ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়
Published : Sunday, 10 January, 2021 at 12:00 AM, Update: 10.01.2021 12:31:15 AM
গুলতির মার্বেল

রবিবাসরীয়কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||

শোনো, একবার হল কি, আমি ঘাস কাটতে গেছি। গাই গরুটা অনেক দিন ঘাস ছাড়া। আমাদের জনু সর্দারের খেতের আইল। বোরো চাষের জমি। স্যালু মেসিনের পানি। পানির ছোঁয়া পেয়ে ঘাসও হয়েছে লকলকিয়ে। এমন ঘাস অনুমতি না নিয়ে কাটা চুরির সামিল। জনু সর্দার ধরে নিল আমি গোছা গোছা চারাধান কেটে নিচ্ছি। সর্দার এবং তার দুই ছেলে আলো আর জসো। বাপ বেটা তিনজন। গরুমারা বেত দিয়ে তারা আমাকে লাগাল বেদম মার।

আমি মারের ঠেলায় একবারে মাগো বলে চিক্কুর দিয়ে উঠলাম।

জনু সর্দার বলল, ‘ধর শালার বেটারে ধর।’

ঝাঁপি কাঁচিসহ আমাকে এনে তাদের লিচু তলায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। লাথি মেরে ঝাঁপি উল্টে দিল। কিন্তু ঝাঁপিতে ঘাস ছাড়া অন্য কিছু পেল না। আমি তো চারা ধান কাটিনি। আরও দু চারটা চড় কষে আমাকে ছেড়ে দিল। আমার কাঁচি ঝাঁপি তাদের লিচু তলায় পরে রইল। দুই দিনে কাঁচি ঝাঁপির টান মরে গেল। ভুলে গেলাম।

টানা বিড়ি চলল। রিয়াজ বিড়ি। বৃহস্পতি বার গরুবাজার। সপ্তায় একদিনের বাজার। বাজারে নিয়ে গরু বিক্রি করে দিলাম। বাড়ি ফেরার পর বউ জিজ্ঞেস করল, ‘গরু কই’। বললাম, ‘বিক্রি করে দিছি।’ বউও যেন কিছুক্ষণ মাগো মাগো করল।

 বউ বলল, ‘এখন কি করবা ?’

‘দেখ কি করি।’

নিজে নিজের অপেক্ষায় রইলাম।

পাশে নাজির বাড়ি। দেয়াল ঘেরা বাড়ি। ওরা সম্পর্কে আত্মীয়। এ বড়িতে চুরি করার ইচ্ছা আমার যতবার জেগেছে ততবার নিজেকে সামলিয়েছি। নাজির সাহেবের ছেলে মাসুদের প্রতি আমার একধরনের টান রয়েছে।                                               আমার হাতের নিশানা খুব ভালো।  নাজির সাহেবও জানেন। কোনদিন চাক্ষুষ দেখেননি। নাজির সাহেব খুব ভালো মানুষ। পাঞ্জেগানা নামাজি। আমার সঙ্গে  একশ একটা শয়তান। সুযোগ পেলে সুঁচের পাছায় কুড়াল ...। নাজির সাহেবের ছেলে মেয়েরা অধিকাংশ সময় বাড়ির ভেতর থাকে। প্রয়োজন ব্যতিত

বের হয় না। তারা শুধু লেখা পড়া... ।

এক রোববার বিকালে নাজির বাড়িতে এমনিতে ঢুকে পড়লাম। রোববার তখন সরকারি ছুটির দিন। নাজির সাহেব বাড়িতে ছিলেন। বাড়ির গেইট খোলা ছিল। নাজির সাহেব নিজের সরকারি বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন। লাইসেন্স করা দু নলা বন্দুক।  আমার হাতে গুলতি। সঙ্গে দুটি মার্বেল। চিনা মার্বেল। সাদা রঙের। ঠিক বাচ্চা কবুতরের বন্ধ করা চোখের পর্দা। একবারে সাদা না। পোড়া মাটির গুলিও ব্যবহার করি। গুলির জন্য উইঢিবির মাটি উপযুক্ত। বাড়িতে ঢুকেই নাজির সাহেবের দিকে মনোযোগ দিলাম। নাজির সাহেব আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘কী খবর ?’

আল্লাই জানেন তিনি কী খবর জানতে চান। আমার হাতের গুলতির দিকে তার নজর গেল।

বললেন , ‘তোর হাতের নিশানা নাকি খুব ভালো।

 ‘এই সামান্য।’

 ‘তাহলে প্রমাণ দে। তারপর দেখা যাবে সামান্য না কি অসামান্য।’

কি প্রকারে প্রমাণ দেই। কিছু একটা খুঁজতে লাগলাম।

পেয়েও গেলাম। নাজির বাড়ির পেছনে ছিল ছোট খাট একটা বাঁশবন। মাঝ বরাবর একটি মরা বাঁশ। পাতা নেই ছাঁটা আছে। ছাঁটার মাঝে বিগত খানিক শুকনা ডগা। সাধারণত মরা বাঁশের ডগা থাকে না। ডগায় বসা ছিল একটি বাদামি চড়–ই। নাজির সাহেব কে বললাম, ‘এই চড়–ইটা।’ তিনি তাকালেন। দূরত্ব এবং চড়–ইয়ের আকৃতি দেখে নিশ্চিত হলেন আমি পারব না। কিন্তু মুখে বললেন, ‘লাগাও।’ ওনার কথায় আরও বুঝলাম চড়–ই তো মারতে পারব না, পারলে দশবারে মরা বাঁশের ডগা সই কর। সঙ্গে সঙ্গে বায়না ধরলাম,‘মারতে পারলে কী দিবেন?’

তিনি কোন প্রকার চিন্তা না করে বললেন, ‘এই বন্দুকটা।’

 আমার কলজে ধক করে ওঠল। এই বন্দুক আমার পেতেই হবে। একদিনের জন্য হলেও। জনু সর্দারকে দেখিয়ে দেব নাজির সাহেবের সঙ্গে আমার কেমন খাতির। জনু সর্দারের ধানিজমিনের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় বকের ঝাঁক নামে। ওখানে বন্দুক নিয়ে যেতে পারলে হল।

আগামি কোন একদিনের স্বপ্নের ভেতর এ বন্দুক ঝুলে রইল। আমি নিশানা ঠিক করলাম। নাজির সাহেব বন্দুকে নিমগ্ন। দৃষ্টি সরালেন না। ভাবটা এমন , পারবি না তো , চেয়ে কী হবে। আমিও ওনাকে আমার দিকে তাকাতে বললাম না। ধ্যান মন এক করে গুলতি তাক করে মার্বেল ছুঁড়লাম। তারপরও নাজির সাহেব চোখ তুলে তাকালেন না। আমি বাঁশ বনে ঢুকে চড়–ই হাতে নিয়ে নাজির সাহেবের বন্দুকের সামনে এনে রাখলাম।

 নাজির সাহেব মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি হাসছিলাম। হাসি থামিয়ে বললাম, ‘দেন।’

নাজির সাহেব বললেন, ‘ জানিস এটা সরকারি বন্দুক।’

 বললাম, ‘ আপনি বলেছেন দিবেন।’

তিনি বললেন, ‘এটা দিলে আমার নাজিরগিরি চলে যাবে।’

বললাম, ‘আপনি পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন।’

তুই দাঁড়া বলে তিনি বন্দুক নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন এবং ফিরে এসে একটা একশ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘বিপদে আপদে আমাকে স্মরণ করবি।’

 আমি টাকা নিলাম কিন্তু নাখোশ মনে বের হলাম।

 বন্দুক চিন্তা আমার মগজে সুরঙ্গ কেটে ঢুকে গেল। জনু সর্দারের লিচু তলায় পড়ে থাকা ঘাসের ঝাঁপি আমার বুকের উপর ঘাসসহ চেপে রইল।

চাপ থেকে আমার বুকচিরে মাগো ডাক বের হলে প্রায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। জনু সর্দারের সঙ্গে আমি লড়ে পারব না। কিছু একটা করতে হবে। অপেক্ষায় রইলাম আরও কিছু দিন। খোঁজ খবর নিতে লাগলাম।

এক রাতে ফজর ওয়াক্তের আগে নাজির বাড়ির দেওয়াল টপকালাম। নাজির সাহেবের স্ত্রী ওজু করেন গোসলখানায়। তাদের গোসলখানা লম্বা বারান্দার শেষ মাথায়। আমি খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে আলমারির ভেতর থেকে পাট্টা ধরে   ¯্রফে নখের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ সামান্য টান দিলে পাট্টা খুলে যাবে। বাঁচতে পারা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। কখন নাজির সাহেবের স্ত্রী ওজু শেষে নামাজে দাঁড়াবেন অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেই সঙ্গে বন্দুকের চিন্তা। গুলি গালার দরকার নেই। বন্দুক হলেই চলবে। কিন্তু বন্দুক কোথায় আমি জানি না। বের হয়ে খুঁজতে গেলে নিশ্চিত ধরা ।

প্রবেশের সময়ই আমি আকাশ দেখেছি। আকাশে তখনও সুবেহ সাদেকের রেখা দেখা দেয়নি। আবছা আবছা অন্ধকার। এ অবস্থায় বাড়ির লোকজন জেগে উঠলে আমাকে ধরতে পারবে না। নাজির সাহেব যদি বন্দুক নিয়ে বের হন রেঞ্জের মধ্যে পেলে গুলি করে দিবেন। বুক ডিব ডিব করতে লাগল। শব্দ পেলাম। বুঝলাম নাজির সাহেবের স্ত্রী ওজু শেষে ঘরে এসেছেন।

সময় নিয়ে পাল্লা সামান্য ফাঁক করে দেখতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম, তিনি মশারির নিচে বসে নামাজ আদায় করছেন। ফজরের আজান যেহেতু এখনও দেয়া হয়নি নিশ্চয় তাহাজ্জতের নামাজ পড়ছেন।

আমার বের হওয়ার পালা। বন্দুক পাই বা না পাই বের হতে হবে। যেই বের হতে যাব চোরা ভাগ্যের দরজা খুলে গেল।

যেন বন্দুক বলে ওঠল, ‘আমাকে নিয়ে যা। এতে তোর সামান্য হলেও অধিকার আছে। বাঁশের আগায় বসা চড়–ই পাখি তুই এক গুলিতে মেরে ছিলি। নাজির সাহেব একশ বার চেষ্টা করলেও মারতে পারতেন না। অবশ্য নাজির সাহেব সারা দিন তোর মত গুলতি নিয়ে নিশানা প্র্যাকটিস করে না। তোর ভাগ্য ভালো চড়–ইটা মেরেছিলি। নিয়ে যা আমাকে। চাঁদ কপাল তোর। আমাকে সিন্দুকে রাখে। গত দুই দিন আলমারিতে আছি। নাজির সাহেবের কোন এক বন্ধু শিকারে যাবেন।

আমি বন্দুকের টুটি চেপে ধরলাম। ‘চুপ রও।’

তারপর দুই তিন টক্কে আমি নাজির বাড়ির সীমানা পাড় ।

আমি জানি এ কাজের উপহার পেয়ে যাব। আজকের মধ্যে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করবে। প্রথমে গোপন কাজ সেরে নিলাম। বউকে ঘুম থেকে তুলে বললাম, ‘গাট্টি বোচকা গোছাও। কোন কথা জানতে চেয়ো না। বউয়ের সেই মাগো চাহনি।’ বউ বিপদ আঁচ করতে বিলম্ব করল না। বাপের বাড়ি  নদীর ওপাড়ে। অসুবিধা নেই। দু’বাচ্চা দু’বগলে  চেপে চম্পট ।

যা যাবে আমার উপর দিয়ে যাবে।

ঠিক দুপুরে পুলিশসহ নাজির সাহেব হাজির। আমিও তাই চেয়েছি। পুলিশ আমাকে দু হাত পিছনে রেখে বেঁধে ফেলল। দুই হাতের বাহু পিছনে টেনে বাঁধলে বুকটা সামনে বের হয়। আমার বুকও বের হয়ে আসল। চোরের সিনা ফুলানি। লোকজন দেখছে। সিনা ফুলা চোরকে। পুলিশ ফুলা সিনায় জোরছে থাপ্পর মারে। তবে আমাকে মারল না। বুঝলাম নাজির সাহেবের ইশারা আছে।

আমার ঘর তছনছ করা হল। শূন্য গোয়ালও দেখা হল। বন্দুক পাওয়া গেল না।

নাজির সাহেব বললেন ,‘শহিদু, বন্দুক কোথায়।’

 বললাম, ‘আমাকে থানায় নিয়ে চলেন।’

পুলিশ মাইর দেয়ার ভঙ্গিতে অনুমতি চাইল। নাজির সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে থানায় নিয়ে চল।’

 থানায় নাজির সাহেবও এলেন।

‘বল বন্দুক কোথায় ?’

‘বন্দুক আমি নেইনি। বন্দুক কে নিয়েছে তাকে আমি চিনি।

 নাজির সাহেব বললেন, ‘কে নিয়েছে ?’

 বললাম ‘জনু সর্দারের ছেলে।’

 ‘কোন ছেলে ?’

‘আলো জসো দু জনে।’

 নাজির সাহেব আমার কথা নিমেষে উড়িয়ে দিলেন।

‘শহিদু, মিথ্যা কথা বলছিস।’

আমি বললাম, ‘মিথ্যা হলে আমাকে যে শাস্তি দিবেন আমি  মেনে নিব।’

 নাজির সাহেব জানালেন তিনি আর কিছু বলবেন না।

 আমি ভয় পেলাম । এবার নিশ্চয় আমার কপালে ডা-াপেটা আছে। পুলিশ নাজির সাহেবকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে ছুটল। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম ‘আল্লাহ ,নাজির সাহেবকে থানায় রেখ। কোথাও যেতে দিয়ো না।’

আমি পুলিশকে জনু সর্দারের বাড়ি দেখিয়ে দিলাম। পুলিশ এসে জনু সর্দার ও তার দুই ছেলেকে তাদের উঠানে দাঁড় করাল। তাদের মধ্যে কোন ভয় নেই। পুলিশ বলল, ‘নাজির সাহেবের বন্দুক চুরি হয়েছে, আমাদের কাছে তথ্য আছে এ বন্দুক আপনারা নিয়েছেন এবং  বন্দুক এ বাড়িতে আছে। বন্দুক বের করে দিন।’

বাপ পুত তিন জনে পরস্পরের মুখ দেখতে লাগল। আমি পুলিশকে বলেছি তাদের ঘরের সিলিং দেখতে। বন্দুকটা সিলিংয়ে আছে।

পুলিশ প্রথমে তাদের ঘর তল্লাশি করল। পাওয়া গেল না। বাপ বেটা তিনজন নির্ভার। আমার দিকে যতবার তাকিয়েছে ততবার বাঘের দৃষ্টি দেখলাম। পুলিশ না থাকলে আমাকে খেয়ে ফেলত। পুলিশ ঘর তল্লাশি শেষে সিলিং তল্লাশি করল। বন্দুক পাওয়া গেল। দৃশ্য পাল্টে গেল। পুলিশ বাপ বেটা তিনজনকে বেধড়ক পিটাল।

 নাজির সাহেব সঙ্গে থাকলে এ কাজ পুলিশ করতে পারত না। আমাকেসহ চারজনকে গাড়িতে তোলা হল। পুলিশ আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘ব্যাটা,  তুমি এসব জান কি করে ?’

 আমি কি করে জানি তা বলব কেন?

তোমরা কি নাজির সাহেবের ছেলে মাসুদুর রহমানকে চেন। তোমরা পুলিশ। চোখ থাকলে দেখতে পেতে। সিলিংয়ের ধুলাবালিতে চিহ্ন রয়েছে। বাহির থেকে ঠেলে দেয়ার চিহ্ন। বন্দুক আমি বাহির থেকে সিলিংয়ে ঠেলে দিয়েছি।

 আমার মনে কোন ভয় নেই। নাজির সাহেব বলেছেন বিপদে পড়লে তাকে স্মরণ করতে।

সমস্ত কিছু শোনার পর নাজির সাহেব থানার বাইরে এনে আমাকে রাগত কণ্ঠে বললেন, ‘শহিদু, তাদের ফাঁসালি কেন?’

আমি বললাম, ‘আপনি ভুলে গেছেন। আপনার ছেলে মাসুদুর রহমানকে যখন পাকিস্তানি পুলিশ খুঁজছিল তখন জনু সর্দার খবর সাপ্লাই করছিল। আপনার বাড়ির উঠানে মাসুদের তিন আলমারি বইয়ে পাকিস্তানি পুলিশ আগুন দিয়েছিল। সব ভুলে গেলেন ? আপনি তো জেলা নাজির হয়েও কিছু করলেন না।’

 নাজির সাহেব থম মেরে গেলেন।

 

 

 এক গুচ্ছ কবিতা

সৌম্য সালেক

 

অভিঘাত

 

মহার্ঘ বাসভূমি ছেড়ে সারা জীবন তোমার মনটা পরিযায়ী পাখির মতো যেখানে অবিরাম পাখা ঝাপটায়, আমার বিশুষ্ক আত্মার অগ্নিপাত সেখানে এক মারাত্মক লুটতরাজে মেতে উঠবে; এই অশ্বখুরধ্বনি তোমাকে জাগাবে না জেনোÑ আর সেখানে জলের হাহাকার নগ্ন গোধূলিতে মরে পড়ে আছে আর সেখানে মধুমাছি ফুলের বদলে একেকটা  স্তন ফুটে আছে, তবু দামাল বাতাসের বুকে অমূল্য আস্বাদ ভালোবেসে পাখিরা কি কোনদিন উড়ে যাবে না ...

 

এই অভিঘাত, এই অশ্রু-নিরোধ বুকের হেরেম খুলে লুপ্ত-প্রণালী পথে ফিরে যাবে শীর্ণ-চরায় আর তুমি পাথরে পাথরে ফেলে যাবে দীর্ঘশ্বাস আর তুমি বেভুল-গ্রন্থি ছিঁড়ে ঝরে যাবে গোলাপ শবরী

খুনসুখী, তুমি কত বিপুল মেনেছো হার; রক্তচর্মনীলÑ গুচ্ছপালক এঁটে...

 

 

আক্রান্ত শব্দগুচ্ছ

 

একগুচ্ছ লাভের আগুন বয়ে ট্রেনটা লোকসুদ্ধ সড়সড়

ঢুকে যাচ্ছে রাতের গহ্বরেÑ দগ্ধ তৃষ্ণার কোনো অন্ধপথ ছুটে।

আঁধারের বাঁধ কেটে বিধি ও বিশ্বাস মতো জোনাকি খুলতে লাগে

ফাঁদÑ আধো আধো অরণ্য কিনারে। আমিরুল, তবে কি স্বপ্নই

সারাৎসার বিগত ভ্রমণব্যাপী মহামূল্য পাথর পাহাড় আর

পুরাতন হাড়ে হাড়ে! ঈশানের সিক্ত আলোকে তবে কি

ভাসবে না বঙ্কিম নদী, ফসলের মাঠ, ঘাসের শরীর

দিন কি এগুবে রাত সয়ে সয়ে!

 

হেমন্ত বুনে গ্যাছে শীত, কিছু শীত নিজেই মেনেছি

আমিরুল, ফুদিয়ে আগুন জ্বালোÑ একচাল, ঊর্ধ্বমুখী...

 

 

বনসাই সংস্করণ

 

দু’চারজন অভ্যাগত আর আমাদের ঘরবাসিরার বিনোদনে সঙ্গ দিতে গিয়ে এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলি বেঁচে চলছে বছরকে বছর ।

পানির উদ্দাম তোড় লেগে লাফিয়ে উঠার কথা তারা ভুলে গেছেÑ ভুলে গেছে বুকেবুক সঙ্গকামÑ তারা যেন নতুন এক বনসাই সংস্করণ!

দেখি, চলনীতি ভুলে ছুটছে একটা মাছÑ মাথাটা দেহ ছাড়িয়েছে অন্যটারÑ ঘুরতে ঘুরতে অন্ধ হয়েছে আরেকটা মাছ। বাঁচতে বাঁচতে হাঁফিয়ে উঠেছে ওরা, মাছগুলি মরতে চায় অথচ ফাঁসিটা বাঁধবে কেÑ লোক নেই, বিষ নেই, মন্ত্র নেই

কী নির্মম বেঁচে যাওয়া !

 

 

 

 

নগর রাখাল

 

সামনের সপ্তায় আর বাড়ি যাচ্ছি না রাসু। জানি কারো চিৎকারে হঠাৎ সুন্দর স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা বিস্ময়ে তুমি বলবে, ‘এ তোমার কেমন কথা, একেবারে মায়াশূন্য’।

 

শুনেছি আমাদের গ্রামে নাকি চুরি হয়েছে। একেবারে হার্মাদি ঢঙে শেষবার ওরাÑ গোয়াল ঘরের গরু, পুকুরের মাছ, নদীর পানি, আর শুদ্ধসুরের গানগুলি নিয়ে গেছে। আমার চতুর্দিকে চোখ ধাঁধাঁনো কৃত্রিম আয়েশÑ ঐতিহ্য মেশানো লোকাচার নেইতো কি জন্যে সেখেনে যাবো? তাছাড়া যত্রতত্র বাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় থেমে গেছে দেহবাসের বাতাসÑ আমিতো এখন কলের বাতাসে কল্পনা করতেও অভ্যস্ত !

 

তার চেয়ে বই খুলিÑ খেয়ে আসি ফার্সি কবিতার শরাব, ঘুরে আসি প্রাচীন গ্রীস, হরপ্পা নগর কিংবা  মেসোপটেমীয় সভ্যতার কুঁড়েঘর। মনে বাতাস দিলে দেহকে বলতেই হবে বেঁচে আছি অন্তত রাখালের কাতারে। মেষ নাই, বাঁশি নাইÑ রাখাল! রাস্তার ধূলি মেখে হাঁটরে রাখাল...

 

 

 

 

 

 

 

 

আত্মখুনের স্কেচ           

 

ছিঁড়ে গ্যাছে গাঁথনি, খিলান

চাক ভেঙে মধুÑ নখে, পিঠে, বৃন্তে, ধূলিতে

রোদ ও রাগিণীর জ্বরে পাথর ছুঁয়েছে বুক

দুলতে লাগে হাওয়াই ভেসেল...

 

তারও ছিলো স্বপ্নমেঘ, ডানাপর্ব, অনন্ত তারাবীথি

তীর্থফুলে পাপড়ির গন্ধচেতনা

 

দীর্ঘ দেহবাস ভুলেÑ রক্তজবা চোখ

পার্শ্বপৃথিবী কাঁপে গমগম

ইথারে ইথারে ধোঁয়া, পাপ ও অনুতাপ

 

ছেঁকে-ছেনে ঘন  সবুজ মিলে

মিলে যদি রাগমুক্তিÑ

ঊষার নৌকাপালে

আরো নীল গুচ্ছগোলাপ...