নিজস্ব
প্রতিবেদক: বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে
উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার কৃতিত্ব জনগণকে দিয়েছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এই অর্জন তুলে ধরতে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, “এ কৃতিত্ব সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের।
“দেশে-বিদেশে প্রবাসে যারা আমি সকলকে এই কৃতিত্বের অংশীদার মনে করি। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।”
সংবাদ
সম্মেলনের শুরুতেই বলেন, “আজ অবশ্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি
বাংলাদেশের একটি মহৎ এবং গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য।
“বাংলাদেশ
গতকাল স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের
চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে।আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা
অর্জন করেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের।”
ল্য
অর্জনের এই সময়ের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের এই উত্তরণ এমন
এক সময়ে ঘটল,যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি;সেই সাথে আমাদের মহান
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ
এক ঐতিহাসিক ঘটনা।”
১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা
ইউএন-সিডিপির সব শর্ত পূরণ করে ২০১৮ সালে।
জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো
দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদ- পূরণে সম হলে
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়।
সিডিপি তিনটি
সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে।
তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে।
উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশ ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার।
প্রধানমন্ত্রী
বলেন, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ
মানদ-ের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদ-
৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫.৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে
উত্তরণের জন্য মানদ- নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। কিন্তু ওই সময়ে এেেত্র
বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭।
সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী, উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতিকালীন সময় ভোগ করতে পারে।
নিউ ইয়র্কে ইউএন-সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে আসা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বোন শেখ রেহানা।
সংবাদ
সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে একটা
স্বীকৃতি পেলাম। এই খবরটা আমি কার কাছ থেকে সর্ব প্রথম পাই..শেখ রেহানা।
তার কাছে বহু খবর আসতে থাকে এবং সে ই প্রথম আমাকে সাড়ে ৯টার সময় জানায়।”
শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, উন্নয়নের চলমান গতিধারা বজায় থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে উঠবে।
“আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
তিনি
বলেন, “আমি এই অর্জনকে উৎসর্গ করছি আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মকে,তরুণদের
জন্য। যারা আজকের বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার
বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।”
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা পাকিস্তান আমলে
বাংলার বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের
পর উন্নয়নের ল্েয যাত্রার শুরুর কথাও বলেন তিনি।
“একটা প্রদেশের
প্রশাসনকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটা স্বাধীন
দেশের উপযোগী করে একেবারে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে দেশের পুনর্গঠনের কাজ
শুরু করেন। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীসহ দেশের অভ্যন্তরে
উদ্বাস্তু হয়ে পড়া প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে পুনর্বাসন করেন। শহীদ
পরিবার, নির্যাতিত পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা, ঘরবাড়ি হারানো সকলকে সহযোগিতার
হাত বাড়িয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ৭ শতাংশ
অতিক্রম করে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করে।”
১৯৭৫ সালের ১৫
অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের উল্টো পথে যাত্রা এবং আওয়ামী লীগ
মতায় ফেরার পর আবার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।
জাতির
পিতাকে হত্যার পর ৬ বছর নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে শেখ
হাসিনা বলেন, “মানুষের এই কষ্ট দেখে এই প্রতিজ্ঞাই নিয়েছিলাম যে আল্লাহ যদি
কখনও আমাকে সুযোগ দেন তাহলে দেশ পরিচালনার েেত্র আমি গ্রামকেই সর্ব্বোচ্চ
অগ্রাধিকার দেব। গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করব।
“তখন ৭০-৮০
ভাগের উপরে মানুষ গ্রামে বাস করতো। আমার মনে হয়েছিল এদের যদি
দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশকে আমরা অতিদ্রুত দারিদ্র্যের
হার থেকে রা করতে পারব।”
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকের যেই অর্জন,
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তা আমাদের বিগত ১২ বছরের
নিরলস পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল। আর দেশের মানুষই কিন্তু এসব
কাজ করে দিয়েছে। আমরা শুধু সরকার থেকে নীতি সহায়তা দিয়ে সুযোগ তৈরি করে
দিয়েছি।
“এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। প্রিয়
সাংবাদিকবৃন্দ নিশ্চয়ই আপনারা সেটা স্বীকার করবেন। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে
যাওয়া বাংলাদেশ।”
বদলে যাওয়া এই দেশকে বুঝতে আর্থিক এবং অন্যান্য সূচকগুলোর দিকে সবাইকে দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী
বলেন, ২০০৮-০৯ বছরে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০১৯-২০ সালে তা ৩৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
২০০৮-০৯ বছরে
রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০ দশমিক
পাঁচ-চার বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯
অর্থ বছরে ৭ দশমিক চার-সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে
৪৪ দশমিক শূন্য-তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০১ সালে দেশে দারিদ্র্যের
হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে
দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ১০.৫
শতাংশে।
২০০৯-১০ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত মতা ছিল ৫,২৭১ মেগাওয়াট।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত এবং বিদ্যুৎ
সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা বলেন
প্রধানমন্ত্রী।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের
বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় এবং
মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও স্বয়ং-সম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১
দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
উন্নয়ন অভিযাত্রায় ’ডিজিটাল
বাংলাদেশ’ এর সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়েও বিস্তৃত হওয়ার
কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথাও তিনি বলেন।
করোনাভাইরাস
মহামারীর এই সময়ে গণ টিকাদানের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন,
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ
একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে।
তবে এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করার উপর জোর দেন তিনি।
এল্েয
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড
এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প,
মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প
বাস্তবায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং
আইটি ভিলেজ নির্মাণের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, “বাঙালি
বীরের জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন কেউ দাবায়ে
রাখতে পারবা না। বাঙলিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি,পারবে না। আমি দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করি আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে
বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
তিনি
বলেন, “সামনে এগিয়ে যাওয়ার সব রকম প্রস্তুতি আমাদের আছে। উন্নয়নশীল দেশ
হিসেবে কী কী করণীয়, সেই ব্যাপারেও আমাদের চিন্তা ভাবনা রয়েছে। সেটাও আমরা
পদপে নিচ্ছি। আমাদের যথেষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সেইভাবেই চলব।”
করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা।