বিডিনিউজ: করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে গুজব-অপপ্রচারে অনেকের মধ্যে যে ভীতি-সংশয় তৈরি হয়েছে, তা দূরতেই প্রথম ধাপেই টিকা নিলেন সরকারের দুজন প্রতিমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তি। তারা বলছেন, বহু প্রত্যাশিত এই টিকা নিয়ে বিভিন্ন মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে, সে কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। তাই আগেভাগেই টিকা নিলেন তারা।
এক বছরের মধ্যে ২১ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য টিকার অপোয় ছিল সারা বিশ্ব। বাংলাদেশের মানুষও এই মহামারীর মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকার অপোয় ছিল।
এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মডার্না এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক মিলে তিনটি টিকা নিয়ে এসেছে, যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে চীনের সিনোভ্যাক ও রাশিয়ার গামালিয়া ইনস্টিটিউটও টিকা তৈরি করলেও সেগুলোর প্রতি ততোটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বেশিরভাগ দেশ। বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আনছে, যে টিকা উৎপাদন করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। এই টিকার তিন কোটি ডোজ আনতে চুক্তি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী এরইমধ্যে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসেছে। এছাড়া ভারত সরকার উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বহু প্রতীতি এই টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।
প্রথম দিন ওই হাসপাতালে সব মিলিয়ে মোট ২৬ জনকে টিকা দেওয়া হয়, যারা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ ৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়ার আয়োজন ছিল।
বাংলাদেশে এই টিকার কিনিক্যাল ট্রায়াল না হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী প্রথম দুই দিনে যাদের টিকা দেওয়া হল, তাদের সপ্তাহখানেক পর্যবেণের পরিকল্পনা হয়। সব ঠিক থাকলে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে গণ টিকাদান শুরু করার কথা রয়েছে।
তবে এরমধ্যেই বেলা পৌনে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এসে টিকা নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনিই দেশের প্রথম সংসদ সদস্য এবং সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এই টিকা নিয়েছেন।
এদিন টিকা নেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, অথর্নীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, তথ্য সচিব খাজা মিয়া, শিা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আখতার।
টিকা নেওয়ার পরে প্রতিমন্ত্রী পলক সাংবাদিকদের বলেন, “একটা শ্রেণি টিকা নিয়ে অপপ্রচার করছে। আমি টিকা নেওয়ার পরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করিনি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
করোনাভাইরাসে টিকা বাংলাদেশে আসার সপ্তাহ দুয়েক আগে ভারতে টিকাদান শুরু হয়। এরপর সেখানে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশে এর সঙ্গে নেতিবাচক কিছু রাজনৈতিক প্রচারও যুক্ত হয়।
বিএনপি চাইলে তাদের আগে টিকা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করবেন বলে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বক্তব্য দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ভেজাল’ টিকা দিয়ে দেখবে বিএনপি মরে কি না, এরপরে তারা নেবে।
এছাড়া ফেইসবুকসহ সোশাল মিডিয়ায় এই টিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা তৈরি হয়। মন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কেন প্রকাশ্যে টিকা নিচ্ছেন না, সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।
সেই প্রসঙ্গ টেনে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, “অনেকের ভেতরে যে প্রশ্ন ছিল রাজনীতিবিদরা কেন টিকা নিচ্ছে না, সেই জায়গা থেকেই গতকাল আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি টিকা নেব।”
এসব অপপ্রচারের বিষয়ে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যে ধরনের অপপ্রচার সোশাল মিডিয়ায় ষড়যন্ত্রকারী এবং দেশবিরোধীরা করছে, তাতে কেউ যেন কান না দেয়। সেজন্য আমি মিডিয়ার সামনে টিকা নিয়েছি। টিকা নিরাপদ। সবাই নির্ভয়ে টিকা নিন।”
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বেলা ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে করোনাভাইরাসের টিকা নেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মন থেকে ভীতি দূর করতে টিকা নিয়েছেন তিনি।
“সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতি আছে যে ভিআইপিরা টিকা নিচ্ছে না। সেই ভীতি কাটানোর জন্য আজ টিকা নিয়েছি। আমার শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ফিল করছি না। এই টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের ভয়ের কোনো কারণ নেই।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাদান কেন্দ্রে সবার আগে টিকা নেন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।
তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার পর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি তার।
“টিকা নেওয়ার পর মন্ত্রী মহোদয়সহ সবাইকে রিসিভ করলাম। উনাদের বিদায় দিয়ে একটা সেমিনার শেষ করে অফিসে এলাম। আমার সহকর্মীদের মধ্যে যারা টিকা নিয়েছেন তাদেরও তো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সবাই তো কাজ করছেন, কেউ বলে নাই যে অসুস্থ্ লাগছে। কোভিড-১৯ এর এই টিকা সেইফ। তবে একটু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো হয়ই। আমি কদিন আগে নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর জ্বর হয়েছিল।”
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএসএমএমইউ কেন্দ্রে টিকা নেন অর্থনীতির অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
বিকাল ৪টার দিকে মোবাইলে যোগাযোগ করলে ৭২ বয়সী এ অর্থনীতিবিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি, “আমি পুরোপুরি ভালো আছি।”
তিনি বলেন, “যারা নিচ্ছেন তারা বেশ আগ্রহ নিয়েই টিকা নিচ্ছেন। কিন্তু যারা এখনও টিকা নিচ্ছেন না, ইতস্তত করছেন তারা আসলে অমূলক বিভ্রান্ত হচ্ছেন।”
সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমার দুই বিলেতি বন্ধুর সঙ্গে কথা হল। গতকাল তারা দুইজনই এ টিকা নিয়েছেন বিলেতে। ওখানেও এ টিকা দিচ্ছে। একই টিকা এখানে দিচ্ছে। সুতরাং টিকা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।”
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ধরনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।
“এটা নিয়ে দ্বিধা থাকার কোনো কারণ নেই। অন্যান্য দেশে এ টিকাটি যতটুকু সেইফ, বাংলাদেশেও ততটুকু সেইফ। আমি বলব, যারা ভালনারেবল গ্রুপ রয়েছেন তারা যেন টিকা নিয়ে নেন। আমরা অনেককে হারিয়েছি। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত- তাদের একটি বড় অংশই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণি রয়েছে।”
টিকা নেওয়া চিকিৎসকরাও জানিয়েছেন, টিকা নেওয়ার পর তাদেরও কোনো সমস্যা হয়নি। সাধারণ মানুষকে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকা প্রথম নেন নাক, কান, গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি।
তিনি বলেন, “প্রথম দিনের কার্যক্রমে টিকা নিতে পেরে ভালো লাগছে। খুবই ভালো বোধ করছি। আল্লাহর রহমতে কোনো ব্যথা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, টিকার জায়গা ফুলে যাওয়া- এমন কিছু হয়নি।
“তবে করোনার টিকা নেওয়া মানেই ১০০ ভাগ নিরাপদ হলাম তা নয়। সব সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।”
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকা প্রথম নেন মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট নন্দিতা পাল।
তিনি বলেন, এই টিকা অন্য সাধারণ টিকার মতোই। তবে আগে থেকেই একটা নেতিবাচক কথাবার্তার কারণে মানুষের মধ্যে কিছুটা ভীতি ছিল।
“আমি টিকা নেওয়ার আগে যেমন ছিলাম, এখনও তেমনই মনে হচ্ছে। আমরা যে ৬৫ জন টিকা নিয়েছি, তাদের কারোরই এ ধরনের সমস্যার কথা এখন পর্যন্ত শুনিনি।”