শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
আমার এক গুণগ্রাহী ছাত্র উচ্ছ্বাসবশত আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বলল- স্যার, আপনি আমাদের কাছে বটবৃক্ষ। এবং ..........
তার কথায় আমি সায় দিতে পারিনি। কোনো মন্তব্যও করিনি। কিন্তু মনে মনে রুষ্ট হয়েছি। কারণ, বটবৃক্ষ আমাকে অনেক হেনস্থা করেছে। আমি যে স্কুলে পড়তাম, তার পেছনে ছিল বা আছে একটি বাজার। বাজারের পশ্চিমপার্শ্বে একটি বিরাট বটবৃক্ষ, মাঝখানে ঈষৎ ছোট ও পূর্বপ্রান্তে খালপাড় অপর একটি বটবৃক্ষ ছিল বা আছে। স্কুলের টিফিন ঘন্টায় বাজারে এমনি যেতাম এবং অবধারিতভাবে ঐ গাছের ডালেবসা কোনো পাখি মলত্যাগ করত এবং আমার মাথায় বা জামায় তা পড়ত, অন্যদেরও হয়েছে এমনটি। কিন্তু আমার বেলায় ছিল নিয়মিত। এছাড়া প্রতিবছর মকরসংক্রান্তিতে অর্থাৎ পৌষমাসের শেষদিন ও মাঘমাসের প্রথমদিন আমাদের এলাকায় বাউল বাড়িতে মেলা বসত। বাউলরা মারা গেলে সমাধি দেয়া হয়। সুতরাং মেলার পাশে বেশ কয়েকটি সমাধি আছে, এবং সেখানে বড় বড় কয়েকটি বটবৃক্ষ রয়েছে। একবার মেলাতে আমার ঠাকুরমার (দাদীর) মাথায় বটবৃক্ষের একটি শুকনা ডালা ভেঙে পড়ে, তিনি সামান্য আহত হন। কিন্তু ভয়ে জ্ঞানহারা হলেন, আমরা উদ্বিঘœ হয়েছিলাম। এসব কারণে বৃটবৃক্ষ আমার কাছে একধরনের যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে এখনও বিবেচ্য। সুতরাং ছাত্রটি আমাকে বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করায় মনে মনে রুষ্ট হয়েছিলাম।
বটবৃক্ষ আমাদের সকলের পরিচিত। আমরা তার সাথে মহৎ বা বৃহতের তুলনা করে থাকি। বলি-‘বটবৃক্ষের মতো হবি’। বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিবি, বটবৃক্ষের মতো আশ্রয় দিবি, বটবৃক্ষের মতো কালের সাক্ষী হয়ে থাকবি। সুতরাং জগতে বটবৃক্ষের একটি নিজস্ব অবস্থান আছে, ব্যতিক্রমী পরিচিতিও আছে।
আবার সচেতনভাবে যখন বটবৃক্ষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভাবতে থাকি, তখন কতিপয় নেতিবাচক অনুষঙ্গ সম্মুখে এসে ভীড় জমায়।
যেমন-
১. বটবৃক্ষের কাঠ দিয়ে নির্মাণশৈলী কোনো আসবাবপত্র তৈরি হতে বা করতে শোনা যায় না।
২. বটবৃক্ষের নীচে বা আশেপাশে অন্য কোনো বৃক্ষ জন্মাতে দেখা যায় না।
৩. বটবৃক্ষ বৃহৎ, কিন্তু বীজটুকু খুবই ছোট। তার জন্মেতিহাস বিচিত্র। সরাসরি বীজ বপনে বটবৃক্ষ চাষ হয় না। পাখি বট-ফল ভক্ষণের পর বিষ্ঠার সাথে পরিত্যক্ত হলে যে কোনো স্থানে গজিয়ে উঠে। তা মাটি বা অন্যত্র।
৪. বটবৃক্ষ ভূমিতে আশ্রয় পেলে বৃহতে রূপান্তরিত হয়, অন্যথা পরগাছা হিসেবে পুরোনো দালান কোঠা বা স্থাপনায় বাপ দাদার ঐতিহ্য-অহংকারের মতো শেকড় গেড়ে বসে।
৫. বটবৃক্ষের ডালে নানা জাতের পাখি আশ্রয় নেয়, বাসা বাঁধে কি না জানি না। কাক-কোকিল-শালিখ-দোয়েল আশ্রয় নিলেও বড় জাতের পাখি আশ্রয় নেয় না। শকুন জাতীয় পাখিদের কথা বলছি। পথিক বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্রাম করে, কিন্তু পাখির বিষ্ঠার স্বল্পসময়ের মধ্যে চলে যেতে হয়।
৬. বটবৃক্ষের বাতাস ¯িœগ্ধ, কিন্তু নির্মল নয়। কিংবদন্তি হলো-বটবৃক্ষে অশরীরীরা আশ্রিত। এ জন্য এ বৃক্ষের কাছে বা নীচে যাওয়া যেন ভয়ের।
৭. বটবৃক্ষের নীচে কেউ ঘর বাঁধে না, বটবৃক্ষের প্রথাগত কোনো চাষ হয় না। এ বৃক্ষ স্বয়ম্ভু। তবে অলৌকিক শক্তিতে শক্তিমান। বঙ্গদেশে মেলা-বাজার-তীর্থস্থানে বটবৃক্ষের সম্মানিক অবস্থান, অন্যরকম মর্যাদা।
৮. বটবৃক্ষ বনজ, ফলজ বা ভেষজ নয়। কেউ বটবৃক্ষের বাগান করেছেন, তা শোনা যায় না। তার ফল পাখিরা ভক্ষণ করলেও খাদ্য হিসেবে নয়, বিষ্ঠা ত্যাগে বটবৃক্ষের জন্মানোর জন্যই। এমনকি বটবৃক্ষ কোনো ঔষধের উপাদান এ কথাও শুনিনি।
৯. বটবৃক্ষ শেকড় সমৃদ্ধ, তবে প্রোথিত নয়। শেকড় হলো মুনি-ঋষির জটার মতো।
১০. অহংকার হলো বটবৃক্ষ দীর্ঘায়ু ও উঁচু মাথা বিশেষ।
১১. বটবৃক্ষকে সর্ববৃক্ষের প্রধান বা মান্য বলে মনে করা হয় না। কোনো কোনো ব্যক্তিকে যেমন বলা হয় ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়’, বটবৃক্ষের তদ্রƒপ স্বীকৃতি নেই।
১২. বটবৃক্ষকে কোনো বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয় না, তবে সে তুল্য হয়।
১৩. বটবৃক্ষের বৈশিষ্ট্য আছে, গুণ নেই।
আমাদের সমাজেও বটবৃক্ষের মতো ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের সব গুণের চেয়ে প্রধান পরিচিতি হলো বটবৃক্ষের মতো প্রাচীন। এই প্রাচীনতা দিয়ে ব্যক্তিটি স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন সর্বত্র। আমাদের এলাকার সচীনকর্তা ছিলেন এরূপ একজন বটবৃক্ষের মতো অনড় ব্যক্তি। লেখাপড়া স্কুলের গ-ির মধ্যেই সীমিত। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করেন, সাথে প্রাসঙ্গিক ইংরেজি শব্দও সংযোজন করে থাকেন। পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির অধিকর্তা। স্কুল কমিটির সদস্য, বাজার কমিটির সভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বার-চেয়ারম্যান নন, কিন্তু নির্বাচনকালীন জরুরি ভূমিকা পালন করার সুযোগ পেয়ে যান। বটবৃক্ষের মতো প্রাচীন বা প্রধান বলে সকলেই তাকে কাছে টানতে চায় এবং যাপিত আদর্শের সংগতিপূর্ণ ব্যক্তির পক্ষে হাল ধরেন। তাতে তিনি আদর্শিকভাবে পরিচিতি লাভ করলেও যেহেতু বটবৃক্ষের প্রাচীনত্ব তকমা আঁটা, সেজন্য তিনি সার্বজনীন থেকে যান। মনে মনে তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও তার উপস্থিতিকে কেউ অমর্যাদা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বয়সটা সচীনকর্তার অমলিন অহংকার। তিনি তা আন্তরিকভাবে যাপন করেন, উপভোগ করেন এবং এসবের মধ্যেই তিনি নিজেকে খুঁজে পান। বটবৃক্ষের মতো তার অন্যতম গুণ হলো-তিনি কোনোদিন প্রতিবাদী হতে চান না, ন্যায়-অন্যায় বিচার করেন না, তিনি এতটাই নিরপেক্ষ, যার জন্য তাকে সকলেই নিরাপদ মনে করে, সকল কাজে তাকে পাওয়া যায়, বটবৃক্ষের মতো বাজার বা মেলার গাছটি হয়ে শোভা বর্ধন করতে থাকেন। সচীনকর্তার প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা প্রবল, কিন্তু দৃশ্যত যাচ্ঞা নেই। অন্যের প্রাপ্তিতে মনে মনে দুঃখ পান, কষ্ট অনুভব করেন। সচীনকর্তার কোনো ত্যাগ নেই, পুরুষাক্রমিক অহংকার আছে, যা অচল আধুলি। বাজারে চলে না, শেকরার দোকানেও গৃহীত হয় না। কিন্তু আধুলিটাই সম্বল। সচীনকর্তার স্বরূপটা বুঝা যায়, যখন তার নাম কেউ জিজ্ঞেসা করে। নাম জিজ্ঞেসা করলেই ‘শ্রীযুক্তবাবু সচীন্দ্রলাল রায় চৌধুরী’ বলে আত্মপরিচয় দিতে থাকে। বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে যে ভূমিতে, সেখানে যেমন নিজের বংশধর থাকে না, সচীনকর্তা যে পাখির ভক্ষিত বিষ্ঠার ফসল, তার বীজের বংশধর কোথায়, তার কোনো খবর নেই। সচীনকর্তার এদিকে নজর নেই, তাদেরকেও ছাড় দিতে আগ্রহী হতে দেখিনি।
বৃক্ষকে প্রশ্ন করা হয়- তোমার পরিচয় কি? আমরা জানি-বৃক্ষের প্রধান পরিচয় তার ফল-‘ফলেন পরিচয়তে বৃক্ষ’। বটবৃক্ষ এ ক্ষেত্রে নিরুত্তর। বটবৃক্ষকে যদি প্রশ্ন করা হয়-তোমার জন্মেতিহাস কি? মাথা নীচু করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অন্য বৃক্ষের বীজ যেমন সোনা-মাটিতে প্রোথিত করে পরিচর্চা করতে হয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে অঙ্কুরোদ্গমের ক্রম বৃদ্ধিতে বড় হতে থাকে, বটবৃক্ষের তেমনভাবে পরিচর্চা করার কথা শোনা যায় না। যদি প্রশ্ন করা হয়-বটবৃক্ষ, বৃক্ষকুলে তোমার অবস্থান কি, বৈশিষ্ট্য কি? উত্তর দেয়-বিশালতা এবং ছায়া-আশ্রয়দাতা। তবে বিশেষত্ব হচ্ছে-বটবৃক্ষকে কেউ নিধন করে না। একটা অজানিত ভয় বা সংশয় মনে মনে পোষণ করে। অর্থাৎ বটবৃক্ষকে মানুষ ভয় পায়। যত সে বৃহৎ, তত তার সুনাম ও কিংবদন্তি-ইতিহাস। অলৌকিকত্বই তার একমাত্র কারিশমা। এই বটবৃক্ষের সঙ্গে আমার ছাত্র আমাকে তুল্য-মূল্য দিলেও তার মতো হওয়ার আকাক্সক্ষা আমার নেই। বটবৃক্ষ থাকুক তার অহংকার ও কারিশমা নিয়ে, আমি থাকি আমার আপনজগতে, যেখানে ফুলের সুবাস থাকবে, ফলের সমাহার থাকবে। অন্তত ফলজ, বনজ বা ভেষজ যেকোনো একটি হয়ে থাকতে চাই। বটবৃক্ষ কখনও নয়।