রাজধানীর মণিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের রূপনগর শাখার তৃতীয় শ্রেণির
ছাত্র আসওয়াদ জামান। গত বছরের এপ্রিল থেকে তার স্কুল বন্ধ। গত বছরের কয়েক
মাস অনলাইনে ক্লাস হলেও ঘরে বসে কম্পিউটার বা টিভির পর্দায় ওই ক্লাস করতে
করতে বিরক্ত সে। এখন নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু। নতুন বই পেয়েছে। তবে কাটেনি
ক্লাস ও স্কুলের অনিশ্চয়তা। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে সে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস
করে, ‘আমি কবে স্কুলে যাব? কবে আমাদের ক্লাস শুরু হবে?’ বাবা-মাও তার
প্রশ্নের উত্তর জানে না। এদিকে সরকার দ্বিতীয় দফায় ছুটি বাড়িয়েছে ৩০
জানুয়ারি পর্যন্ত।
স্কুল খোলা ও ক্লাস নিয়ে এই প্রশ্ন, এই অনিশ্চয়তা শুধু কোমলমতি
শিক্ষার্থীদের নয়, অভিভাবক এমন কি শিক্ষকদেরও। অনেক শিক্ষকও এখন জানেন না,
স্কুল খোলা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে। গত বছরের মতোই চলতি
শিক্ষাবর্ষে অনলাইনে ক্লাস চলবে না-কি সহসা স্কুল খোলার ঘোষণা আসবে এ
সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য নাই। মণিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ
মো. ফরহাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্কুল খোলার বিষয়ে এখনো সরকারের
কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। আমরা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অনলাইন ক্লাস
শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো ও ভর্তি
কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া কলেজ ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের
অনলাইন ক্লাস অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। অভিভাবকরা বলছেন, করোনাভাইরাস
মহামারীর আঘাতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত
কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর জীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। স্কুলভিত্তিক শিক্ষা
কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনযোগী হচ্ছে না। অবসর
সময় কাটছে মোবাইল-কম্পিউটারে গেইম খেলে। এমন কি দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে
থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরে
বসে টিভি-কম্পিউটারের সামনে কাটানোর ফলে তাদের ক্ষুধা-মন্দা, ঘুমের সমস্যা
এমন কি শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে। ফলে এখন অনলাইন ক্লাসের বিষয়েও তারা
আর কোনো ধরনের আগ্রহ দেখাচ্ছে না। করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত ১৭ মার্চ থেকে
বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটিও। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩০ জানুয়ারি
পর্যন্ত ছুটি নির্ধারিত আছে। শিক্ষায় গতি ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি এক সংবাদ
সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগামী ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
খুলে দেওয়ার আভাস দিয়েছেন। এ ছাড়া চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা
পিছিয়ে জুন মাসে এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা জুলাই-আগস্ট মাসে নেওয়ার
পরিকল্পনা করেছে সরকার। তবে এর আগে এসএসসি ও এইচএসসি স্তরের শিক্ষার্থীদের
সিলেবাস ‘পুনর্বিন্যস্ত’ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল
মাস এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যস্ত
স্কুল-কলেজে নিয়ে ক্লাস করানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
করোনা সংক্রমণের আগে প্রতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি এবং
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা ১ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায়
ফিরিয়ে আনার দাবি অভিভাবকদেরও। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং
সেন্টারগুলোও করোনার প্রকোপে বন্ধ থাকায় বৃহৎ এ শিক্ষার্থীদের বাড়িতে
পড়াশোনাই ছিল বড় ভরসা। কিন্তু দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ
থাকায় বাড়ির পাঠেও মন বসেনি শিক্ষার্থীদের। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়
বন্ধ হওয়ার পর প্রথমেই হোঁচট খেয়েছে এসএসসি ও সমমানের ফলপ্রার্থীরা।
নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক মাস পরে তাদের ফল প্রকাশ করা হয়। এইচএসসি ও সমমান
পরীক্ষা বাতিল করে সরকার অটোপাসের
ঘোষণা দিলেও এ পরীক্ষার ফল এখনো প্রকাশ করতে পারেনি সরকার। এখনো ফল প্রকাশ
না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়াও আটকে আছে। নতুন শিক্ষাবর্ষ
সম্পর্কে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড.
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা নতুন বই হাতে পেয়েছে। বিভিন্ন
শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। খুব শিগগিরই সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ
অনলাইনে নতুন বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। মহাপরিচালক আরও বলেন, ফেব্রুয়ারির
শুরু থেকেই মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বলছেন, ১১ মাসের বেশি সময় ধরে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বইয়ের দূরত্ব সৃষ্টি
হয়েছে। সবশেষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে
মূল্যায়নের চেষ্টা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর-মাউশি। এ ছাড়া
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নতুন বছরে এসেও ফের অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। নতুন শিক্ষাবর্ষে আবারও
অ্যাসাইনমেন্টের খবর শুনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কারণ গত
বছর কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই নির্দিষ্ট সিলেবাসের ওপর প্রতি সপ্তাহে
শিক্ষার্থীদের যে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়েছে, সেটি তাদের জন্য ছিল প্রচ-
চাপের। অ্যাসাইনমেন্টে অনেক প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা বুঝতেই পারেনি।
জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত
সিলেবাসের আওতায় ছাত্র-ছাত্রীদের শিখন মূল্যায়নের জন্য নতুন অ্যাসাইনমেন্ট
প্রণয়ন করেছে। আগামী ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এ সিলেবাস নির্ধারণ করে মাধ্যমিক ও
উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের
কাছে পাঠিয়েছে এনসিটিবি। জানা গেছে- বাংলা, ইরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও
বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান এই সাতটি বিষয়ের
প্রণীত সিলেবাস ও অ্যাসাইনমেন্টের হার্ড কপি ও সফট কপি মাউশিতে পাঠিয়েছে
এনসিটিবি। রূপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাবিরিদ জামান
জানায়, আমরা তো এখনো নতুন বছরের সিলেবাসই পায়নি। কোনো ক্লাসও শুরু হয়নি।
এখন আবার কীসের ভিত্তিতে এই অ্যাসাইনমেন্ট হবে তাও জানি না।
স্কুল, ক্লাস, সিলেবাস, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েই যে শুধু প্রশ্ন এমন নয়।
রয়েছে আরও অনেক প্রশ্ন। রাজধানীর নামকরা স্কুল কলেজগুলোর যেগুলোর বেতন
বেশি, সেসব অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গত বছরের বেতন পরিশোধ করেনি অনেক
অভিভাবক। পুনর্ভর্তিতে টাকা নেওয়া যাবে না- সরকারের ঘোষণা থাকার পরও কিছু
কিছু স্কুলে ভর্তির জন্য টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। ফলে বেতন পরিশোধ ও
ভর্তি নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন অনেক অভিভাবক। অনেকেই আবার শিক্ষার্থীদের
অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন।
মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরাম নামে একটি অনলাইন গ্রুপে
মহিউদ্দিন খান মিলন নামে একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘মনিপুর স্কুল অ্যান্ড
কলেজের পুনর্ভর্তি ফি ৫ হাজার ৩০০ টাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সার্বিক
বিবেচনায় বর্তমানে পুনর্ভর্তির টাকা না দেওয়াই শ্রেয়।’ রুমা তালুকদার নামে
এক অভিভাবক ১৩ জানুয়ারি একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার ছেলের আজ ভর্তির
তারিখ ছিল, আমি ভর্তি করায়নি, করতেও চাই না। সঠিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়
রইলাম।...’ একই গ্রুপে অনেক অভিভাবক স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চাইছেন, তাদের
বেতন ও ভর্তি ফি কমানো হবে কি-না। এখন তারা কী করবেন।
এ বিষয়ে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শিল্প প্রতিমন্ত্রী
কামাল মজুমদার এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গত বছরের শিক্ষার্থীদের
বেতন-ভাতা বাবদ তার স্কুলে প্রায় ১০ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকার যে সাত ধরনের ফি বাদ
দিতে বলেছে, সেগুলো বাদ দিয়ে পুনর্ভর্তির জন্য টিউশন ফি ৫ হাজার ৩০০ টাকা
(মাধ্যমিক শ্রেণির) নির্ধারণ করা হয়েছে।