এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
দিগন্ত
বিস্তারী সবুজ ফসলের মাঠ, তার বুকজুড়ে হলুদে রাঙানো। এ যেন মাটির বুকে
সূর্যের হাসি। কুমিল্লার দেবীদ্বার পৌর এলাকার গুনাইঘর গ্রামের নন্দীবাড়ির
পূর্বপাশে ফসলের মাঠের দৃশ্য এখন এ রকম। দেবীদ্বার সদর থেকে প্রায় দেড়
কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে শাক-সবজির সবুজ মাঠে হলুদরাঙা ‘সূর্যমুখী’
চাষ করা জমিকে ঘিরে এমন দৃশ্য। প্রতিদিন আশপাশ এলাকার নানা বয়সের মানুষ
ছুটে আসছেন এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে।
পরিবার-পরিজন, প্রেমিক যুগল,
বন্ধু-বান্ধব, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষের পদভারে এই এলাকা এখন
সবার পরিচিত। ছুটির দিন বা কাজের ফাঁকে এক নজর সূর্যমুখির হাসি দেখতে এসে
মনোরম পরিবেশের সাথে নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত হাজারো মানুষ। সেলফি
তোলার কিকের শব্দ আর মোবাইল ভিডিওর ফাশের ঝিলিকে চমকিত হচ্ছে হলদে মাঠ।
সপরিবারে
আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দর্শনার্থী বললেন, ‘আমাদের এ প্রজন্মের
শিশু-কিশোরই শুধু নয়, সব বয়সের লোকজনের বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। এই মৌসুমে
সূর্যমুখী ফসলের জমিকে ঘিরে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বিনোদনের কিছুটা ঘাটতি
পূরণ হচ্ছে। এখানে এসে সূর্যের হাসিখ্যাত সূর্যমুখীই নয়, নানা জাতের সবজি ও
ফসলের সাথে নতুন প্রজন্মের পরিচিতি হওয়ার সুযোগটাও যুক্ত হয়েছে।
এখানে
হলুদ মাঠের চারপাশে সবুজ সবজির ছড়াছড়ি। আছে বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি,
শালগম, টমেটো, লালশাক, কাঁচামরিচ, ভুট্টা, কাওন, ধুন্দল, জব (ববি বার্লি),
গম, গোল আলু, মিষ্টি আলু, লাউ, কুমড়া, শসা, ডাটা, উস্তা, করল্লা, ভেন্ডি
(ঢেরস)সহ নানা জাতের সবজির সমাহার।
সূর্যমুখী ক্ষেতের পাশেই দেখা হয়
মাঝবয়সী আবু তাহেরের সঙ্গে। তিনিই সবুজের বুকে হলুদে হাসি ফোটানোর কারিগর।
জানা যায়, এ গ্রামেই তার বসবাস। পিতা মৃত আব্দুল জলিলও কৃষক ছিলেন। সকাল
থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি পাহারায় থাকেন আবু তাহের। দিনভর পাহারায় থাকলেও
আনন্দও লাগে। কারণ, তার এ সূর্যমুখী ক্ষেত দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে
পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবসহ নানা বয়সী, নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ ভিড়
করছেন প্রতিদিন। এ ক্ষেতের কারণে গ্রামটিও অনেকের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।
শুধু তাই নয়, দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ এলাকায় অসংখ্য চটপটি,
বাদাম, চাসহ নানা পদেও খাবারের পসরা নিয়ে হকাররা বসেন। তাদেরও আয়ের একটি
উৎস তৈরি হয়েছে। রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের বহরও থাকে বিশাল।
আবু
তাহের বলেন, ‘নিজের সামান্য জমি থাকলেও তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়।
তাই তাকে বন্ধকি এবং পত্তনি জমির ওপর নির্ভর করতে হয়। এবার উপজেলা কৃষি
বিভাগ ‘সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই কুমিল্লার তত্ত্বাবধানে এক একর জমিতে
সূর্যমুখী চাষের পরিকল্পনা নেয়। তাই আমি আমার জমির সাথে আরো ৪৫ শতাংশ জমি
২০ হাজার টাকায় পত্তনি রাখি। কৃষি বিভাগ আমাকে বীজ, সার, কীটনাশক, ওষুধ এবং
পরামর্শ দিয়ে পরীক্ষামূলক জাত ‘বারি সূর্যমুখী-৩’ এর ব্লক প্রদর্শনীর
আয়োজন করে। জমি ও শ্রম আমার, উৎপাদিত ফসলও আমার; বাকি সব দেখভাল ও খরচ
তাদের। আবু তাহের এতে দারুণ খুশি।
তবে তার একটি চিন্তার বিষয় হলোÑ
ক্ষেতের অন্যান্য ফসল নগদ বিক্রি করা যায়, বাজারজাত করার আগে জমি থেকেই
ব্যবসায়ীরা ফসল কিনে নেয়। সূর্যমুখী এ এলাকায় উৎপাদন কম হয়; কৃষকের মধ্যে
এখনো আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। তাই উৎপাদিত সূর্যমুখীর তেলবীজ সংগ্রহে কৃষি
বিভাগকে সহযোগিতা করতে হবে। আবু তাহের বলেন, ‘ফসল ওঠার পর প্রক্রিয়াকরণের
ধরন এবং লাভের হিসেব থেকেই চিন্তা করবো, আগামীতে সূর্যমুখী চাষ করবো কি
না।’
দেবীদ্বারের এই মাঠে আবু তাহের সূর্যমুখীর আবাদ শুরু করেন গত ৬ ডিসেম্বও আর ফসল ঘওে তোলার আশা করছেন চলতি মার্চ মাসের শেষ দিকে।
দেবিদ্বার
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইদুজ্জামন বললেন, পরীক্ষামূলক ‘সরেজমিন গবেষণা
বিভাগ, বিএআরআই কুমিল্লার তত্ত্বাবধানে দেবীদ্বারের গুনাইঘর গ্রামে
‘সূর্যমুখীর ব্লক প্রদর্শনী করা হয়েছে। এর বিস্তার ও উপযোগিতা বৃদ্ধিতে কাজ
করছে কৃষি বিভাগ। ভোজ্যতেল সয়াবিন নানা প্রক্রিয়ার কারণে অস্বাস্থ্যকর হয়ে
পড়ছে। সূর্যমুখী ভোজ্যতেল হিসেবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অবশ্য
সূর্যমুখী তেলবীজ পিষে তেল বের করার কারখানা নোয়াখালীতে আছে। আমাদের
এখানকার সূর্যমুখীর বীজ নোয়াখালীতে পাঠিয়ে ওখান থেকে পিষে তেল বের করে আনতে
হবে।
তিনি আরো জানান, সূর্যমুখী চাষের জমি সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখতে
হবে। কারণ, শুরুতে এবং ফলনের সময় পাখী খেয়ে ফেলে আর ফুলের পাপড়ি গজানোর পর
উৎসাহী লোকজন ফুল হিসেবে ছিড়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য
রক্ষায় সূর্যমুখী আবাদে কৃষকদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’