চেরাপুঞ্জি, ছোটবেলার কুইজ আর ভূগোলের প্রশ্ন। কিন্তু কিশোর মনে কনফিউশন তৈরি করেছিল মৌসিনরাম। ভূগোল ক্লাসে টিচার বলেছিলেন, বইতে লেখা আছে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জিতে; আসলে এখন এই রেকর্ড হচ্ছে চেরাপুঞ্জির কাছ আরেকটা গ্রাম তার নাম ‘মৌসিনরাম’। ক্লাসে বসে ছিল মহসীন শেখ। বেচারি মাথা চুলকে নখ উপড়ে ফেলেছিল। ওর নামের সঙ্গে রাম কী করে জুড়ে গেল!
মেঘালয় বিধান সভা
যাকগে, সো-হ-রা হচ্ছে চেরাপুঞ্জির আসল নাম। কমলা লেবুর দেশ মানে ‘সোহরা’কে ইংরেজরা বলত ‘চুহুরা’, সেখান থেকেই বাংলা ভাষায় এর নাম হয়ে গেল চেরাপুঞ্জি। তবে শুধু সোহরাই না, প্রচুর পান আর সুপারিগাছও দেখতে পাবেন সেখানে।
শিলং পিক হেলিপ্যাড সমুদ্রতল থেকে ১৫২৫ মিটার উঁচু আর চেরাপুঞ্জির উচ্চতা ১৪৮৪ মিটার। শিলংয়ের থেকে কম। তবুও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের দৌলতে সারা রাস্তা উঠতে আর নামতেই কেটে গেল। গরমকালেও বাইরের ঠান্ডাতে হাত–পা কাঁপছে। ছাতা আনার কথা মনে ছিল, কিন্তু সোয়েটারের কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। বেশি বৃষ্টির ফলে জমির ওপরের অংশ বারবার ধুয়ে যায়। তাই চাষাবাদ ভালো হয় না। আবার শীতকাল এত শুকনা থাকে যে গাছপালা প্রায় জেরোফাইটিক মানে ক্যাকটাস বা অর্কিড টাইপের, অল্প জলেও বেঁচে থাকতে হয়। আল্পস বা কুমেরু এলাকার মতো অভিযোজন সেভাবেই হয়েছে।
চেরাপুঞ্জি কিন্তু শিলং মালভূমিরই একটা অংশ। তিন দিকে দক্ষিণ, উত্তর আর পশ্চিমে গারো, খাসি আর জয়ন্তিয়া হিলস। এই মালভূমি অঞ্চল এমনিতেই ভীষণ ভূমিকম্পপ্রবণ। উত্তর, দক্ষিণ আর পূর্ব–পশ্চিমে বেশ চাপ আছে। চাপ মানে ট্যাকটনিক অ্যাক্টিভিটি, স্যাটেলাইট পিকচারেও বেশ কিছু ফল্ট বা ফাটল দেখা যায়।
শিলং থেকে বেরিয়ে চেরাপুঞ্জির রাস্তার ধারে সাব ট্রপিক্যাল ফরেস্ট, খাসি পাইনের সঙ্গে আরও বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং গাছ, ফুল, পাখি আর প্রজাপতি দেখা দিল। রাস্তার ধারে কমলা লেবুর গাছ আর বস্তি এলাকার মতো ঘিঞ্জি বাড়িঘরে গ্ল্যাডিওলাস। যে ফুল ছাড়া আমরা ‘তোড়া’ তৈরির কথা ভাবতেও পারি না, সেই গ্ল্যাডিওলাস এখানে বাড়ির ফেন্সিংয়ের বাইরে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলছে। ড্রেনের গা বেয়ে ডালিয়ার ঝাড়। প্রকৃতি যেন ডালা উজাড় করে দিয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে রামকৃষ্ণ মিশনের বিশাল কমপ্লেক্স।
মৌসমাই নংথাইমাই ইকো পার্কের প্রবেশ পথ
প্রথমেই চলে এলাম মৌসমাই নংথাইমাই ইকো পার্কে। সরকারি পার্ক, প্রচুর অর্কিড আর একটা ঝরনাকে ড্যাম দিয়ে বেঁধে জলপ্রপাত তৈরি করে বানানো। আমরা যখন গাড়ি থেকে নামছি তখন মেঘে ছেয়ে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুনলাম আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে বাংলাদেশের সিলেট দেখা যায়।
সেখান থেকে একটু এগিয়ে মেঘের মধ্য দিয়ে চলে এলাম সেভেন সিস্টার ফলসে। এক জলপ্রপাতের তিনখানা নাম।
মৌসমাই গ্রামের কাছে বলে এর নাম মৌসমাই ফলস আবার এর অফিশিয়াল নাম নহসিংথিয়াং ফলস আর ট্যুরিস্টদের কাছে এর নাম সেভেন সিস্টার্স ফলস। সেভেন সিস্টার্স ফলস নাম কেন? ট্যুরিস্টদের ভিড়ে কেউ বলছে ভারতবর্ষের উত্তর–পূর্ব অঞ্চলকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলে, তাই এই নাম, একজন তো আবার চারদিকের খান পনেরো পাহাড়ের মাথা গুনে বলল, সাতটা পাহাড়ে ঘেরা, তাই এই নাম।