অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা করোনা সনাক্তকরনের সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর টেষ্ট কিট উদ্ভাবনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরীক্ষা পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেইজ বেইজড টেষ্ট অথবা সেরোলজিক্যাল টেষ্ট হিসেবে পরিচিত। প্রথম পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংগৃহিত নমুনায় করোনার রাইবোনিউকিক এসিড আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এ পদ্ধতিটি সবচে বেশি নির্ভরযোগ্য। আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ২ থেকে ৫ ঘন্টা সময় লাগে। দ্বিতীয় পদ্ধতির পরীক্ষায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা দেখা হয়। কেউ যখন একটি জীবানু দ্বারা সংক্রমিত হন, তখন স্বাভাবিক শারিরীক রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়। এটাই এ পরীক্ষার ভিত্তি। রেপিড এন্টিজেন টেষ্টের এ পরীক্ষার সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট। তবে মার্কিন সংস্থা এফডিএ বলেছে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পিসিআর টেষ্টের মত সংবেদনশীল নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে দ্রুত টেষ্ট করার জন্য এ টেষ্টের অনুমোদন প্রক্রিয়া চলছে। সেই সাথে কোভিড’১৯ প্রতিরোধের জন্য উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। এখনো তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের কর্মকর্তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এ ভাইরাসের জেনেটিক কোড প্রকাশ করেছে। ফলে গবেষকদের গবেষনা সহজ হয়েছে। প্রায় ৩৫টি সংস্থা ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এর টিকা তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কোভিড’১৯ মোকাবেলায় প্রথম থেকেই জনগণকে সম্পৃক্ত না করার ফলে এবং সম্পূর্ণ আমলা প্রশাসন ও ব্যবসায়ী নির্ভর নীতি গ্রহণ করার ফলে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিপর্যের সম্মুখীন হয়। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বিমান বন্দর, স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দরে স্ক্রীনিং করা, কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক না করে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনে দ্রুত বিস্তার ঘটে। শতাধিক চিকিৎসকের মৃত্যু, ব্যাপক চিকিৎসকের সংক্রমিত হওয়া, মাস্ক, পিপিই প্রভৃতি নিয়ে দূর্নীতি, করোনা প্রতিরোধে হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াল চালু না করার ফলে জনমনে ভয়ানক দুর্ভোগ, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন স্বল্পতা, আইসিইউর স্বল্পতা, ঔষধের মূল্যবৃদ্ধি, কর্পোরেট ও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার মত বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে জনমনে এক মহাবিপর্যয় নেমে আসে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে ‘সীমিত টেষ্টের ব্যবস্থা চিকিৎসায় অবহেলার সামিল বলে অনেকে মনে করছেন। কমিউনিটি লেভেলে করোনা বিস্তার রোধে লকডাউন না দিয়ে “গণছুটি” ঘোষনা করায় আশানুরূপ ফল লাভ করা যায়নি। গণছুটির মাঝে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজে যোগদানের ঘোষনাটি ছিল সবচে বর্বরোচিত ঘটনা।
বাংলাদেশে কোভিড’১৯ টেষ্ট সরকারিভাবে ফি ধার্য করা হয়েছে। আশার কথা কোভিড’১৯ প্রতিরোধে সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীদের অকান্ত প্রচেষ্টায় কোভিড’১৯ ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়েছে। বায়ো-এন-টেক ফাইজার ভ্যাকসিন, অক্সফোর্ড এষ্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন, মডার্ণার টিকা, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাক্সিন, চীনের সিনোভেক ভ্যাকসিন বিশ্ব্রে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় সংগ্রহ করছে। কোভিড’১৯ মোকাবেলায় যেমন আমলা-ব্যবসায়ী নির্ভর কাজ হয়েছে তেমনি ভ্যাক্সিন সংগ্রহেও জাতীয়ভাবে একই নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। জীবন রক্ষায় বিদেশ থেকে ভ্যাক্সিন সংগ্রহকে অগ্রাধিকার ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিয়ে ব্যবসায়ীদের সংযুক্ত করা হয়েছে। অক্সফোর্ড এষ্ট্রাজেনেকার ২ ডলার মূল্যের ভ্যাক্সিন ঔষধ কোম্পানীকে যুক্ত করে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করার কারনে সরকার তা পাচ্ছে ৫ ডলারে। সম্প্রতি সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় এ ভ্যাক্সিন রপ্তানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সংবাদ প্রকাশ পাওয়ায় জনমনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। কিভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগন ভ্যাক্সিন পাবে সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগন জানে না কিসের ভিত্তিতে ভ্যাক্সিন প্রাপ্তির অগ্রাধিকার নীতি তৈরি করেছে? কোভিড’১৯ মোকাবেলায় সম্মুখসারির যোদ্ধা ডাক্তার নার্স- স্বাস্থ্যকর্মী-পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সর্বাগ্রে দিতে হবে। দিতে হবে সমাজকর্মী, জরুরী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের। বিনামুল্যে সরকারীভাবে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে হবে। ভ্যাক্সিন নিয়ে কোন ব্যবসা চলবে না এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেককে সরকার গত ৫ই জানুয়ারি’২১ প্রয়োজনীয় টিকা উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। অক্সফোর্ড-এষ্ট্রাজেনেকা কোভ্যাক্সের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছিল। কথা ছিল অলাভজনক ভিত্তিতে টিকা বিক্রি করতে হবে। সেক্ষেত্রে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সরকার ও ঔষধ কোম্পানীর বাণিজ্যিক চুক্তি শর্ত ভঙ্গের একটি দৃষ্টান্ত।
কোভিড’১৯ ভ্যাক্সিন অনুমোদিত হয়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, তাহলো যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে ভ্যাক্সিনটি পৌচছে কিনা। এ চ্যালেঞ্জ শুধু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নয় বরং দেশে দেশে এ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশে জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অনেকেই নিবন্ধন করতে পারছেন না। ২৭শে জানুয়ারি’২১ থেকে নিবন্ধন শুরু হয়েছে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি’২১ পর্যন্ত সারা দেশে ১লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ করোনার টিকার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে যেখানে ইন্টারনেট সংযোগসহ প্রযুক্তির সুযোগ সুবিধা কম অথবা অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর নিকট স্মার্টফোন নাই, সেসব ক্ষেত্রে নিবন্ধন করা আরও কঠিন হবে। সহজে টিকা পাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে গেলে টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে তিন কোটি টিকা কিনেছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ টিকা দেশের গুদামে মজুদ আছে। এছাড়া ভারত সরকার উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে ২০ লাখ টিকা দিয়েছে।
টিকাদান প্রক্রিয়ায় একটু পরিবর্তন এনেছে সরকার। সরকারের হাতে এখন ৭০ লক্ষ টিকা আছে। আগের পরিকল্পনা ছিল এমাসে ৬০ লক্ষ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। এখন দেয়া হবে ৩৫ লক্ষ মানুষকে। প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজ আট সপ্তাহ পর দেয়ার কথা ছিল। এখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে চার সপ্তাহ পর। কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা যে টিকা পেয়েছি তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই। আমরা ৩৫ লাখ মানুষের টিকা দেয়া নিশ্চিত করতে চাই। এরপর আরও টিকা এলে সেভাবে মানুষকে দেয়া হবে।” তবে কেন এ পরিবর্তন তা স্পষ্টভাবে বলেনি সরকারী কর্মকর্তারা। ভারত থেকে টিকা আনার ব্যাপারে কোন ঝুঁকি আছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, তেমন কোন ঝুঁকি নাই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: এবিএম খোরশেদ আলম বলেছেন- “বৈশ্বিক যা পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, যদি কোন কারণে আমরা আমাদের সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতে না পারি তাহলে টোটাল ম্যানেজমেন্ট ফেইলিউর হবে।” তিনি বলেন, সে কারণে ৭০ লাখ ডোজ অর্ধেক করে ৩৫ লাখ মানুষকে দেয়া হবে। ৩৫ লাখ মানুষের দু’ডোজ স¤পন্ন করা হবে। এর মধ্যে টিকার দ্বিতীয় চালান এলে আগের পরিকল্পনামত টিকা দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সারা বিশ্বের টিকা নিয়ে “ক্রুশিয়েল পলিটিক্স” চলছে। বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, “এমাসের ২১ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তির ৫০ লাখ টিকা আসবে। আমরা নিতে প্রস্তুত কিনা তা সেরাম ইনষ্টিটিউটকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি’২১ এর মধ্যে জানাতে হবে। সরকার প্রস্তুত থাকলে টিকা আনার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নাই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন টিকা ছাড়া করোনা ভাইরাস নির্মূল করা দুরুহ ব্যাপার। পূর্বের ইতিহাসেও তাই বলে। টিকা প্রয়োগের ফলেই পূর্বে প্লেগ ও পোলিওসহ অন্যান্য মহামারী বিপর্যয়কে ঠেকানো হয়েছে। তারপরও টিকা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য মন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন টিকা নিয়ে মানুষের মনে যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। তাছাড়া এরই মধ্যে যারা টিকা দিয়েছেন তাদের মাঝে খুব একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নাই। করোনার টিকা নেয়ার জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সুরক্ষা নামে একটি অ্যাপস তৈরি করেছে। যেখানে টিকা নেয়ার জন্য নিবন্ধন করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন যাদের পক্ষে নির্ধারিত অ্যাপসে নিবন্ধন করা সম্ভব না তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টিকা নেয়ার পরও নিবন্ধন করা যাবে বলে তিনি জানান। রেজিষ্ট্রেশন করা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে ভ্যাক্সিন দেয়া। ফর্ম ফিলাপ করে সই রেখে দেয়ার পর কম্পিউটারে তালিকাভুক্ত করা হলে ডাটা এন্ট্রি হয়ে থাকবে। তবে কোনক্রমেই টিকা গ্রহণ করা থেকে জনসাধারনকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করা যাবে না। এতে করোনা ভাইরাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে অনেক বেশি সময় লেগে যাবে।
যাদের জন্য টিকা দেয়া নিষেধ তারা হচ্ছেন-
১. ঔষধে এলার্জি যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে টিকা না নেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
২. ১৮ বছরের কম বয়সী নারী-পুরুষ, গর্ভবতী মহিলা ও স্তনদানকারী মাতৃগণ টিকা নিতে পারবেন না।
৩. করোনায় ভুগেছেন অথচ সুস্থ হওয়ার পর চার সপ্তাহ পার না হলে টিকা নিতে নিষেধ করা হয়েছে।
৪. এখনও জ্বরে ভুগিতেছেন এমন রোগী টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকুন।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল