বাজারে যখন দেশি পেঁয়াজের আকাল ছিল, তখন বিকল্প হিসেবে বিদেশি পেঁয়াজ
ছিল ভরসা। কিন্তু দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হওয়ার পর সেদিন শেষ। ভারত,
মিয়ানমার, তুরস্ক কিংবা মিশর, কোনো পেঁয়াজেরই এখন আর কদর নেই বাজারে।
বেশিরভাগ ক্রেতাই এখন দেশি পেঁয়াজ কিনছেন।
দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোর চিত্র এখন এমনই। স্বদেশি ঝাঁঝের
স্থানীয় পেঁয়াজের আগমনে ঝাঁঝবিহীন ঢাউস আকৃতির বিদেশি পেঁয়াজ থেকে মুখ
ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা। আর একটা-দুটোতে এক কেজি হয়, এমন পেঁয়াজ ক্রেতারা
একেবারেই কিনছেন না।
পেঁয়াজের সঙ্কট কাটাতে আমাদের
স্বাবলম্বী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশি পেঁয়াজের মান এতোটাই ভালো
যে, উৎপাদন বাড়লে ভারত থেকে এক কেজি পেঁয়াজও আনার প্রয়োজন হবে না
রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের ক্রেতা ফরিদা পারভীন বলেন, ‘বিদেশি ওইসব
পেঁয়াজ রান্নার উপকরণ হিসেবে তেমন উপাদেয় নয়। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ লাগে।
গন্ধ আর ঝাঁঝ কিছুই নেই!’
তিনি বলেন, ‘দামের কারণে বাধ্য হয়ে বিদেশি পেঁয়াজ খেতে হয় কখনো কখনো।
কিন্তু দেশি পেলে বিদেশি পেঁয়াজের প্রশ্নই আসে না। এখন দেশি পেঁয়াজ
নাগালের মধ্যে।’
সম্প্রতি ওই বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল কেজিপ্রতি ৪০ টাকায়।
পাশেই রাখা বিদেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩০ টাকা হলেও তেমন বিক্রি হচ্ছিল
না।
রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি মাসুদ বলেন, ‘রান্নায় এক কেজি দেশি পেঁয়াজের
কাজ দ্বিগুণ পরিমাণ বিদেশি পেঁয়াজেও হয় না। ঘুরে-ফিরে দেশি পেঁয়াজেই
সাশ্রয় ও পরতা। স্বাদও অতুলনীয়।’
ব্যাপক চাহিদার কারণেই প্রতিবছর মৌসুম শেষে দেশি পেঁয়াজ নিয়ে শুরু হয়
ভোগান্তি। গত বছর দেশে পেঁয়াজ সঙ্কটের সময় ভারতও রফতানি বন্ধ করে দেয়।
জনগণের এই ভোগান্তি লাঘবের জন্য সরকারও আগামী তিন বছরের মধ্যে পেঁয়াজ
উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সে লক্ষ্যে কাজ করে
যাচ্ছে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়।
রাজধানীর শ্যামবাজার পেঁয়াজের আড়তে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন
এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজের সঙ্কট কাটাতে আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার
কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশি পেঁয়াজের মান এতোটাই ভালো যে, উৎপাদন বাড়লে
ভারত থেকে এক কেজি পেঁয়াজও আনার প্রয়োজন হবে না।’
পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি বন্ধ হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ
পণ্যটি সরবরাহ সঙ্কটের অজুহাত ও সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে
করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ সালে দেশে দুই লাখ ৩৭
হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০
মেট্রিক টন। এর মধ্যে এক লাখ ৭৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজের
উৎপাদন হয় ২০ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এছাড়া ৬২ হাজার ৫০০ হেক্টর
জমিতে কন্দ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় চার লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন এবং ৩৪০
হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন হয় দুই হাজার ৮৬৯ দশমিক ৬০
মেট্রিক টন।
পাশাপাশি ২০১৯-২০ সালে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১০ লাখ মেট্রিক টন। সে
হিসেবে ধারণা করা হয়, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৪ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক
টন। অর্থাৎ ঘাটতি প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতির পেঁয়াজের ৮০ শতাংশ পূরণ
হয় ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে।
অনুমিত এ ঘাটতির পরও কোনো কারণে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাহত হলে তৈরি
হয় সঙ্কট। একটা সময় পর্যন্ত এই সঙ্কট ‘মহাসঙ্কটে’ রূপ নিয়ে ক্রেতাসাধারণের
নাগালের বাইরে চলে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি।
এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেঁয়াজের ঝাঁঝে কোণঠাসা হয়ে পড়ে
দেশের বাজার। এমন পরিস্থিতিতে ভারতও সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়। আর
দেশটিতে কোনো কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে রফতানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়া
হয়। তখন বাধ্য হয়ে পেঁয়াজের জন্য ধর্ণা ধরতে হয় দূরদেশে। বিশেষ পদ্ধতিতে
বিমানে করে আনতে হয় এ পণ্যটি।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আগামী দিনগুলোতে আর আগের মতো পেঁয়াজের সঙ্কট দেখা দেবে না। স্থিতিশীলই থাকবে এই প্রয়োজনীয় পণ্যটির বাজার।