মাসুদ আলম ||
কুমিল্লায়
করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা নিতে ক্রমেই সকল শ্রেণি- পেশার মানুষের
মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। প্রথম দিনের তুলনায় দ্বিতীয় দিন থেকে টিকা গ্রহীতার হার
প্রতিদিনই ১০০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কুমিল্লায় টিকা প্রদানের
কার্যক্রম আরম্ভ হওয়ার পর চতুর্থ ও পঞ্চম দিন অর্থাৎ গত বুধ ও বৃহস্পতিবার
জেলার ২৪টি কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড় ছিল উপচে পড়ার মতো। সর্বশেষ
গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লা জেলায় সব বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার
মানুষ করোনার ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজারই উপজেলা পর্যায়ের
বাসিন্দা। এতে করে বলা যায়, কুমিল্লায় শহর কিংবা গ্রামÑ সব জায়গাতেই টিকা
নিতে সব শ্রেণির মানুষের আগ্রহ বেড়েছে সমান তালে।
ওদিকে টিকা নিতে
নিবন্ধনকারীর সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। অনেকাংশে কুমিল্লা জেলা স্বাস্থ্য
বিভাগের টার্গেটকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ও টিকা নেয়া মানুষের
উপস্থিতি।
বয়স্ক পুরুষই বেশি:
গতকাল শনিবার কুমিল্লা সদর
(জেনারেল) হাসপাতালে টিকাকেন্দ্রের বুথ ঘুরে দেখা যায়, মানুষ উচ্ছ্বাস নিয়ে
টিকা নিতে কেন্দ্রে এসেছেন। টিকার প্রতি মানুষের আগ্রহ যে অনেক বেড়েছে, তা
মানুষের উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে। কুমিল্লা সদর হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রে
চারটি বুথ রয়েছে। শনিবার সকালে গিয়ে সবগুলো বুথেই মানুষের দীর্ঘ সারি চোখে
পড়ে। তবে চারটি বুথের মধ্যে মাত্র একটি সারিতে রয়েছে নারী। বাকি তিনটি বুথে
পুরুষের দীর্ঘ লাইন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা সদরের এই কেন্দ্রের
মতো জেলার বাকি ২৩টি টিকাদান কেন্দ্রে একই অবস্থা। পুরুষের তুলনায় নারীদের
মধ্যে এখনও টিকা নেয়ার আগ্রহ তেমন বাড়েনি।
কুমিল্লা জেলা সিভিল
সার্জনের তথ্যমতে, কুমিল্লায় ৫ দিনে ২০ হাজার টিকা গ্রহীতার মধ্যে মাত্র ৬
হাজার নারী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পুরুষদের টিকা গ্রহণের হার প্রায় ৭০
শতাংশ আর নারীদের মাত্র ৩০ শতাংশ। এছাড়া টিকা গ্রহীতাদের বয়স হিসাব কওে
দেখা যায়, কুমিল্লায় বয়স্ক ব্যক্তিরাই বেশি টিকা নিচ্ছেন। টিকাকেন্দ্রের
বুথের সারিতে যুবক-যুবতীদের টিকা নেয়ার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ৪০ থেকে ৫০
বছরের বেশি বয়সের মানুষরাই টিকা নিতে আগ্রহী। এছাড়া ৩০-এর নিচের বয়সীদের
টিকা নেয়ার হার খুবই সামান্য বলে জানান কুমিল্লায় টিকাদান সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তারা।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রে দায়িত্বরত
কয়েকজন চিকিৎসক জানান, শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কুমিল্লায় প্রায় ১৪
হাজারেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে শতাধিক মানুষ কেন্দ্রে এসেই
নিবন্ধন করেছেন। বেশিরভাগই বয়স্ক পুরুষ। নিবন্ধনের জন্য হাসপাতালের
টিকাকেন্দ্র্রে চারটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নিবন্ধন করতে কর্মীদের একটু
কষ্ট হলেও মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। তবে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা আছে এমন
ব্যক্তিরা নিবন্ধন করে কেন্দ্র্রে এলে টিকাদান প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে বলে
তিনি মনে করেন।
‘টিকা নিয়েছি, ভয় নাই, আপনারাও আসুন’:
এই বুথে
শনিবার করোনাভাইরাস প্রতিষেধক টিকা নেন ৭০ বছর বয়সী আবদুল মতিন। তিনি
কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার বাসিন্দা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও
মানসিকভাবে তিনি বেশ শক্ত বলে মনে হলো। ভ্যাকসিন নিয়ে ছড়ানো গুজবকে উড়িয়ে
দিয়ে আব্দুল মতিন বলেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলো। আশায়
ছিলাম এই ভ্যাকসিনের জন্য। কুমিল্লায় ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরেই
টিকা নিতে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। কোনো গুজবে কান না দিয়ে আমি টিকা নিতে
নিবন্ধন করে আজ সকাল সকাল এসে টিকা নিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ
মানুষের প্রতি আমার মতামত ও পরামর্শ থাকবে, গুজব না ছড়িয়ে স্বাস্থ্য
বিভাগের প্রদ্ধতি অনুসরণ করে টিকা নিয়ে দেশকে করোনামুক্ত করুন। আর আপনি
টিকা নিতে না চাইলে গুজব ছড়িয়ে অন্যদের বিভ্রান্তিতে ফেলবেন না।’
আব্দুল
মতিন বলেন, ‘আমি টিকা নিয়েছি। কোনো রকম ব্যথা অনুভব হয়নি। সাধারণ ইনজেকশের
চেয়েও খুব সাধারণ। প্রথম প্রথম মনে একটু ভয় থাকলেও নেয়ার পর কোনো আতঙ্ক
নেই।’
৪৫ বছর বয়সী বুন্টি মজুমদার নামে এক নারী টিকা গ্রহীতা বলেন,
‘একটু আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে তিনি গত ৪ ফেব্রুয়ারি টিকা পেতে নিবন্ধন করেন।
বৃহস্পতিবার তার স্বামী টিকা নিয়েছেন। টিকা নেয়ার পর হালকা একটু জ¦রের
অনুভূতি দেখা দেয় তার শরীরে। একদিন পরই তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যান। আমি
সকল শ্রেণির নারীদের বলবো, গুজবে কান না দিয়ে টিকা নিতে আসুন।’
বাড়ছে টিকা-উচ্ছ্বাস:
কুমিল্লা
নগরীর বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি চাকরিজীবী বলেন,
‘কোভিড-১৯ গোটা বিশ^কে গ্রাস করে নিয়েছিলো। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য
আমরা অনেক যুদ্ধ করেছি। চলমান এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী
আমাদের জন্য ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছেন। আমাদের সেই ভ্যাকসিন গ্রহণ করে দেশকে
করোনা ভাইরাসমুক্ত করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আগ্রহ প্রকাশ করে
টিকা নিয়েছি। পরিবারের সদস্যদেরকেও টিকা নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। যারা
টিকা নেননি, তাদেরকে বলবোÑ টিকা নিয়ে নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত করুন।’
টিকা
নেয়া মানুষের আগ্রহের বিষয়ে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. নিয়াতুজ্জামান
জানান, কুমিল্লায় প্রতিদিনই টিকার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। শনিবার
দুপুরেই কুমিল্লার সদর কেন্দ্রেই প্রায় দুই হাজার মানুষ টিকা নিয়েছেন।
জেলার ২৪টি কেন্দ্রের মধ্যে উপজেলা কিংবা জেলা সদরÑ সবখানেই মানুষ
উচ্ছ্বসের সাথে টিকা নিচ্ছেন।
নারী কেন কম?:
করোনার
টিকা-উচ্ছ্বাসে পুরুষের তুলনায় নারী পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে
কুমিল্লার সিভিল সার্জন বলেন, নারীদের টিকা গ্রহণের হার কম হওয়ার সম্ভাব্য
কারণ বেশ কয়েকটি। কাজকর্ম ও চাকরির কারণে পুরুষরা বেশিরভাগ ঘরের বাইরে
অবস্থান করেন। এ কারণে সহজে তারা টিকাকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিচ্ছেন। এটি একটি
কারণ হতে পারে। আবার এখন পর্যন্ত যেসব ক্যাটাগরিতে টিকা দেওয়া হচ্ছে,
তাতেও নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। গার্মেন্ট ও বেসরকারি সেক্টরে
নারীরা বেশি চাকরি করেন। টিকার জন্য এই সেক্টরগুলো এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি।
এসব সেক্টর উন্মুক্ত হলে তখন হয়তো নারীদের মধ্যে টিকা গ্রহণের হার বাড়বে।
আবার,
তিনি বলেন, কুমিল্লায় করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
নারীদের তুলনায় করোনায় পুরুষ প্রায় তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুও
প্রায় তিনগুণ বেশি পুরুষের। সুতরাং এ কারণেও হয়তো টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও
পুরুষের আগ্রহ বেশি। ‘তবে’, তিনি বলেন, ‘আমাদের আহ্বান থাকবে, যার যখন সময়
হবে, তিনি যেন তখনই টিকা নিয়ে নেন। কারণ, করোনায় একমাত্র টিকাই আপনাকে
সুরক্ষিত রাখবে।’