এইচ টি ইমাম: দৃঢ় ও দূরদর্শী এক কর্মবীর
Published : Saturday, 6 March, 2021 at 12:00 AM
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ ।।
মৃত্যু অনিবার্য; তার পরও মৃত্যু মানেই অত্যন্ত বেদনা ও শোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমামের মৃত্যুও আমাদের কাছে এই প্রোপটে অত্যন্ত গভীর মনোবেদনার। এইচ টি ইমাম নামে অধিক পরিচিত দেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব ৮২ বছর বয়সে বুধবার রাতে পাড়ি জমালেন পরপারে।
এইচ টি ইমামের সঙ্গে আমার অনেক কর্মস্মৃতি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বের শুরুতেই তার সঙ্গে আমার সাাৎ। পাকিস্তান আমলে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান ক্যাডারের সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশের প্রথম সরকার 'মুজিবনগর সরকার' নামেই অধিক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ পর্বের শুরুতেই তিনি পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের পে আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং ওই সরকারে যোগ দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। আমি ছিলাম তখন ইপিএস। সিরাজগঞ্জে এসডিও হিসেবে কর্মরত। একাত্তরে বাংলাদেশ সরকারে যোগ দিই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে। কাজের সূত্রে তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যাকা-ের ক'দিন পর খন্দকার মোশতাক সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। তার ওপর চলে নিপীড়ন-নির্যাতন। এর পরও তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-আনুগত্যে তিনি ছিলেন অবিচল। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল এইচ টি ইমামের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের দ্যুতি ছিল অত্যন্ত প্রখর।
সব েেত্রই এইচ টি ইমাম রেখে গেছেন দতা-বিচণতা ও দূরদর্শিতার ছাপ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অনেক সভায় তিনি উপস্থিত থেকে ঘাতক-দালালদের বিচারের ব্যাপারে তার সহযোগিতা ও একনিষ্ঠতার কথা প্রকাশ করেছেন। আমি ওই সভাগুলোতে তার উচ্চকণ্ঠ শুনেছি। তিনি যেমন ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী, তেমনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মসূচি সামনে নিয়ে যাওয়ার েেত্রও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তার রচিত 'বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১' গ্রন্থে ১৯৭১ সালে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন, তার সদস্যবৃন্দ, মন্ত্রণালয়, প্রশাসন বিভাগ ইত্যাদি অংশ ও তাদের সাফল্যের বিষয় তুলে ধরেছেন। ওই গ্রন্থে তার স্মৃতিচারণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পর্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা ও দলিলপত্র সংযুক্তকরণের ফলে বইটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে বিবেচিত।
বাবার চাকরিসূত্রে এইচ টি ইমামের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জেলায়। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতিতে নেন এমএ ডিগ্রি। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। তখন তিনি বাম ছাত্র সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। শিাজীবন শেষে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে রাজশাহী সরকারি কলেজে যোগ দেন। এরপর পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিস পরীায় অংশ নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব তিনি। সাভারে অবস্থিত লোকপ্রশাসন প্রশিণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। অবসর নেওয়ার পর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রথমে জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। দলের নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। শেখ হাসিনা এ কমিটির চেয়ারম্যান আর তিনি ছিলেন কো-চেয়ারম্যান। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন েেত্র তার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালনে ছিলেন একান্ত ব্রতী। এই কর্মবীরের নানা েেত্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান তাকে অনন্য স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাজের জন্যই তাকে আমাদের হৃদয়ে লালন করব।
এইচ টি ইমাম একদিকে ছিলেন দৃঢ়চেতা, অন্যদিকে দ্রুত যে কোনো সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতেও পারঙ্গম। একাত্তরে আমি তার এসব বিষয় যেমন নিবিড় পর্যবেণের সুযোগ পাই, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও নানান প্রোপটে তা অবলোকনের সুযোগ পাই। অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশ ও কর্মেেত্র এর প্রয়োগ ঘটাতে পারেন না। এইচ টি ইমাম ছিলেন এর ব্যতিক্রম। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে নিবিড় সম্পৃক্ততার কারণে এবং গুরুদায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে বিগত এক দশকে রাজনৈতিক েেত্র তার প্রজ্ঞার যে প্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন, তার অনেক ইতিবাচকতাও আমাদের সামনে স্পষ্ট। এ জন্য তিনি লোকচুর অন্তরালে থেকেও অনেক েেত্র হয়ে থাকবেন অনুসরণীয়। মতার ওজন অনেকেই বইতে পারেন না। কিন্তু এইচ টি ইমাম এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছিলেন নিজেকে। তিনি শুধু কাজের কাজগুলোই করে গেছেন।
একজন মানুষ তার কর্মের কারণেই সমাজে নানাভাবে মূল্যায়িত হন। দেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে আমরা এইচ টি ইমামের প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়েছি। তিনি কথা বলতেন যেমন হিসাব করে, তেমনি কাজ করতেন আরও বেশি সতর্ক ও সজাগ থেকে। কখনও কখনও তার কোনো কোনো বক্তব্য নিয়ে কেউ কেউ ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রয়াস চালালেও তার কোনো কাজে যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ুণ্ণ¤œ না হয়, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সতর্ক। আজ তিনি আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই বটে, কিন্তু তার কাজই তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে বারবার। এমন কর্মবীরদের মৃত্যু হয় না। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
একাত্তরে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা