ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শেষ নমস্কার
Published : Tuesday, 2 March, 2021 at 12:00 AM
হরিশংকর জলদাস।।একজন মানুষের পরিচয় দু’ভাবে দেওয়া যায়। এক-তার বাহ্যিক অবয়বগত পরিচয়, দুই-তার অন্তরগত পরিচয়। মানুষের বাহ্যিক অভিজ্ঞান প্রায় একই। দুটি হাত, দুটি পা, নাসিকা-চক্ষু-আঙুল-এসব প্রত্যঙ্গে মানুষে মানুষে তেমন ফারাক নেই, যা একটু আছে, তা গায়েব রঙের ক্ষেত্রে। কেউ কালো, কেউ ধলো, কেউ ফরসা, কেউ-বা শ্যামলা। কিন্তু মানুষের ভেতরের পরিচয়টা বহু বিচিত্র। প্রণতি-অবজ্ঞা, ঘৃণা-প্রেম, বিনয়-ঔদ্ধত্য, ঈর্ষা-রিরংসা, জিঘাংসা-অভিমান, মাতৃত্ব-হিং¯্রতা-এসব নিয়েই মানুষের ভেতরের জগতটা। এই ভেতরজগতের বিবরণ দেওয়া বড় একটা জটিল ব্যাপার। তেমন দক্ষ কথাশিল্পীই শুধু পারে মানুষের অন্তরগত পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে তুলতে। সে সক্ষমতা আমার নেই। আরতি ভৌমিকের ভেতরগত রূপ-রূপান্তরের প্রতিচিত্র তৈরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার পরও তাঁকে যতটুকু দেখেছি এবং তাঁর সম্পর্কে যদ্দুর শুনেছি, তার ওপর নির্ভর করে দু’চারটি কথা লিখবার প্রয়াস পেলাম।
আরতি ভৌমিক আদিতে আরতি বালা দাশ ছিলেন। শান্তিরঞ্জন ভৌমিককে বিয়ে করে দাশ থেকে ভৌমিক হয়েছেন আরতি দেবী। অনুমান করি-বিবাহিত জীবনে এই আরতি শান্তিরঞ্জনের কাছে ‘আরু’ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রেমের বিয়ে ছিল দু’জনের। ‘যুক্তিবিদ্যা’ তাঁদের দুজনকে কাছাকাছি হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামের তরুণ-তরুণী দুজনে। কুমিল্লার মোহাম্মদপুর নামের গ্রামে জন্ম শান্তিরঞ্জনের, আর আরতি জন্মেছেন সুরেরবাগ গাঁয়ে। একজন ভৌমিক বাড়িতে, অন্যজন দাশবাড়িতে। যে সময়ের কথা লিখছি সে বড় কঠিন সময়, অন্তত প্রেম করার ক্ষেত্রে। ষাটের দশকের হিন্দুসমাজ, তাও আবার গ্রাম। অজগাঁই বলা যায় সেই সময়ের মোহাম্মদপুর আর সুরেরবাগকে। ওই অপ্রেমসময়ের, বিপ্রতীক স্থানিক প্রেক্ষাপটে দু’জন স্বল্প পরিচিত তরুণ-তরুণীর হৃদয় বিনিময় করা বড় কঠিন ছিল। কিন্তু তারপরও শান্তি আর আরতি হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
আরতি দাশ পড়তেন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে, শান্তিরঞ্জন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। দু’জনেই মানবিক বিভাগে। দু’জনেরই ‘যুক্তিবিদ্যা’ কম্পলসারি সাবজেক্ট ছিল। এই সাবজেক্টটা ভালো বুঝতেন শান্তিরঞ্জন, আরতি দেবী পিছিয়ে ছিলেন। আরতি দেবী খুব যে ঘন ঘন গ্রামের বাড়িতে আসতেন, এমন নয়। একবার কী একটা পার্বণ উপলক্ষে সুরেরবাগে এলেন আরতি। এসে এর ওর কাছে শুনতে পেলেন শান্তিরঞ্জনের যুক্তিবিদ্যার জ্ঞানের কথা। গ্রামে কোনো ছাত্র-ছাত্রীর জ্ঞান বা মেধার কথা খুব গোপন থাকে না। শান্তিরঞ্জনের যুক্তিবিদ্যাবিষয়ক মেধার কথাও হয়তো প্রচারিত হয়েছিল। তাই তো শুনতে পেয়েছিলেন আরতি। আরতি শান্তিকে ডেকে পাঠালেন। যুক্তিবিদ্যা বোঝাতে হবে তাঁকে। হয়তো এটা একটা উপলক্ষ ছিলমাত্র। আসল উদ্দেশ্য ছিল হয়তো শান্তিরঞ্জনকে দু’চোখ ভরে দেখা। পড়ার কথায় সেইসময়ের অভিভাবকরা সাত খুন মাফ করে দিতেন। আরতির এই উদ্যোগকে তাই কেউ বাঁকা চোখে দেখেননি। এর আগে যে দু’জনের চোখাচোখি হয়নি, এমন নয়। একেবারে গায়ে গা লাগানো দুটো গ্রাম। একই রাস্তা দিয়ে শহর থেকে গাঁয়ে ঢুকতে হয়। দেখাদেখি হয়েছিল দু’জনের, বারকয়েক। কিন্তু যুক্তিবিদ্যার দেখাটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আরতির আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারেননি শান্তিরঞ্জন। আরতিকে যুক্তিবিদ্যা বোঝাতে গিয়েছিলেন সুরেরবাগের দাশবাড়িতে। কোনো অর্থমূল্যে গুরুদক্ষিণা চুকাননি আরতি, গোটা হৃদয়টাই দান করে বসেছিলেন শান্তিরঞ্জনকে। শান্তিরঞ্জনও পিছিয়ে থাকেননি। অঞ্জলিভরে আরতির হৃদয়-অর্ঘ্য গ্রহণ করেছিলেন। দুজনের হৃদয় ঘটিত ব্যাপারস্যাপার অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু বিয়েটা স্বচ্ছন্দে হতে পারেনি।
হিন্দুসমাজে আজকের তুলনায় সেইসময়ে আরও বহু বিস্তৃতভাবে এবং বহুস্তরে বর্ণপ্রথা বিন্যস্ত ছিল। ভৌমিকবাড়িটা মাস্টারবাড়ি নামে পরিচিতি ছিল। শান্তিরঞ্জনের বাবা ছাড়াও আরও চার/পাঁচজন শিক্ষক ছিলেন ওই বাড়িতে। একেতো ভৌমিক, তারওপর শিক্ষক, স্বভাবতই এই বাড়ির লোকদের মনে কুলীনতা গাঢ় ছিল। তাই আরতি-শান্তির প্রেমের কথা- অভিভাবক পর্যন্ত যখন বিস্তৃত হলো, বেঁকে বসলেন শান্তিরঞ্জনের পিতা ইন্দুভূষণ ভৌমিক। মা প্রভাবতী ছেলের পক্ষে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু রাশভারী ইন্দুভূষণের গাম্ভীর্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন শান্তিরঞ্জনের মা। তারপর সময় গেল, জল অনেক ঘোলা হলো। বহু ঝড়-ঝাঞ্ঝার পর দু’জনের বিয়ে হলো। তাও মা-বাবার পূর্ণসমর্থন ব্যতিরেকে। কিন্তু আরতি দেবী তো ভৌমিকবাড়িতে শুধু বিয়ে করতে আসেননি, জয় করতেও এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করতে পেরেছিলেন আরতি দেবী।
শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০০২-এর প্রথম দিকে। তখন তিনি চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। আমি ওই কলেজে দ্বিতীয়বার এলাম কুমিল্লার হাসানপুর সরকারি কলেজ থেকে। বিভাগে তখন বৈরি হাওয়া। বিভাগীয় প্রধান ড. দিল আফরোজ বেগম। বি-স্বামীক তখন তিনি। মেজাজ রুক্ষ, রূঢ়ভাষী, পিএইচডির অহংকারে দিশেহারা। শান্তিরঞ্জনকে মানুষ বলেও মনে করেন না তিনি। শেষ জীবনে চাকরি করতে এসে বড় অসহায়বোধ করছিলেন তখন শান্তিরঞ্জন। তিনি আমাকে আঁকড়ে ধরলেন, আমিও তাঁকে। অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক আমার কাছে শান্তিদা হয়ে গেলেন।
    অল্পসময়ের মধ্যে বুঝতে পারলাম, শান্তিদার গভীর পড়াশোনা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্বচ্ছ। ধর্ম মানেন তিনি, তবে গোঁড়া নন। অধিকাংশ সময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। সেই ভাষাতে সারল্য-সহজতা। আরও ঘনিষ্ঠ হলাম আমরা। পরিবার-পরিজনের সুলুকসন্ধান করলাম পরস্পরে। তখনই জানতে পারলাম-কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়ায় দ্বিতলবাড়ি তাঁর। বাড়ির আশপাশে আম-কাঁঠাল-জাম-নারকেলের গাছ।
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বউদি? বউদির কথা বলুন। ছেলে মেয়ে?’
ভীষণ রসিক তিনি। বাইরের গাম্ভীর্য দিয়ে ভেতরের রসময়তাকে ঢেকে রাখেন। মাঝে মাঝে উৎসারিত হয় সেই হিউমার। সেদিনও রসিকতার দরজা খুলেছিলেন শান্তিদা।
মিষ্টি একটু হেসে বলেছিলেন, ‘বউ আছে একখান। তবে পোলাপান দুইখানা। মাইয়াডা প্রাইভেট কলেজে অধ্যাপনা করে, ছাওয়ালডা ভিক্টোরিয়ার ছাত্র।’
ওই ‘একখান বউ’কে দেখার খুউব ইচ্ছে হলো আমার। মনের কথা জানালামও তাঁকে একদিন। শুনে স্বভাবসুলভ মিষ্টি একটু হাসলেন শান্তিদা।
সপ্তাহান্তে বাড়িতে যেতেন শান্তিদা। এক শনিবার ফিরে বললেন, ‘আগামী সপ্তাহে কলেজ বন্ধ হইয়া যাইতাছে। আপনারে পোলা মাইয়া লইয়া আমার বাড়িতে যাইতে হবে। ও হ্যাঁ, বউরে বাদ দিয়েন না।’
গেছিলাম আমি সেই বন্ধে, কুমিল্লায়, সঙ্গে পরিবার পরিজন। স্ত্রী ছিল, কন্যা ছিল, পুত্রও ছিল। কন্যা মাটি তখন নাইনে, প্রত্যুষ ফোর কী ফাইভে। রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শান্তিদা। এর আগে যে কুমিল্লায় যাইনি, তা নয়। বহুবার গেছি। বছরে অন্তত একবার গেছি, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে, উচ্চ মাধ্যমিকের উত্তরপত্র আনতে। কোনোবারেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম না। কিন্তু সেবার, যেবার সপরিবারে শান্তিদার বাড়িতে যাচ্ছি, বড়ই দ্বিধান্বিত ছিলাম আমরা। আমরা মানে আমি আর আমার স্ত্রী সুনীতা। বগিতে সে বারবার বলছিল, ‘এভাবে হুটহাট করে কুমিল্লা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে?’
আমি বলেছিলাম, ‘এত অস্থির হচ্ছো কেন? অল্পদিন হলেও শান্তিদাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।’
স্ত্রী বলেছিল, ‘আমি দাদার কথা বলছি না, বলছি বউদির কথা। জানা নেই শোনা নেই, আত্মীয় নন, স্বজন নন, একবার বললেন বলেই দাদার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলে।’
মনটাকে আরও সংকুচিত করে সুনীতা আরও বলল, ‘দাদাকে না হয় চেন, কিন্তু বউদিকে তো চেন না। এই যে এতগুলো মানুষ আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হচ্ছি, কী ভাববেন ভদ্রমহিলা একবার ভেবে দেখেছ কি?’
সুনীতার কথা শুনে আমি একেবারে চুপসে গেলাম। তাই তো! শান্তিদা যেমন উদার সহজ, মিষ্টভাষী, বউদি যে তেমন হবেন, তার তো কোনো গেরান্টি নেই। সব স্ত্রীই যে স্বামীসিদ্ধান্তের অনুরাগী, তাও তো নয়। সুনীতার কথা ঠিকই তো, বউদি যদি অন্যরকম হন, তাহলে তো মহা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবো আমি। স্ত্রী না হয় বুঝবে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটো, একটু আধটু ওদেরও তো বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। বউদির অবহেলাটা তো ওরা সহজেই বুঝে ফেলবে।
ভাবতে ভাবতে বিপন্ন-বিষণœ হতে থাকলাম। স্ত্রী বুঝতে পেরে সাহস দিয়ে বলল, ‘অত ভাবছ কেন তুমি? কোনো সমস্যা হলে ফেরার বাস তো আছেই।’
স্টেশন এসে গেছিল। প্লাটফরমে তাকিয়ে দেখেছি-শান্তিদা দাঁড়িয়ে। বগি থেকে নামার পর দাদা বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরলেন। স্ত্রী প্রণাম করল। সুনীতার এই প্রথম শান্তিদাকে দেখা।
    ঘন্টাখানেকের মধ্যে আশালয়ে যখন উপস্থিত হলাম, আমাদের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে গেল। হ্যাঁ, শান্তিদার বাড়ির নাম আশালয়। আরতির ‘আ’, শান্তির ‘শা’। বড় তৃপ্তি লাগল বাড়ির নামটি দেখে। শান্তিদা স্ত্রীকে যথার্থ মর্যাদা দিতে জানেন।
উঠানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখলাম, মূল দরজায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে ইনিই শান্তিদার স্ত্রী আরতি।
কপালজুড়ে সিঁদুরের ফোঁটা, লালপাড়ের শাড়ি পরনে, হাতে শাখা। উচ্চতা পাঁচফুট দুই কী তিন। কালোবরণ। ৫৬/৫৭-র দিকে বয়স। স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। রিটায়ারমেন্টে আসবেন-এরকম অবস্থা। দাদার সমবয়সী তিনি। শান্তিদারও রিটায়ারমেন্টের বয়স ঘনিয়ে এসেছে। কালোবরণের আপাত নিস্পৃহ এই মহিলাটির ভেতর থেকে এক ময়াময় জ্যোতি বেরিয়ে এলো। দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। সুনীতাকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন বহুবছর অদেখা ছোট বোনটি বড়দির বাড়িতে ‘নাইর’ এসেছে। বাচ্চা দুটোকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আসেন, উপরে আসেন।’
পরে, রাতের দিকে সুনীতাকে বলেছি, ‘কী, দ্বিধা কেটে গেছে তো? সব আত্মীয় আত্মীয় নয়, আর অনাত্মীয়ের মধ্যেও পরম আত্মীয় থাকেন। বউদি সেরকম নন কি? তোমার গোটা দিনের অভিজ্ঞতা কী বলে?’
সুনীতা মিষ্টি হেসে চুপ করে থাকে।
দিনতিনেক বোধহয় থেকেছিলাম সেবার। আরতি বউদি মুহূর্তে মুহূর্তে প্রমাণ দিয়েছিলেন আমরা তাঁর নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ নই। কত কিছু যে রেঁধে খাইয়েছিলেন বউদি আমাদের। কাতলা মাছের কালিয়া, পুর ঢোকানো পটলভাজি, বেগুনভাজি, বিশেষ পদ্ধতিতে রাঁধা কইমাছ-এসব। ছেলে আমার মাংসাষী। অতি যতেœ ছেলের জন্য খাসির মাংস রান্না করে দিয়েছেন। তাঁর দু’দুটো ছেলেমেয়ে তখন ঘরে। আমার ছেলেমেয়েকে পেয়ে নিজসন্তান তপু আর অনীকের কথা ভুলে গিয়েছিলেন আরতি বউদি। আজ বহু বছর বিগত হয়ে গেছে। ফিরবার সময় আমার স্ত্রী যে কথাটি বলেছিল, সেটি এখনো আমার মনে জ্বল জ্বল করছে। সুনীতা বলেছিল, ‘যেন আপন দিদির বাড়িতে বেরিয়ে গেলাম।’
এরপর বহুবার এসেছি কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়, আশালয়ে। দাদা রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন। চোখের আড়াল হয়েছেন, কিন্তু মনের আড়াল হন নি শান্তিদা। খুব যে কার্যকারণে তাঁর বাড়িতে গেছি, এমন নয়। অকারণেও গেছি। সামাজিক মানুষ আমরা। জীবনে কত রকমের ঝড়-ঝঞ্ঝা যে আসে। বিপন্নতায় জীবন যখন জড়সড়, একটু সাহসের জন্য, একটু ভালোবাসার জন্য বরাবর ছুটে গেছি আশালয়ে। আপন ভাইয়ের মতো বুকের কাছে টেনে নিয়েছেন শান্তিদা। পথ চলার স্পৃহা তৈরি করে দিয়েছেন আমার মধ্যে। অনেকগুলো রাত আমরা আলাপে কাটিয়েছি। ভাত খাওয়ার সময় ভুলেছি দু’জনে। আরতি বউদি কিন্তু চায়ের সময় চা, জলখাবারের সময় জলখাবার জুগিয়ে গেছেন। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে চোখ কুঁচকাতে দেখিনি আমি। বরং উল্টো উৎকন্ঠিত হয়েছেন তিনি। শান্তিদা সাহিত্যিক মানুষ, আমি সাহিত্যনুরাগী। দু’জনে আলাপে বসলে সময়জ্ঞান থাকত না আমাদের। রাত গভীর থেকে গভীরতর হতো। নিজ কক্ষে কখনো, কখনো আমাদের আলাপের কক্ষে ঝিমাতেন বউদি। দাদার সেদিকে খেয়াল নেই। সাহিত্যের জটিল কোনো তত্ত্ব নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। ওই সময় কথার ফাঁকে আরতি বউদি বলে উঠতেন, ‘শুধু সাহিত্য খাইলে চইলবে, ভাত খেতে হইবে না?’ তারপর আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলতেন, ‘দেখছ না শংকরদার মুখটা খিদেয় কীরকম শুকিয়ে গেছে?’
শান্তিদা সংবিতে ফিরতেন, আমি হা হা হাসিতে ফেটে পড়তাম।
আজকালকার স্বামীস্ত্রীদের ভালোবাসাবাসি দেখে লজ্জা পাই। কী রকম গা ঘেঁষাঘেঁষি, কী রকম লেপ্টালেপ্টি। হাজার বার ‘আই লাভ ইউ’। অধুনাকালের স্বামীস্ত্রীদের ধারণা, বস্তুগত প্রমাণ ছাড়া বুঝি ভালোবাসাবাসি হয় না। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা কারে কয়, তা শান্তিদা আর আরতি বউদিকে দেখে আমি বুঝেছি। তাঁদের ভালোবাসার মধ্যে একটা প্রবল অন্তর¯্রােত ছিল। যার জলে দু’জনে ¯œাত হতেন। তেমন লোক-দেখানো ভালোবাসা প্রকাশ করতেন না আরতি বউদি শান্তিদার প্রতি। কিন্তু তাঁর প্রাণের ভেতরে স্বামীর জন্য প্রেমের একতারা যে অবিরাম বেজে যেতো, তা বুঝতে পারতাম আমি। তাঁর এই নীরব অথচ হীরণময় ভালোবাসা দেখে আমি অবাক হতাম এই ভেবে যে কোনো কথা না বলেও প্রেমের অনেক কথা বলা যায়। বলে গেছেন আরতি বউদি।
শান্তিদার সঙ্গে ঘর করতে এসে আরতি বউদি কী পেয়েছেন, কতটুকু পেয়েছেন, তার হিসেব নিকেশ করা আমার সাজেনা। কারণ তাঁদের দাম্পত্যজীবনের সবটুকু জানি না। তবে এইটুকু বলতে পারি, শান্তিদার বাড়িতে বউদি নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। সেই জগৎটা ছিল বউদির একান্ত নিজস্ব। ধর্মানুরাগী ছিলেন আরতি দেবী। পারিবারিকভাবেই তাঁরা রামকৃষ্ণভক্ত। ঘরের মধ্যেই ছোট্ট একখানা মন্দির। সেখানে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ছবি। ভোর সকালে শয্যাত্যাগ করতেন বউদি। ¯œানাদি সেরে মন্দিরে ঢুকতেন। প্রার্থনা সারতেন। সেই প্রার্থনায় কোনো ভড়ং ছিল না। স্বল্পভাষী এই নারীটি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতেন নীরবে। মন্দির থেকে বেরিয়ে নিত্যদিনের সাংসারিক কাজে নিজেকে সঁপে দিতেন তিনি। তেমন করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখিনি কখনো আরতি বউদিকে। তবে কন্যা তপুর বিয়ে নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। মনোমতো বরের সন্ধান পাচ্ছিলেন না শান্তিদা। আমি চট্টগ্রামের এক বিয়ে প্রত্যাশীবরের সন্ধান দিলাম। ছেলেটা ভালো। এই ভালোত্বের দাম চুকাতে গিয়ে ছেলেটার জীবনে একটা মিসহ্যাপেনিং হয়েছিল ওটা নিয়ে বউদি উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিয়েতে তেমন করে মত দিতে পারছিলেন না। শান্তিদার অটল সিদ্ধান্তের কারণে রাজীবের সঙ্গে তপুর বিয়েটা হয়েছিল। তপুরা এখন সসন্তান কানাডায়। এই বিয়েতে শান্তিদা জিতে গিয়েছিলেন। হেরেছিলেন আরতি বউদি। কিন্তু হারটা যে সুখের, সেটা বউদির মুখ দেখে বুঝাতে পারতাম আমি। দেবরদের সঙ্গে বউদির সম্পর্কের ঘাটতি দেখিনি কখনো। শান্তিদার বেশ ক’জন ভাই। তিনি জ্যেষ্ঠ। সে হিসেবে আরতি দেবী বড় বউদি। দেবরদের কাছে এই বউদি বড়দি হয়ে গিয়েছিলেন। পারিবারিক জীবনের জটিলতায় দেবর-ননদের সঙ্গে বউদিদের সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়। কখনো কখনো তিক্ততায় ভরে ওঠে সেই সম্পর্ক। আরতি বউদির ক্ষেত্রে তা হতে দেখেনি। যখনই যে দেবর আশালয়ে এসেছে, সাদরে গ্রহণ করেছেন তাদের বউদি। ছোটভাইদের সন্তানরা যেন তাঁরই পুত্রকন্যা। নিজের সন্তানকে একজন মা যেভাবে বাৎসল্যে ডুবিয়ে রাখে, আরতি বউদিও দেবরপুত্রদের সেভাবে ডুবিয়ে রাখতে দেখেছি। তাঁর তো দেবরের দুইপুত্র আশালয়ে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছে।
তবে এটা নয় যে, কঠোরতার সময় তিনি নির্মোহ-নিস্পৃহ হননি। বউদিকে কোনোদিন রাগতে দেখিনি আমি, দেখিনি উচ্চেঃস্বরে কথা বলতে। তাঁর ভেতরের যত ক্রোধ-অসহায়তা নীরবে প্রকাশ করতেন তিনি। সংসারের নীতিনির্ধারণী কোনো ব্যাপারে বউদি যখন শান্তিদার সঙ্গে যুক্তিতে পেরে উঠতেন না, একেবারেই মূক হয়ে যেতেন। কোনো উচ্চবাচ্য করতেন না। নিঃশব্দে সেই ব্যাপারটির পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতেন। সবসময় যে শান্তিদা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন, এমন নয়। বউদি চেষ্টা করতেন বোঝাতে। বোঝাতে ব্যর্থ হলে চুপ মেরে যেতেন। পারিবারিক এরকম একটা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বউদির মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেননি শান্তিদা। কাজটা সম্পন্ন করেছেন। বউদি কোনো হইচই করেননি এ নিয়ে। বিষন্ন চোখে দেখে গেছেন। দাদা ওরকম সিদ্ধান্তের ফলে সংসারের জটিলতা বেড়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে শান্তিদাকে দোষারোপ করতে দেখিনি বউদিকে। নিজের বুকের তলায় সেই অপ্রাপ্তির হাহাকারকে চেপে রেখেছেন। একজন সাধারণ নারীর পক্ষে এটা সম্ভব নয়, আরতি বউদি অসাধারণ ছিলেন বলে ব্যথার ঝড়কে শান্তিদাকে বুঝতে দেননি।
আরতি বউদির মাতৃরূপ দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। আমার মেয়ে মাটির বিয়ের কথা যখন চূড়ান্ত, তখন বরের পিতা মৃদুলকান্তি দে বেঁকে বসলেন। বিয়েটা চট্টগ্রামে হবে না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ ভদ্রলোক কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘বিয়েটা চট্টগ্রামের বাইরের কোথাও থেকে দিলে আমি রাজি।’
কারণ কী? কারণটা পরিষ্কার। মৃদুল দে উঁচু জাতের হিন্দু, অন্তত তিনি মনে করতেন। আর আমি জেলে- ছোট জাত। ছোটজাতের সঙ্গে উঁচুজাতের ছেলের বিয়ে হয় কী করে। তাও আবার স্বস্থানে। নেহাত ছেলেটা প্রেম করেছে বলে মৃদুল আর তাঁর স্ত্রী বিয়েটা করাতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু নিজজেলায় বিয়ের আয়োজন করে জাত খোয়াতে রাজি নন ওই দে-দম্পতি। শান্তিদার শরণাপন্ন হলাম। সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন দাদা। বললেন, ‘মাটির বিয়া হইব এই কুমিল্লা শহরে’।
হয়েছিলও তা-ই। দাদা মাটির পিতা হয়ে গিয়েছিলেন। বউদি হয়েছিলেন মা। সামান্য কয়েকটা টাকা শান্তিদার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে চট্টগ্রামে বসে ছিলাম আমি। দাদা বিয়ের ভেনু থেকে শুরু করে অতিথিবৃন্দের খাবারদাবারের সকল আয়োজন নিষ্পন্ন করেছেন। আমার কোনো বড়দাদা নেই। ওই সময় ভেবেছি-শান্তিদাদার মতো আমার যদি একজন বডদা থাকতেন জীবনের চিত্রই পাল্টে যেত আমার।
তো ওই বিয়েতে আমার পরিবার-পরিজনসহ অতিথির মতো করে মাটির বিয়েতে অংশগ্রহণ করেছি। আমাকে কোনোরূপ দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। নারী-আচারগুলো সম্পন্ন করার ব্যাপারে কোনো কিছুই করতে হয়নি আমার স্ত্রীকে। সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আরতি বউদি। মা হয়ে, জেঠি হয়ে, পিসি হয়ে, দিদামা হয়ে আরতি দাশ নামের ওই রমণীয় মহিলাটি সকল দিক সামলেছেন। আমাদের গোটা পরিবার শান্তিদা আর আরতি বউদির নিকট সারাজীবনের জন্য ঋণী হয়ে আছি।
ছোট্ট দু’চার টুকরার কাগজের মধ্যে একজন মানুষের গোটাজীবনকে ধারণ করা সম্ভব নয়। তা-ও আবার স্বল্পজানা মহিলার। আরতি বউদি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে আমার যা মনে হয়েছে, লিখে গেলাম। এ আমার একেবারে নিজস্ব ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
১৯৭০-এ বিয়ে করেছিলেন এই দম্পতি। সুখে-দুঃখে ৪০ বছর ৭ মাস ১১ দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। এত দীর্ঘদিন একসঙ্গে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করা কম কথা নয়। ওঁরা পেরেছিলেন। আমরা পুরুষেরা স্ত্রীদের খুব যে মর্যাদা দিই, এমন নয়। বন্ধুও ভাবিনা তাদের তেমন করে। সংসারের ঝুটঝামেলায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে স্ত্রী বলে যে একজন সংসারে আছে, তাও ভুলে যাই। স্ত্রী পুরুষদের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যখন সন্তানরা যার যার কর্মব্যপদেশে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র জীবন যাপন শুরু করে। ওই নিঃসঙ্গ সময়ে স্ত্রীই পরম বন্ধু হয়ে ওঠে। তখন স্ত্রী সঙ্গ বড় মধুময় লাগে, স্ত্রীসান্নিধ্যকে হিরণ¥য় বলে মনে হয়। শান্তিদার এই হিরণ¥য় সময়টা উপভোগের সময় আরতি বউদি তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। যিনি গেছেন তাঁর কথা বলতে পারব না, কিন্তু শান্তিদার যে কী কষ্ট সে আমি অনুধাবন করতে পারি।
আরতি বউদিকে প্রণাম জানাচ্ছি।