ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ ||
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্বে এর ভ্যাকসিন বা টিকা দ্রুততম সময়ে আবিস্কার বিশ্ববাসীর মনে অনেকটাই স্বস্তি জুগিয়েছে। আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের সরকারকে, দ্রুত এই ভ্যাকসিন সংগ্রহে সাফল্যের জন্য। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে এর প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন ভার্চুয়াল আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। বিশ্বে এর আগে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাই এত অল্প সময়ে আবিস্কৃত হয়নি। সরকার ভ্যাকসিন দানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। কয়েকটি ধাপে এই কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাভাবিক টিকাদানের েেত্র আমাদের সাফল্য রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশেরই নেই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননাও। কিন্তু স্বাভাবিক টিকাদান কর্মসূচি আর করোনার টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য আছে। তবুও আশা করি, এ েেত্রও সাফল্য চিত্রই আমরা দেখতে পাব। তবে বিশেষ কিছু সতর্কতা-সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিষয়গুলো তুলেও ধরেছেন।
করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের আরও কোনো কোনো দেশেও এমনটিই লণীয়। আবার কোনো কোনো দেশে পুনরায় সংক্রমণ ছড়িয়েও পড়ছে। আমাদের দেশে অনেকের মনে টিকা নিয়ে দ্বিধা আছে। সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। কোনো কোনো মহল এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায়ও লিপ্ত। গুজব রটানোর কথাও আলোচনায় এসেছে। এসব ব্যাপারেই সরকারকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতাবোধ জাগ্রত করতে হবে। অপপ্রচার কিংবা গুজবে কান দিয়ে অতীতে আমাদের দেশে অনাকাঙ্তি-অনভিপ্রেত অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাই এ েেত্র মানুষের সচেতনতার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের নতুন যে অধ্যায় শুরু হয়েছে, তা যাতে কারোর অপরিণামদর্শী কর্মকা-ে বিনষ্ট না হয়, এ জন্য অবশ্যই বিশেষ সতর্কতা জরুরি। দেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় ৩২৫ দিনের মাথায় এসেছে মহামারি থেকে মুক্তির আশা জাগানো ণ। এরই মধ্যে দেশে এসেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ৭০ লাখ ৪ হাজার ডোজ 'কোভিশিল্ড' টিকা। অক্সফোর্ডের টিকা ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে আমাদের ঔষধ অধিদপ্তর।
এখন দরকার করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়ার কার্যক্রম সফল করতে ব্যবস্থাপনাগত যাতে কোনো ত্রুটি দেখা না দেয়, এ ব্যাপারে অধিকতর সচেষ্টা থাকা। এক কথায় ব্যবস্থাপনায়ই আমাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। টিকা গ্রহণের জন্য ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানোও জরুরি। একই সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আমলে রাখতে হবে। করোনা দুর্যোগকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বেসরকারি পর্যায়ের অসাধুরা নানারকম দুস্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। সরকার যদিও এসব ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়নি কিন্তু তারপরও যে নেতিবাচকতার পথ পুরোপুরি রুদ্ধ করা গেছে তা কিন্তু নয়। করোনার পরীা, মাস্ক কেলেঙ্কারিসহ যেসব দুস্কর্ম অতীতে হয়েছে টিকার েেত্র এর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। টিকা গ্রহণের েেত্র প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়ার জটিলতায় যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত না হয় এ জন্য সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে নিজ নিজ েেত্র যথাযথ কর্মতৎপরতার পরিচয় দিতে হবে। এ নিয়ে যাতে কোনো মহল ফের বাণিজ্যের দরজা খুলতে না পারে, এ ব্যাপারেও সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি দরকার। দুষ্টচক্রের যূথবদ্ধতা ভাঙতেই হবে। এত বড় কর্মযজ্ঞ যেন স্বেচ্ছাচারী কারোর স্বেচ্ছাচারিতায় কোনোভাবেই না হয় প্রশ্নবিদ্ধ!
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সফল বাংলাদেশ টিকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধে কৃতিত্বের দাবিদার। এ অবস্থায় বাংলাদেশে করোনার টিকা নেওয়ার েেত্র কারও কারোর আস্থাহীনতার যে খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, তা দূর করতে বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরকারের পাশাপাশি এ েেত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। টিকার কোল্ডচেইন মেনে চলার মতো সমতার ব্যাপারেও মনোযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য জনপরিসরে বারবার সহজভাবে উপস্থাপন করে যারা সংশয়াগ্রস্ত, তাদের সংশয় মুক্ত করতে হবে। উদ্দীপনা ও বাধ্যকতা সৃষ্টির প্রয়াসও চালানো যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক এই দু'ভাবেই এর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমাদের এও মনে রাখতে হবে, টিকা গ্রহণ করলেই ঝুঁকিমুক্ত হয়ে গেলাম তা মনে করার কারণ নেই। যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। আমরা অতীতে দেখেছি, স্বাস্থ্যবিধি মানতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এমনটি করতে হয়েছে আমাদের সমাজে সচেতনতার ঘাটতির কারণে। নিজের সুরা তো নিজেকেই করতে হবে।
চলমান জনস্বাস্থ্য সংকটের মুখে দরিদ্র দেশগুলোও চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব এই টিকা সংগ্রহ করার। আর এখানেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রভাব বিস্তারেরও। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় এও বলা যায়, বিশ্বের আরও দেশ দ্রুতই করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা উৎপাদনে সমতা দেখাতে পারবে বলে আশা করি। করোনাভাইরাস যেহেতু বৈশ্বিক সংকট, সেহেতু ভ্যাকসিন বা টিকা উৎপাদনকারী ধনী দেশগুলোকে এ ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ব সম্প্রদায় একতাবদ্ধ হয়ে চলমান এই সংকট উত্তরণের প্রয়াস চালানোটাই হবে সবার জন্য মঙ্গল। এই সংক্রমণ যেহেতু ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো পার্থক্য মানেনি, সেহেতু এর প্রতিরোধেও বৈষম্য যেন জিইয়ে না থাকে, এ ব্যাপারে টিকা উৎপাদনকারী ধনী দেশগুলোর উদারনীতি ও টিকা পাওয়ার যোগ্য সবার জন্য এর প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে 'টিকা কূটনীতি'র গুরুত্বও কম নয়। যে কোনো সময় অনেক দেশেই যে আবারও সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাও ভুলে যাওয়া চলবে না।
ইউরোপের কোনো কোনো দেশসহ বিশ্বের যেসব দেশে ইতোমধ্যে ফের সংক্রমণের তীব্রতা বেড়েছে, সেসব দেশে অবস্থানকারীদের যাতায়াতের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজনের নিরিখেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর করা দরকার। বাংলাদেশে সংক্রমণের তীব্রতা প্রকট হয়ে না উঠলেও ইতালি প্রত্যাগতদের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মধ্যে না রাখতে পারার কারণে প্রথমে আমরা কিছুটা হুমকির মুখেই পড়েছিলাম। আমাদের এখানে সংক্রমণের গতিটা শুরুতে ধীরই ছিল। কিন্তু গত জুলাই-আগস্ট মাসে হঠাৎ সংক্রমণের গতি বাড়ে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় শিথিলতার কারণে। আবার এও দেখা গেছে, সংক্রমণটা কমছে ধীরলয়েই। আমরা যদি জনস্বাস্থ্য সুরার ব্যাপারে কোনোরকম ঢিলেমি দেখাই তাহলে আমাদের ঝুঁকি আবার বাড়তে পারে। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে পুরো জনগোষ্ঠীকে সেভাবেই সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে। জীবন-জীবিকার বাস্তবতা তো আছেই। তবে এও তো গুরুত্বপূর্ণ, আগে সুস্থ থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে।
করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় আমরা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় সফল হলেও কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম কিংবা জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো সফল নই। করোনা থেকে মুক্ত থাকার প্রথম কাজ সংক্রমণ প্রতিরোধে সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে- প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে এই সংক্রমণ প্রতিরোধে যে বিষয়গুলো অত্যন্ত জরুরি, এ ব্যাপারে মোটেও উদাসীনতা কাম্য নয়। এ েেত্র সর্বাগ্রে আসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি। টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে বিধায় করোনার চিকিৎসা ত্রে সংকুচিত করা ঠিক হবে না। পরিস্থিতি পর্যবেণক্রমে এ পথে হাঁটতে হবে। সবাইকে যে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে তা তো নয়। কিন্তু কারোর মধ্যে সংক্রমণের লণ দেখা দিলে বা করোনা শনাক্ত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। সব কাজই সরকার করে দেবে না, নিজেকে সংক্রমণমুক্ত রাখতে ব্যক্তির দায়িত্বও অনেক বেশি।
আবারও বলি, টিকা ব্যবস্থাপনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সফলতা এ দুই-ই আমলে রেখে চলতে হবে। টিকার সংরণের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন। আমাদের দেশে চিকিৎসা সংশ্নিষ্ট প্রায় সবাই করোনাদুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। জীবনঝুঁকি নিয়ে তারা সেবা কার্যক্রম চালিয়েছেন। আমরা কয়েকজন চিকিৎসকসহ সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিকে হারিয়েছি, যারা সেবাদানে যুক্ত ছিলেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের চিত্র এক নয়। অনেক স্থানেই চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক অনেক কিছুরই ঘাটতি রয়েছে। আমাদের দেশে এখনও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোকে সেভাবেই প্রস্তুত রাখতে হবে। দূর করতে হবে সমন্বয়হীনতা। টিকা সংগ্রহের জন্য আমাদের আরও উৎসের দিকে হাত বাড়াতে হবে। বিশ্বের মোট চাহিদার শতকরা ২০-২৫ ভাগ টিকা সরবরাহ করার আর্থিক সামর্থ্য আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। তারা যদি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী টিকা না পায় তাহলে তারাই বা কী করবে! কাজেই বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়া নিজেরা টিকা কিনে সবার পে প্রয়োগ করা কঠিন বিষয়।
আরও একটি বিষয় পরিস্কার করা দরকার, কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর নয়। কিন্তু এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কিছু নেই। কোনো কোনো মানুষের েেত্র টিকা কাজ নাও করতে পারে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে নকল ওষুধের ছড়াছড়ি। এ েেত্র যাতে দুর্নীতিবাজরা এমন কিছু করতে না পারে, সরকারকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে টিকা উৎপাদনকারীদের কাছে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়ার তাগিদ কয়েক দফা দিয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের দতা বাড়াতে প্রশিণ কার্যক্রম চলছে। জনবল ইতোমধ্যে বাড়ানো হয়েছে, প্রয়োজনের নিরিখে আরও বাড়ানো দরকার। টিকাদানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে। পরিকল্পনায় বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রোপটে পরিবর্তনও আনতে হতে পারে। যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতার পথ রুদ্ধ করা সম্ভব সরকারের নির্মোহ ও কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করে। এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সবার যূথবদ্ধ প্রচেষ্টায়ই সফল হতে পারে এত বড় কর্মযজ্ঞ।
সাবেক অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়