মো. শাহ জালাল মিশুক ||
মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। রাত পোহালেই নতুন জীবন—বিয়ে, কিন্তু এর আগেই সড়কে প্রাণ গেল যুবকের। ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। মাকে দেখতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে পারলেও বাড়িতে পৌঁছানোর রাস্তায় হয়ে গেল নিথর মৃতদেহ। বাংলাদেশের সড়কে এমন সব করুণ কঠিন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নামক গণমৃত্যুর এই ফাঁদ কি কিছুতেই দূর করা যায় না?
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপ বা বিআরটিএ’র হিসাব মতে, প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় ৩০ জন। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮শ জন। আবার বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। অন্যদিকে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষ নিহত হন।
বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা কিছু তারতম্য থাকলেও বছরে ১০-১২ হাজার মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার তথ্য আমাদের পিলে চমকে দেওয়ার মতো। সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হলেও যেখানে প্রশাসন বা চালকদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এটা ঠিক যে, পৃথিবীর সব দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সে সব দেশে যথাযথভাবে বিচারের মুখোমুখি হোন চালকরা। এেেত্র আমাদের দেশে ব্যতিক্রম।
গত বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ৯৯৬ মানুষের মৃত্যু এবং পাঁচ হাজার ৮৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন, টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকার প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নিসচার হিসেবে, গত এক বছরে চার হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রেলপথ ও নৌপথে দুর্ঘটনায় মোট ৩৪১ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে রেলপথে ১২৯ জন নিহত ও ৩১ জন আহত এবং নৌপথে ২১২ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হন।
পাশাপাশি গত বছরের জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই এক মাসে ৪৪৭টি দুর্ঘটনায় ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হয়েছেন। এরপর গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে তুলনামূলক কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিলে ১৩২ ও মে মাসে ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন থাকায় এই দুই মাসে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৮৬ জন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া গতি। বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। এ ছাড়া রেলপথে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩১৮ জন ও নৌ দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন, অর্থাৎ সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩১৭ জন। সংগঠনটি বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেলে সড়ক দুর্ঘটনা ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশীপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দনি এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌছে গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশীপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দনি এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌছে গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যান ১০২ জন। পাশের দেশ ভুটানে এ সংখ্যা ১৬ দশমিক ৭০, ভারতে ১৩, নেপালে ৪০ ও শ্রীলঙ্কায় সাতজন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শ্রীলঙ্কায় ৩২৭। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে দুজন সাইকেলচালকের মৃত্যু হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের েেত্র এ সংখ্যা ১১ দশমিক ২০। আর গাড়ি ও হালকা যানের েেত্র প্রতি ১০ হাজার যানের দুর্ঘটনায় ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়িচালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ট্রাক চালকদের েেত্র এ সংখ্যা ছয় দশমিক ১০, বাসচালকের েেত্র আট দশমিক ২০ ও বাসযাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০ জন। প্রতিটি েেত্রই দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
অর্থাৎ সকল গবেষণা ও তথ্য উপাত্ত পর্যবেণ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, প্রতিনিয়ত সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণেই প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এমনকি বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রাণহানি থেকে মানুষদের রা করা যায়নি। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো টেকসই ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করা, দ চালক নিশ্চিত করা, চালকদের জন্য নিয়মিত প্রশিন ও পর্যবেন এর ব্যবস্থা করা, শহরগুলোয় নিরাপদ গতি ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করা ইত্যাদি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ করা এবং ফুটপাত বেদখল মুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের যুগোপযোগী প্রশিণের জন্য আধুনিক ও মানসম্মত ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র সমূহে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।