? ইটভাটার মাটি সংগ্রহ নিয়েও চলে নানা তেলেসমাতি। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রভাবশালী ইটভাটার মালিকদের কাছে দরিদ্র কৃষকরা নামমাত্র মূল্যে জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। রাতের আঁধারেও চলে মাটি কাটা। অনেক জায়গায় বাঁধ কেটেও মাটি নেওয়া হয়েছে।
আমরা চাই, দেশে ইটভাটাসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হোক। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হোক।