যদি পৃথিবীর সব মানুষ একটি ভাষায় কথা বলে, তাহলে কেমন হয়? দারুণ না
ব্যাপারটা? ভাষার অন্তরায় বলে আর কিছু থাকল না, আমরা সবাই সবার কথা বুঝতে
পারলাম, যোগাযোগের আর কোনো সমস্যাই থাকল না। বিষয়টি কি একেবারেই অসম্ভব?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনপ্রিয় হওয়ার ফলে প্রধান ভাষাগুলোর দাপট বেড়েছে।
এখন কম-বেশি সবাই ইংরেজিতে কমিউনিকেট করতে পারছে, ইউরোপীয়দের মধ্যে
ফরাসি ও জার্মান ভাষার চর্চা বেড়ে গেছে। যদি সব মানুষ ৪-৫টি প্রধান ভাষায়
কথা বলতে শুরু করে, তাতে যোগাযোগের সমস্যা কমবে ঠিকই; কিন্তু একটি বড়
সমস্যা দেখা দেবে, তা হচ্ছে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো ক্রমেই বিলীন হয়ে
যাবে। আমরা নিশ্চয়ই চাইব না সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা হারিয়ে যাক।
পৃথিবীতে সাড়ে ৬ হাজার ভাষা আছে। এর মধ্যে ২ হাজার ভাষা আছে যেসব ভাষার
প্রতিটিতে ১ হাজারেরও কম মানুষ কথা বলে। আমরা কি চাইব সেসব ভাষা বিলীন হয়ে
যাক? না, তা মোটেই চাইব না। এসব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের
১৭ নভেম্বর একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা দেয়। আর সেই দিবসটি
হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি।
১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতা প্রাণ
দিয়েছে সরকারি বাহিনীর গুলিতে। দিনটি তাই আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছোট
নৃগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা চাই না মেজর ভাষাগুলো
মাইনর ভাষাগুলোকে খেয়ে ফেলুক, আবার এ-ও চাই ভাষার অন্তরায় দূর হোক। কীভাবে এ
ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব? আমার ধারণাটি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি।
ভাষার ওপর যার ভালো দখল আছে, এমন একজন মানুষ তার মাতৃভাষার ১৫ থেকে ২০
হাজার শব্দ জানে। একটি বিদেশি ভাষার বড়জোর দুই হাজার শব্দ মানুষ শিখতে
পারে। গবেষকরা মনে করেন, ৮০০ শব্দ জানলেই ভালোভাবে যোগাযোগ করা যায়। ৪০০
শব্দ জানলে মোটামুটি যোগাযোগের কাজটি চলে।
আমি ধারণা করছি, আড়াইশ শব্দ জানলেই কাজ চালানোর মতো যোগাযোগ, মানে
অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় অংশ নেওয়ার মতো একটি দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব।
আচ্ছা বাদ দিই আড়াইশ, ধরে নিই ৪০০ শব্দই লাগে। এখন আসুন এই ৪০০ শব্দের একটি
নতুন ভাষা আমরা তৈরি করি, যা হবে ‘বিশ্বভাষা’ বা ‘গ্লোবাল লাঙ্গুয়েজ’।
আমাদের কাজ হবে ৪০০ শব্দের একটি অভিধান তৈরি করা। প্রথম ধাপে গবেষকরা
খুঁজে বের করবেন কোন ৪০০ শব্দ সবচেয়ে বেশি দরকার হয় যোগাযোগ করতে। শব্দগুলো
পাওয়ার পর এ ৪০০ শব্দ কোন ভাষা থেকে নেওয়া হবে, বিশ্ব ভাষার জন্য তা
দুইভাবে ঠিক করা যেতে পারে।
প্রথমত, পৃথিবীতে ১৯৭টি দেশ আছে, প্রত্যেক দেশ থেকে দুটি করে শব্দ নেওয়া
যেতে পারে। অন্য উপায় হচ্ছে- অনেক শব্দ আছে বিভিন্ন ভাষায় অবিকৃত। যেমন
‘মা’। এ শব্দটি অনেক ভাষায় একই বা কাছাকাছি উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়। ‘সাবান’
শব্দটি আমি অনেক দেশে একই উচ্চারণে ব্যবহৃত হতে দেখেছি। যে শব্দগুলো অধিক
ভাষায় ব্যবহার হচ্ছে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকাটি তৈরি করা যেতে
পারে। এভাবে আমরা ৪০০ শব্দের একটি ‘বিশ্বভাষা’ শব্দকোষ তৈরি করতে পারি।
এবার আসি স্ক্রিপ্টে। কীভাবে তা লেখা হবে? সবচেয়ে বেশি ভাষা সম্ভবত
রোমান হরফে লেখা হয়। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে হরফ সবচেয়ে
বেশি ভাষায় ব্যবহার করা হয়, সেই হরফকেই ‘বিশ্বভাষা’র স্ক্রিপ্ট হিসেবে
গ্রহণ করা যেতে পারে।
এখন নিশ্চিত করতে হবে এই ৪০০ শব্দের অভিধানটি যেন পৃথিবীর সব মানুষ পড়ে
ফেলে। যদি সবাই এই ৪০০ শব্দ জানে তাহলে আমরা পৃথিবীর যে ভূখণ্ডেই যাই না
কেন, আমাদের যোগাযোগের আর কোনো অসুবিধা থাকবে না। আমরা কি সবাইকে বাধ্য করব
‘বিশ্বভাষা’ শেখার জন্য? না, বাধ্য করব না, তবে প্রমোট করব।
জাতিসংঘের কোনো বিশেষায়িত সংস্থা, হতে পারে ইউনেস্কো, হতে পারে ইউনিসেফ,
এ দায়িত্ব নিতে পারে। পৃথিবীর সব দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোর
যেন এ ডিকশনারি মুখস্থ করে সেই লক্ষ্যে কাজ করা যেতে পারে। পৃথিবীর সব
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ‘বিশ্বভাষা’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘বিশ্বভাষা’ বাধ্যতামূলক, নবম থেকে
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে রাখা যেতে পারে।
ভাষা মানুষকে কাছে টানে, মানুষে মানুষে বিভেদ অনেকটাই দূর করে দেয়। আমরা
যদি একটি গ্লোবাল ভাষা তৈরি করে একে অন্যের সঙ্গে মনের ভাব আদান-প্রদান
করতে পারি, তাহলে আমাদের মধ্যকার ধর্ম, বর্ণের বিভেদ অনেকটাই কমাতে পারব
বলে আমি মনে করি।
আমি একটি ধারণার কথা বললাম মাত্র। হয়তো অতীতেও কেউ এমন কথা বলে থাকবেন। বাকি কাজ গবেষকদের।