
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।
রহিম মিয়ার হোটেলটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। তেত্রিশ বছরের পুরোনো হোটেল। টিনের ঘর, পেছনে একচালা, সেখানে রান্নাবান্না হতো। ঘরের মধ্যে টেবিল পাতা, তাতেই খাওয়া-দাওয়া। অত্যন্ত সাধারণ মানের সামগ্রী। ভাত-নানাধরনের মাছের ঝোল, সবজি-ভাজি ইত্যাদি। এভাবেই শুরু হয়েছিল, বিশেষত রহিম মিয়ার হোটেলের ডালের জন্য বিখ্যাত। সকলেই তারিফ করে। অনেক পরে মাংস সংযোজন হয়। মুরগী ও খাসির মাংসই প্রধান। সেজন্য হিন্দু-মুসলমান একত্রে খাওয়া-দাওয়া করতে পারতো। খুবই সুনাম। সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া চলে। দাম নেয়া হয় সহনীয়। গরীব ও মধ্যবিত্তেরাই রহিম মিয়ার খরিদদার। এই হোটেলের আয় দিয়ে সে বাড়ি পাকা করেছে, একটি মুদি দোকান দিয়েছে, জমি কিনেছে, ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা কেউ হোটেল ব্যবসায় আগ্রহী নয়। ভাগ্যলক্ষ্মী বলতে গেলে এই হোটেল হলো রহিম মিয়ার বাতিঘর। এ হোটেলটি তেত্রিশ বছর পর আগুনে পুড়ে গেলো। সর্বনাশ তো বটেই। তাই পোড়া ভিটের উপর রহিম মিয়া মাথায় হাত রেখে বসে আছে, দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলছে। একজন কর্মচারী বেনু তার নাম। সে বলছে-‘খালু, যা হবার তা হয়ে গেছে, আপনার তো টাকা পয়সার অভাব নেই। এবার দালান বানান, বড় হোটেল করেন।’
রহিম মিয়া বেনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে-‘আরে বেনু, হোটেল পুড়েছে, হোটেল বানামু, কিন্তু আমার তেত্রিশ বছরের ডাইলডা (ডালটা) পামু কই?’ অর্থাৎ প্রতিদিন ডালরান্না হয়, উদ্ধৃত্ত ডাল পরের দিনের নতুন ডালের সঙ্গে মিশেল দিয়ে আসছে তেত্রিশ বছর যাবত। আর রহিম মিয়ার হোটেলের ডালের প্রশংসা মুখে মুখে। চমৎকার।
হুন্ডু মিয়ার হোটেলের খুব নামডাক। একদিন এক লোক খেয়ে ক্যাশে টাকা দিতে এসে দেখে ম্যানেজার সীটে নেই। কর্মচারী দৌঁড়ে এসে বলে ‘সাতাশ টাকা দেন’। বলে-‘ম্যানেজার কই?’ কর্মচারীটি বলছে- ‘ঐ যে হোটেল দেখছেন, সেখানে খেতে গেছে।’ লোকটি অবাক হয়। বলে-‘এ হোটেল থাকতে অন্য হোটেলে খেতে গেলো কেন?’ সরল-সহজ কর্মচারীটি জানান দেয়-‘ম্যানেজার বাসি জিনিস খেতে পারে না।’ বলে কি?
আমার গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) নূরমিঞা পাঁচ লিটার ঘাস-খড় খাওয়া গাভীর দুধ নিয়ে এসেছে। সঙ্গে খেজুরের রসের লালি, আমরা গ্রাম্য ভাষায় বলি ‘তোয়াগ’। তা দিয়ে পায়েস রান্না হলো, তৃপ্তি সহকারে খেলাম। কিন্তু পেট সহ্য করতে পারল না। অথচ পরে ডানো বা প্রাণ অথবা আড়ং-এর দুধ দিয়ে পায়েস খেয়েছি, তাতে কোনো অসুবিধা হলো না। তখনই বুঝে গেলাম-পেটে এখন আর খাঁটি জিনিস সহ্য করতে পারবে না। ভেজাল বা কৃত্রিম জিনিসই এখন সহ্য করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে।
দেশি মাছ নেই, দেশি তরকারি নেই, দেশি গাভীর দুধ নেই-ইত্যাদি সব বিদেশি বা কৃত্রিম। প্রস্তুতিকরণ প্রক্রিয়ায় অঢেল উৎপাদন, কৃত্রিম প্রজণনে যতসব জীব সকল-তাই মানুষও আর খাঁটি নেই। তাতে নাকি বাংলাদেশের মানুষ জীবন ধারণের ক্ষেত্রে হুমকি পর্যায় চলে গেছে। এমনটি হওয়ার কথা নয়, এমনটি হতে দেয়া যায় না। বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করেছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। তাই তিনি সরকারের পক্ষ থেকে গেজেটের মাধ্যমে সংসদে আইনের আওতায় ‘জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য’ বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
সংসদ কর্তৃক গৃহীত আইনটি ১০ অক্টোবর ২০১৩ তারিখ মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং ২০১৩ সালের ৪৩নং আইন শিরোনামে বলা হয়-
‘বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণ খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং তদলক্ষ্যে একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এতদ্সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন রহিতক্রমে উহা পুন:প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন।
যেহেতু মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক এবং এতদ্সংক্রান্ত যাবতীয় বিধিবিধান বিস্তারিতভাবে গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিক বিষয়টি পর্যালোচনা করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে ধারণা পোষণ করতে গিয়ে বাস্তবতার নিরিখে কেন জানি অসহায়বোধ করছি। কারণ, সামগ্রিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতে হলে দক্ষ ও আন্তরিক মানসিকতা সম্পন্ন জনবলের প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার আন্তরিকভাবে কর্মপ্রবাহ শুরু করেছেন। একজন অতিরিক্ত সচিব অর্থাৎ চেয়ারম্যানের অধীনে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনগতভাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবে ভোগ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও ঘর-পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়-আমাদের অবস্থানটা এখনও বা পরেও থাকবে কিনা তা নিয়ে ভাবছি।
মনে পড়ে গেলো কথিত রাজার খাঁটি দুধ পানের কাহিনিটি। রাজা প্রতিদিন দশটায় রাজদরবারে যাওয়ার আগে এক গ্লাস দুধ দুটি বাতাসা দিয়ে পান করে তারপর পারিষদসহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাজা লক্ষ্য করলেন-এখন দুধটুকু কেন জানি পানসা পানসা মনে হচ্ছে। তাই দরবারে কথাটি তিনি উত্থাপন করলেন। পারিষদবৃন্দ আতংকিত হলেন এবং এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ, দুধ পানের সঙ্গে রাজার স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত। সুতরাং অভিজ্ঞ প্রবীণ মন্ত্রী বললেন, যে গোয়ালা দুধ সরবরাহ করে, সে নিশ্চয়ই দুধে জল মিশ্রণ করে। তাই তিনি প্রস্তাব করলেন-খাঁটি দুধ প্রাপ্তির জন্য গোয়ালার গোশালায় একজন সুপারভাইজার, যে পথে দুধ নিয়ে আসে, রাস্তায় একজন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) এবং রাজবাড়ির ফটকে একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হোক। ব্যাখ্যা দেওয়া হলো- গোয়ালা গাভী দোহনের সময় আগেই ভান্ডে জল রেখে দিতে পারে, অথবা আসার পথে খাল-নদী থেকে জল মিশাতে পারে, রাজ ফটকে পরীক্ষা-যন্ত্র দিয়ে তত্ত্ববধায়ক নিশ্চিত করলেই খাঁটি দুধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রস্তাব পাশ হলো, তিন পদে লোক নিয়োগ হলো এবং যথারীতি কাজ শুরু হয়ে গেল। গোয়ালা যখন গাভী দোহন করতে গোশালায় প্রবেশ করল, দেখে যে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। গোয়ালা ভাবল-চোর নয় তো? পোষাক-আশাকে না মনে হলো না। তাই জিজ্ঞেস করল-‘আপনি কে? এখানে কী করছেন?’ সুপারভাইজার তার দায়িত্বের কথা জানাল এবং দোহন-ভা-টি দেখতে চাইল। শেষ পর্যন্ত সুপারভাইজারকে এক লিটার খাঁটি দুধ দেওয়া শর্তে বিষয়টি সুরাহা হলো এবং গোয়ালা এক লিটার দুধের ক্ষতি পোষানের জন্য এক লিটার জল মিশিয়ে নিল। এভাবে পরিদর্শক ও তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গেও বিষয়টি সুরাহা হয়ে গেলো। এবার গোয়ালা ক্ষতি পোষনোর জন্য বাধ্য হয়ে তিন লিটার জল মিশাতে হলো। এদিকে রাজা ভাবলেন-এবার নিশ্চয়ই খাঁটি দুধ পান করতে পারবেন। গোয়ালা আর জল মিশাতে পারবে না। এই আনন্দে যখন রাজা ভাসছেন, সামনে দুধের পেয়ালা উপস্থিত হলো। মনের আনন্দে প্রথম কাপড়ের আবরণ সরালেন, তারপর ঢাকনি তুলতেই দেখেন যে দুধের গ্লাসে একটি ছোট্ট চিংড়ি মাছ ভাসছে। দুধটুকু সাদা দেখা গেলেও জলীয় চিত্রটি স্পষ্ট। তারপরের বিষয়টি অনুল্লেখ্য।
কাহিনিটিতে হয়ত রম্যতা আছে, তাই বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো-আমরা যে মাছ খাই, এ সকল মাছ কী খেয়ে স্বাস্থ্যবান হয়? যে গাভীর দুধ খাই বা এই দুধের সামগ্রী আমরা খাই, গাভীগুলোর খাদ্য সামগ্রীতে কী আছে? যে পল্ট্রির মুরগী খাই, তাদের বাজারে দেখা যায়, দরদাম করে কিনে এনে খাই তাতে কী সার, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে কী ঔষধ দেয়া হয়? এভাবে বর্তমানে যতসব আমাদের অর্থাৎ মানুষের খাদ্যবস্তু রয়েছে-তা ভক্ষণে কতটুকু নিরাপদ এ বিষয়টি যাচাইবাছাই-এর জন্য সদাশয় সরকার আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছেন, কিন্তু ঠগ বাছতে গেলে যে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে? পশম তুলতে গেলে যে কম্বল থাকবে না। রহিম মিয়ার হোটেলের ডাল না থাকলে, হু-ু মিয়ার হোটেলে বাসি খাবার না থাকলে আমরা খাব কি?
আমরা ছোটবেলায় স্কুলে নি¤œকাসে কবিতায় পড়েছি ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?’ আমরা অর্থাৎ জনগণ যদি না জাগে তবে কোনো শুভ উদ্যোগই ফলপ্রসূ হয় না। যেজন্য চাই, সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা এবং নিরাপদ খাদ্য বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে জীবনের প্রথমেই জীবন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেওয়া। তাহলে প্রতিটি মানুষ খাদ্য গ্রহণের আগে একটু সচেতন হবে। প্রসঙ্গক্রমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যবহারযোগ্য পাত্রগুলোর মাধ্যমে রুচিকর পরিবেশনার বিষয়টিও কঠোরভাবে মানা, পানীয় জলের স্বচ্ছতা ও গ্লাসটি ব্যবহারযোগ্য কিনা তা যাচাই করা ইত্যাদি। কারণ, ‘আপনি অর্থাৎ নিজে বাঁচলে বাপের নাম’-এ আপ্তবাক্যটি মাথায় রাখতে চাই। আমরা বাঁচতে চাই, আর বাঁচার জন্য খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। এই খাদ্য যদি সুষম ও স্বাস্থ্য উপযোগী না হয় তবে ছিদ্রসদৃশ নৌকায় যে সব সময় জল সেচন করতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-খাওয়ার জন্য বাঁচব, না বাঁচার জন্য খাদ্য গ্রহণ করব।
জনবান্ধব সরকার যেমন চাইবেন, দেশের মানুষ সুস্থ থাকুক, নিরাপদ খাদ্য ভক্ষণ করুক, নিরোগ স্বাস্থ্যবান নাগরিক সুখে থাকুক-এজন্য নিজেদের দায়িত্ব তো সেভাবে বুঝে নিতে হবে। সরকার তো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, তার কর্মযজ্ঞ সামগ্রিক অর্থাৎ সামষ্টিক প্রচেষ্টা এবং জনগণের জন্য সহযোগী। আমরা কেন এ সুযোগটা গ্রহণ করব না? জনগণই তো সরকার-সরকার তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এতসব কথা বলছি- ৭ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করে আমার উপলব্ধিটুকু প্রকাশ করার অন্তর্গত তাগিদ-অনুভবে। বক্তব্যটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত চিন্তা-প্রসূত। তারপরও বলব-এই বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেকেই নিজের মতো ভাবতে পারেন। উপকার হবে, অন্তত বেঁচে থাকার স্বার্থে।