ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নীরব বিপ্লবের কথা
Published : Tuesday, 16 February, 2021 at 12:00 AM
নীরব বিপ্লবের কথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||

ইংরেজি নববর্ষে (২০২১) বাংলাদেশে দু’টি নীরব বিপ্লব হয়ে গেলো। বিপ্লবের খবর আমরা সকলেই শুনেছি, উপভোগ করেছি, কিন্তু প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। একটি বিপ্লব ছিল খুবই ইতিবাচক, অন্যটি শুধুই নেতিবাচক।
    ইতিবাচক বিপ্লবটি হলো মুজিববর্ষে সরকারের অঙ্গীকার পূরণের প্রথম ধাপ হিসেবে ৭০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন হতদরিদ্র পরিবারকে ভূমি ও গৃহদান। এ উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন যে সামগ্রিকভাবে কত বিশাল কর্মযজ্ঞ তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেনি। যেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এই ভূমি ও গৃহদানের প্রতিক্রিয়ার উদ্বোধন করলেন, কতিপয় জাতীয় পত্রিকায় দায়সারা গোছের মন্তব্যে হতবাক হয়েছি। অধিকাংশ পত্রিকা যুগান্তকারী কর্মযজ্ঞের জন্য বর্তমান সরকার ও সরকার-প্রধানকে অভিনন্দন জানিয়ে ইতিবাচক নির্মোহ প্রশংসা করেছেন, তাতে তৃপ্তি পেয়েছি অনাবিল। যে দেশে ভূমি দখলের কথাই শোনা যায় নিত্যনৈমিত্তিক, সেখানে ভূমিদান, গৃহদান-এর মতো মহৎ কাজের বিষয়টি যে কত গৌরব ও অহংকারের তা যখন কোনো কোনো ব্যক্তি-সংস্থা-রাজনৈতিকদলের ঈর্ষাকাতরতার উপকরণ হয়, তখন যেন ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে চিনতে পারি না। আবার ভূমি-খেকোরা যখন সরকারি দলের পা-া হিসেবে এই মহৎ কর্মযজ্ঞে উচ্চস্বরে ভূমিদান-গৃহদান অনুষ্ঠানে বিজয় গাথা উচ্চারণ করতে থাকেন, তাদেরকেও তখন চিনতে পারি না। মনে প্রশ্ন জাগে-তারা কারা? চোরের মার বড় গলা।
    পড়েছি, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে একজন কংগ্রেসনেতা আচার্য বিনোভাবে ভূমিদান আন্দোলন করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ভূস্বামীদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত ভূমি ভিক্ষা হিসেবে নি:শর্ত গ্রহণ করতেন এবং সেই ভূমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এভাবে অগণিত ভূমিহীনকে ভূমির মালিক-স্বত্ব দিতে পেরেছিলেন। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিটির জীবনপাঠে অভিভূত হয়েছিলাম এবং তাঁর ইচ্ছামৃত্যু পরিগ্রহণের বিষয়টি আমার কষ্ট যাপনের কারণ হয়েছিল। তিনি শ্রীমদ্ভগবতগীতা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছিলেন, যার ভূমিকা লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। শ্রীগীতার মূলকথা হলো ‘ত্যাগ’। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন- গীতা শব্দটি দশবার উচ্চারণ করলে ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। এই ‘ত্যাগ’ বা ‘ত্যাগী’ হওয়াই মানবজীবনের সার্থকতা। আচার্য বিনোভাবে এই ত্যাগ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং জীবন দিয়ে এ কাজটি করে এক সময় নিজেকে ‘ইচ্ছামৃত্যু’ পরিগ্রহণ করে অপ্রকট হলেন। তাতে যেমন মানবসেবা, মানবজীবনের সারবত্তা এবং ত্যাগই জীবন, তার আস্বাদ পাই, তেমনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগও ঘটে। বাংলাদেশের সংবিধানে আছে-জনগণই দেশের মালিক। তাই যদি হয়, তবে এ আমাদের দেশের মানুষ কেন ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে? বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করলেন, তাঁর মননে নিশ্চয়ই এই বিষয়টি যাপিত ছিল। তিনি নেই, সেজন্য তো তাঁর আকাক্সক্ষা-প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে থাকবে না। আমরা তথা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের তথাকথিত অবৈধ সরকার সমূহের চরিত্র নিয়ে অধিক লেখার প্রয়োজন বোধ করি না। শুধু অবাক হই-বঙ্গবন্ধুর রক্তের দায়ের হিসেব মিলাতে গিয়ে লক্ষ্য করি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দূরে থাকার কারণে তাঁর দু’কন্যা বেঁচে যাওয়ার ফলে আজ বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাপূরণের মহা কর্মযজ্ঞটি বাস্তবে রূপলাভ হতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে সত্তর হাজার গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবার বাড়ি পেল, পরবর্তীতে দু’লক্ষের বেশি পরিবার অচিরেই ঠাঁই পাবে। আর যাদের ভূমি আছে, গৃহ নেই, তারাও গৃহ পাবে। বাংলাদেশের মানুষ একসময় অভুক্ত থাকতো, এখন এ কথা শোনা যায় না। একসময় বস্ত্রহীন ‘বাসন্তী’কে উলঙ্গ সাজিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিয়েছিল, এখন বস্ত্রের অভাব নেই, রাস্তাঘাটে ২০ গজী কাপড়ের পোষাক পরিহিত লোক দেখা যায়। এখন থেকে আর কেউ ভূমিহীন-গৃহহীনও থাকবে না। যে দেশের মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব থাকবে না-এ দেশটিকে ‘সোনার দেশ’ বলা যায় কি? এখন বাংলাদেশ কি নামে পরিচিত হবে? ‘সোনার বাংলা’ বলতে কি পারব না? বঙ্গবন্ধুর দেশটি আজ ‘সোনার বাংলা’। তা বলতে আর দ্বিধা নেই।
    মৌলিক অধিকারের আরো দুটি শর্ত হলো- স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এই দু’ক্ষেত্রে এখন চলেছে আকাল। স্বাস্থ্য খাত এখন দুর্নীতির শীর্ষে। এ বিষয় লিখতে গেলে মহাভারতও হার মানবে। শিক্ষাক্ষেত্র কি ধোয়া তুলসী পাতা? কখনো নয়। এ নিয়ে একটু বলতে চাই।
    বাংলাদেশের যে দ্বিতীয় নেতিবাচক নীরব বিপ্লব হয়ে গেল, তা হলো ১৩ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষাহীন ‘অটোপাস’ কর্মযজ্ঞটি। আমার স্কুলজীবনে একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বলতেন-‘ছাত্রজীবন খুবই মধুর জীবন, যদি পরীক্ষা না থাকত।’ ছাত্রদের কাছে পরীক্ষা নামক ভীতিটাই গোটা ছাত্রজীবনকে কঠোর শাসন করে থাকে, নিয়মতান্ত্রিক জীবনগঠনের পথ দেখায়, মানুষ হওয়ার কৌশল শিক্ষা দেয়, খ্যাতিমান হওয়ার পাঠদান করে। সুতরাং ছাত্রজীবনে যদি পড়াশোনার শেষ হিসাব মিলাতে পরীক্ষা নামক মানদ-টি দিয়ে পরিমাপের বিষয়টি কোনো কারণে হারিয়ে যায়, তাহলে জীবন কেমনে গঠিত হবে, মানুষ হবে কী করে, খ্যাতিমান হওয়ার সুযোগ কোথায়? ১৯৬২ সালে একবার অটো গ্রেজুয়েট হয়েছিল তৎকালীন ¯œাতক পড়–য়া একদল ছাত্র/ছাত্রী। এই দায় থেকে তারা সারাজীবন স্বস্তিবোধ করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর শটকার্ড পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় যে সকল ছাত্র/ছাত্রী লাভবান হয়েছিল, ব্যবহারিক জীবনে এই ঘাটতি তখন ঘানিটানা বৃষের মতো চোখ বাঁধা জীবনযাপন করতে হয়েছে, হচ্ছে। করোনার কারণে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, ছাত্র/ছাত্রীরা তাদের সোনালী সময় হারিয়ে ফেলছে, যে সময়টা তারা মানুষ ও খ্যাতিমান হওয়ার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করার কথা, তারা আজ গৃহ-বন্দি, বেকার। সময় কাটাচ্ছে নিজের মতো করে, যা প্রথাগত কোনো শিক্ষাই নয়। তা পূরণ হয়ত হবে না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তা পূরণ করা যায়। বৃহত্তর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের যেমন মূল্য রয়েছে, আবার জীবন সংগঠনের জন্য ২/৩ বছর হারিয়ে গেলে তেমন ক্ষতি হবে না হয়ত। তবে ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই কষ্টকর।
    এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হলো না। ছাত্র/ছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। যদি যথানিয়মে যথাসময়ে পরীক্ষা হতো, নিশ্চয়ই শতভাগ পাশ করতো কি? শিক্ষামন্ত্রণালয় এত উদার হলেন, কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে চাইলেন না, এমন কি অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় যে ফলাফল তার সঙ্গে সংগতি না রেখে জিপি-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন এবং পরবর্তী যুদ্ধের জন্য ভোঁতা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন-তাতে যুদ্ধজয়ের বিষয়টি কি ঝুলে গেল না? কারণ, মনে যে দ্বিধা-‘অটোপাশ’। একটা পরীক্ষা নামক যুদ্ধে যে অংশ গ্রহণ করা হলো না? মনে সাহস থাকবে তো? এটা কি সারাজীবন যন্ত্রণা দিবে না? মনকে সংকুচিত করে রাখবে না? যে নীরব বিপ্লব ঘটানো হলো, আমরা জানলাম, আনন্দ-উপভোগ করা গেলো না, একটি মিষ্টিও কেনা হলো না, অহংকারী উঁচু কণ্ঠে সংবাদটি জানানো গেল না? এ দায় কি সারাজীবন কেবল অটোপাশের ছাত্র/ছাত্রীই বহন করবে? পরিবার-দেশ বা জাতি তা বহন করবে না? তারা কি সম্পদ বা বস্তু, কি হিসেবে বিবেচ্য হবে? শত প্রশ্ন, উত্তর নেই। বিপ্লবের ফসল যেমন কখনো কখনো গৌরবের-অহংকারের হয়, আবার লজ্জার বিষয়-আশায়ও হয়। এই যে ১৩ লক্ষ শিক্ষার্থীর জীবনে ‘অটোপাশ’ সিলমোহর এঁটে দেয়া হলো-এ দায় কার? কী হতো একটি শিক্ষা বছরকে পিছিয়ে দিলে? আমিই কি একজন মাত্র চিন্তক? যারা দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটালেন, তাঁরা সংখ্যায়-মানে-বিবেচনায়-দূরদর্শিতায় আমার চেয়ে শত গোনে গুণবান। তাঁদের প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, দেশ-জাতির প্রতি দয়াবদ্ধতা অনেকটাই প্রশ্নাতীত, তারপরও একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার কথা না বলে থাকতে পারিনি। আমি নাম উচ্চারণ করব না, কিন্তু বলব যে আমার চেনা জানার মধ্যে এমন অনেকজন আছেন, তাঁদের ছাত্রজীবনে পরীক্ষা পাশ নামক কঠিন দেয়াল অতিক্রম করতে একই শ্রেণিতে ২/৩ বার সময় দিতে হয়েছে। ৫/৭ বারে ¯œাতক পাশ করেছেন, তাঁদেরকে আমি চিনি-জানি। এই যে পরীক্ষা পাশের জন্য ফেল করে ২/৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, এজন্য তাঁদের জীবন নষ্ট হয়ে যায়নি, তাঁরা সেবছরগুলোর জন্য আপসোস করতেও শুনিনি। আমরা অনেকে শুনেছি ভিক্টোরিয়া কলেজের শ্রদ্ধাভাজন প্রতিষ্ঠাতা- অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ বসু নাকি সাতবারে মেট্রিক পাশ করেছিলেন। কথাটি সত্য কিনা জানি না, তবে প্রবাদতুল্য। অধ্যাপক আবুল ফজলুল বলেছিলেন-অনেক ক্ষেত্রে আপস করা গেলেও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আপস চলে না। এব্যাপারে কোনো সহানুভূতি নেই, রাজনীতিও নেই। যে অটোপাশের দায় ১৩ লক্ষ ছাত্র/ছাত্রীর কপালে ‘তিলক’ হিসেবে সারাজীবনের জন্য লেপন করা হলো, তার কষ্টটা খুবই বিব্রতকর, গৌরবের নয়।
    বিশ্বে চলেছে করোনা ভাইরাস। ভারতচন্দ্রের কথা ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ সুতরাং এই ভাইরাসে বাংলাদেশও আক্রান্ত। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং ব্যবস্থা গ্রহণে তুলনামূলকভাবে আমরা অনেকটাই সাহনীয় অবস্থায় জীবনযাপন করছি। অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিকতায় যে ধস নামার আশঙ্কা করা গিয়েছিল, সদাশয় সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত পরিচালনার ফলে আমরা অনেকটাই স্থিতাবস্থায় রয়েছি। এমন কি বিশাল কর্মযজ্ঞ ‘পদ্মাসেতু’ নির্মাণ কাজেও স্থরিবতা সৃষ্টি হয়নি। রাজনৈতিক কর্মকা-ও চলেছে রুটিন মাফিক। হাটবাজার-কলকারখানা চলেছে আগের মতো, গাড়ি চলেছে যাত্রী বোঝাই অবস্থায়, সামাজিক অনুষ্ঠানও হচ্ছে প্রায় আগের মতোই। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে একটা বিশেষ বয়সের শিক্ষার্থীদেরকে ঘরে আটকিয়ে রাখার বিষয়টি যেন প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে সরকারের নির্দেশ না মানলেও চলে, সেখানে কিন্তু সবই আগের মতো ঠিকঠাক। সুতরাং এই বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
    দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন এসেছে। মানুষ আগ্রহ সহকারে ভ্যাকসিন নিতে ভীড় জমাচ্ছেন ‘কেন?’ এ প্রশ্নটি রেখেই আমার লেখাটি ইতি টানছি।
‘মরিতে চাই না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’