বলছিলাম মৃৎশিল্পের ধারক, মাটির তৈজসপত্রের ফেরিওয়ালা চিত্ত দেবনাথের কথা। আজ তাদের মৃৎশিল্পে দুর্দিন!
সরজমিনে গতকাল শুক্রবার সকালে নবীনগর পৌর ভোলাচং কোনাঘাটের পাশ দিয়ে যাবার সময় নেমে ঢুকে পড়লাম কুমারপাড়ায়। গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ -হাজার বছরের পরিচিত এমন অসংখ্য শ্লোক ও শব্দগু”ছ গ্রামবাংলার সমৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে। কিš‘ আধুনিকতার নামে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন ও কালের বিবর্তনে এসব এখন রূপকথার গল্পে পরিণত হ”েছ।
নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র গ্রামেই তৈরি হতো। এর জন্য বিভিন্ন পেশা চিহ্নিত ছিল এবং সেসব পেশার মানুষ সেভাবেই পরিচিতি পেতেন। আর সেসব জিনিসপত্রে থাকতো অসাধারণ সব কারুকাজ। জৌলুস নিয়েই টিকে ছিল এসব শিল্প। কিš‘ আজ সেসব বিলুপ্তির পথে। সেসব পেশার মানুষেরও দৈন্যদশা।
তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প মাটির বাসন-কোসন। জৌলুস হারানো আদি মৃৎশিল্প বাঙালির কৃষ্টি আর ঐতিহ্যে একাকার হয়ে আছে। এ শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে প্রাচ্যের অগণিত মানুষের জীবন-জীবিকাও।
আদি এই শিল্পের ধারক বাহকরা বংশ পরম্পরায় জীবিকার তাগিদে এবং বংশের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নিজেরাও যেন আজ দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পড়ে ক্রমশ বিত্তহীন হয়ে পড়ছেন।
মৃৎশিল্পের উৎপাদন ও বিপণনে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই যাপন করছেন মানবেতর জীবন। এমনই একজন চিত্ত দেবনাথ। ছেলেবেলা থেকেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন মৃৎশিল্পের সঙ্গে। তবে, উৎপাদনের সঙ্গে নয়, বিপণনে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগর উপজেলার পৌর ভোলাচং গ্রামের প্রয়াত হরিশ দেবনাথের ছেলে চিত্ত দেবনাথ। ৬০ বছরের চিত্ত চার সন্তানের জনক।
যুবক চিত্ত একদিন কাঁধে তুলে নেন মাটির হাঁড়ি-পাতিলের টুপরি (ভাড়)। ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। হাঁক ছেড়ে বলেন, ‘রাখবেননি গো পাইলা...তাওয়া...হরা....।’
জীবিকার তাগিদে হাঁড়ি-পাতিলের বোঝা বয়ে বেড়ানো চিত্তর নিত্যনিয়ম হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে দিনের পর দিন...বছরের পর বছর...গ্রামের পর গ্রাম...পাড়া মহল্লার অলিগলি ঘুরে ঘুরে গৃহিণীদের তৈজসপত্রের চাহিদার যোগান দেয়া চিত্ত আজ ক্লান্ত।
বয়স বেড়েছে, শরীর ভেঙে পড়েছে, থেমেছে পথচলাও। সংসারের আকার বেড়েছে কিš‘ বাড়েনি রোজগার। এদিকে নিজের অজান্তে রক্ত মাংসের সাথেই যেন মিশে গেছে মৃৎশিল্প। তাই নিজে কর্মক্লান্ত হলেও ততোদিনে জীবন আর পেশা যেন একই সুতোয় গাঁথা হয়ে গেছে।
আবহমান কাল ধরে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা একটি লোকজ উৎসবের নাম বৈশাখী মেলা। মেলা মানেই বাহারি পণ্যের সমাহার, মেলা মানেই মৃৎশিল্পের পসরা। মেলার একটি বিশাল অংশজুড়ে থাকে মাটির তৈরি রকমারী খেলনা ও তৈজসপত্র। মৃৎশিল্পকে বাদ দিয়ে মেলার কথা যেনো কল্পনাই করা যায় না।
আজকাল কিছু সৌখিন লোকের কল্যাণে মৃৎশিল্প গ্রামীণ লোকজ মেলার গল্লি পেরিয়ে এসেছে শহরেও। তবে, তা নিতান্তই সৌখিনদের দু’চারটি ফুলের টব, ফুলদানি আর টেরাকোটাতেই সীমাবদ্ধ। তবে এতেই চিত্তর কিছুটা ভরসা।
চিত্ত ছাড়তে পারেননি মৃৎশিল্পের লোভ। মাটির গন্ধ যেন তাড়া করে বেড়ায় তাকে। এই বয়সেও ¯ি’র করলেন, গ্রামেগঞ্জে না ঘুরে বাজারে একটি মৃৎশিল্প সামগ্রীর দোকান খুলে বসবেন। যেই কথা সেই কাজ।
চিত্ত নবীনগর ভোলাচং বাজারের আর দশজন ব্যবসায়ীর মতোই একজন। তবে অন্যদের চাইতে তার ব্যবসার ধরণ ভিন্ন এবং তার পণ্যের চাহিদাও কম। এখন বাজার দখল করে নিয়েছে বাহারী ধাতব ও প্লাস্টিক সামগ্রী। রিতিমতো এসব ধাতব ও প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যাপক প্রসারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে পরিবেশ বান্ধব এই আদি শিল্পটির ওপর!
সহজলভ্য সৌন্দর্য এবং সর্বোপরি টেকসইয়ের দিক বিবেচনায় মানুষ প্রতিনিয়তই পরিবেশ বান্ধব আর ঐতিহ্যের কথা ভুলে ঝুঁকে পড়ছে ওই সমস্ত বাহারী সামগ্রীর প্রতি।
সমাজের উঁচু তলার বাসিন্দাদের বাড়ির শোভা বর্ধনকারী মাটির তৈরি ফুলের টব, টেরাকোটাজাতীয় বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া এখন আর আগের মতো কেউ মাটির সামগ্রীর ওপর নির্ভর করেন না।
মাটির সামগ্রী বিক্রেতা চিত্ত দেবনাথ বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে দোকান নিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকি, কিš‘ বেচাকেনা নাই দাদা। দৈনিক এক-দেড়শ’ টেহা বেচি, তা দিয়ে কি সংসার চলে দাদা ? দিনের বেশিরভাগ সময়ই অলস বইয়া থাহি। বছর শেষে ৫ হাজার টেহা দোহান ভাড়া ঠিকই দেওন লাগে। আর আমরা বেচতে না পারলে কুমাইরারা (মৃৎ শিল্পীরা) ক্যামনে বানাইব ?’
আক্ষেপ করে চিত্ত বলেন, ‘হের লাইগা আমার দুই পুলারে (ছেলে) সোনা রূপার কাম হিখাইতাছি (শিখা”িছ)।’
মৃৎশিল্পের অব¯’া সারাদেশে একই। তবে, চিত্তরা এখনো স্বপ্ন দেখেন সুদিনের, হারানো জৌলুস ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা আর বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৃতপ্রায় মৃৎ শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন তাদের। উ”চবিত্তের শিল্প রসিকতার নামে বিলাসিতার মধ্যে হলেও হয়ত এই গরীব শিল্পীরা শেষ পর্যন্ত বাঁচার আশা পাবেন।