রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে চট্টগ্রাম নগরীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত রহমতগঞ্জ এলাকার যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি ভাঙার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নিয়ে ওই ভবনে এখন একটি বিদ্যালয় চলছিল। আদালতের আদেশের কথা বলে সোমবার এক ব্যক্তি বুলডোজার নিয়ে সদলবলে এসে বাড়িঠি ভেঙে ফেলতে গিয়েছিলেন।
প্রতিরোধের মুখে জেলা প্রশাসন এসে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সিলগালা করে জানায়, এ ভবনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
এই জমিটির বিষয়ে আদালতের আদেশ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত; তিনি বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানিয়েছেন।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।
ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছু দিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি।
আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের।
এরপর নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ফিরে দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে।
১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি লিজ বা ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে।
১৯৭৫ এর পর নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে এম ফরিদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির দুই ছেলে ফরহাদ ও ফয়সালসহ একশ’র মতো লোক আসে। তারা বলে আদালতের আদেশ নিয়ে বাড়িটির দখল নিতে এসেছে তারা।
এসময় সেখানে প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ ‘দখল পরোয়ানা’সহ কাগজপত্র নিয়ে ছিলেন।
ফরহাদ ও ফয়সালের সঙ্গে যুবলীগ নেতা পরিচয়দানকারী গিয়াস উদ্দিন সুজন ও মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ৫০ জনের মতো তরুণ ও শ্রমিক স্কুলে ঢুকে পড়ে।
শিশুবাগ স্কুলের পরিচালক এফ এম নাসের টিপু জানান, তারা স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের ধাক্কা দিয়ে স্কুল ভবন থেকে বের করে দেয়। স্কুলের আসবাবপত্র বের করে সামনের মাঠে রেখে আসে। তিনি প্রতিবাদ জানালে তাকেও বের করে দেওয়া হয়।
পুলিশ সদস্যরা ফরিদ চৌধুরীর পক্ষে আদালতের নির্দেশনা আছে জানিয়ে বাড়ির দখল তাদের বুঝিয়ে দেয়, মূল ফটক দেয় বন্ধ করে।
এর আধ ঘণ্টা পর পুলিশ সদস্যরা সবাই চলে গেলে সেখানে আসে একটি বুলডোজার। বুলডোজারটি দিয়ে ভবনের সামনের অংশ ভেঙে ফেলা হয়।
খবর পেয়ে বেলা ২টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
তার সঙ্গে জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনসহ আরও অনেকে ছিলেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, “ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি কীভাবে ভাঙা হল? কারা এটি ভাঙল? এই বুলডোজার কার?”
তিনি ভবনটির সামনে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন। স্থানীয়রা তার সঙ্গে যোগ দেয়।
নিজেকে ফরিদ চৌধুরীর মেয়েজামাই পরিচয় দিয়ে যুবলীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন সুজন তখন রানা দাশগুপ্তসহ প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা জেলা প্রশাসনের কোনো আদেশ নিয়ে আসেন। না হলে আমরা বুলডোজার চালাব।
সুজন, ফরহাদসহ তাদের সঙ্গে থাকা লোকজন তখন বলতে থাকেন, ‘রানা দাশগুপ্তকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও’।
তারা বুলডোজারটি আবার চালু করতে গেলে রানা দাশগুপ্ত ও সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ তার সামনে দাঁড়িয়ে যান।
প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, ‘এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ, কাউকে এই ভবন ভাঙতে দেওয়া হবে না’।
১০ মিনিট পর সেখানে আসেন চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলিউর রহমান, আন্দরকিল্লার সাবেক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, ছাত্র ইউনিয়ন জেলা কমিটির নেতারা এবং চট্টগ্রাম বিপ্লব ও বিপ্লবী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। তারাও প্রতিবাদে সামিল হন।
খবর শুনে হাজির হন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি, বাকলিয়া) আশরাফুল হাসান। তখন আদালতের আদেশ থাকার কথা জানিয়ে সেই নথিপত্র দেখান সুজন।
নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে সহকারী কমিশনার আশরাফুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “জমিটি সরকার লিজ দিয়েছে। ইজারা দেওয়া জমির বিষয়ে আদালতের কোনো আদেশ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা এখন তালাবদ্ধ করে যাব। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাব।”
এই সিদ্ধান্তের পর রানা দাশগুপ্ত ঘোষণা দেন, “আমরা এখন চলে যাব। জেলা প্রশাসন পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন।”
যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জমি নিয়ে জারি মামলা করে বাদী উচ্ছেদ আদেশ নিয়েছেন। আজ পুলিসসহ যাবে বলে আগে থেকে দিন নির্ধারিত ছিল। আমি দখলি পরোয়ানা পৌঁছে দিতে গেছি।
কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আখন্দের উপস্থিতিতে ওই জায়গার দখল জারি করার জন্য নগর পুলিশের বিশেষ শাখার মাধ্যমে ফোর্স চাওয়া হয়েছিল। সেখানে পুলিশ লাইন্স থেকে ফোর্স এবং কোতোয়ালি থানার কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
শিশুবাগ স্কুলের পরিচালক নাসের টিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জমিটি আমরা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছি। ১৯৭৭ সালে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ওয়ারিশ মিলন সেনগুপ্তর কাছ থেকে আমার বাবা নয় গণ্ডা জমি কিনে নেন।
“এম ফরিদ চৌধুরী জমি মিলন সেনগুপ্তর কাছ থেকে কিনেছে বলে দাবি করলেও তারা মামলা করেছিলেন। ফরিদ চৌধুরী একটি ডিক্রি নিয়েছেন। পরে জারি মামলা করেছে।”
তার আইনজীবী মো. শাহজাহান বলেন, “তাদের প্রথম জারি মামলা খারিজ হলেও তামাদি আইন না মেনে আবার জারি মামলা করেছে। আমরা আদালতে আবেদন করেছি। শুনানি আগামীকাল (মঙ্গলবার)।”
তিনি বলেন, “উচ্ছেদের কোনো নোটিস আমরা পাইনি। স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের গায়ে তারা হাত তুলেছে। স্কুলে পাঁচশ শিক্ষার্থী আছে।
ফরিদ চৌধুরী ছেলে ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বাবা ১৯৮০ সালে মিলন সেনগুপ্তর কাছ থেকে জমিটি কিনেছে। ২০০৫ সালে আমরা আদালতে যাই। গত তিন বছর তারা আমাদের বিভিন্ন পিটিশন দিয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা আদেশ পেয়েছি।
প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর যে ভাগ্নের কাছ থেকে তারা জমি কিনেছে বলে দাবি করছে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
“জমিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার লিজ দিয়েছে। সরকারকে না জানিয়ে মিলন সেনগুপ্ত জমি বিক্রি করেছে মর্মে দলিল তৈরি করেছে এম ফরিদ। অপকৌশলে তারা একটি আদেশ এনেছে।
“আমরা এই স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির সংরক্ষণ চাই,” বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. অনুপম সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাড়িটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত। কেউ চাইলেই এরকম একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা যায় না। বাড়িটি বহু বছর ধরে বেদখল হয়ে আছে। সরকারের উচিত ঐতিহ্য হিসেবে এটিকে সংরক্ষণ করা।
আড়াইশ বছরের প্রাচীন বাড়িটি রক্ষার দাবিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি সংরক্ষণ পরিষদ।