লেখালেখির গল্প শোনালেন ইমদাদুল হক মিলন
জহির শান্ত ।।
সম্প্রতি
কুমিল্লায় এসেছিলেন দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার
ইমদাদুল হক মিলন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার
গ-াপুরে ‘শহীদুল আলম পাটোয়ারী গণপাঠাগার’ উদ্বোধন করতেই তাঁর কুমিল্লা সফর।
এমন অজপাড়াগাঁয়ে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাঁকে একদিকে যেমন আশ্চর্য
করেছে; তেমনি আশা জাগিয়েছে আলোকিত-সুন্দর ভবিষ্যতের। সে অনুষ্ঠানেই মিলন
শোনালেন তার লাইব্রেরী প্রেমের কথা, শোনালেন লেখক হয়ে উঠার প্রথম দিকের
গল্প। বসন্তের এক বিকেলে গাছগাছালি ঘেরা গ্রামীণ উঠোনে গ-গ্রাম ও আশপাশের
এলাকার শ’ তিনেক নারী-পুরুষ চেয়ার পেতে নিবিশষ্ট মনে শুনেছেন এ মানুষটি
বরেণ্য লেখক হয়ে উঠার গল্প, আগামীর চিন্তাভাবনা এবং মানুষ হিসেবে আমাদের
করণীয় বিষয়ক পরামর্শ।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ১৯৫৫ সালের ৮
সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীম-ল গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার
পৈতৃক নিবাস মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুরের লৌহজং থানার পয়সা গ্রামে। ইমদাদুল হক
মিলন লেখক হিসেবে এপার-ওপার দুই বাংলায়ই তুমুল জনপ্রিয়। তার প্রকাশিত
গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২ শত। এর মধ্যে দুই বাংলায়ই তার ‘নূরজাহান’
উপন্যাসটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠের
সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। সে সুবাধেই নাঙ্গলকোটের অজপাড়াগাঁয় আসা
লাইব্রেরী উদ্বোধন করতে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতাকে
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, লেখালেখি এবং পত্রিকায় সংশ্লিষ্টতার
কারণে প্রায়ই আমাকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়। কিন্তু গত ৫/৭ বছরে আমি
কোনো লাইব্রেরীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছি কি না; তা মনে পড়ছে না।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের অজপাড়াগাঁয়ে এমন একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা সত্যিই
প্রশংসার দাবি রাখে। মানুষ আজকাল আর পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। আমাদের
চারপাশে বড় বড় ইমারত হচ্ছে; আমরা উঁচুতেই উঠছি, কিন্তু আমাদের পায়ের নিচের
মাটি সরে যাচ্ছে। আমাদের অঙিনা-মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে, পুকুর হারিয়ে যাচ্ছে,
লাইব্রেরিও হারিয়ে যাচ্ছে। আমি আশা করি এই লাইব্রেরীটি এলাকার মানুষকে
আলোকিত করবে এবং এখান থেকে আলোকিত মানুষ গড়ে উঠবে। এই লাইব্রেরীটির কারণে
যদি একজন ভালো মানুষ গড়ে ওঠে, তবেই তা স্বার্থকতা পাবে।
নিজের লেখক হয়ে
উঠার পেছনে একটি লাইব্রেরীর অবদানের কথা তুলে ধরে ইমদাদুল হক মিলন বলেন,
আমরা ১০ ভাই-বোন ছিলাম। ছেলে বেলায় আমার বাবা চলে আসেন ঢাকা শহরে। আমার
নানা বাড়ি মেদেনিম-ল নামের একটি গ্রাম। পদ্মা সেতু যেখানে হচ্ছে- মাওয়া;
তার ঠিক আগের গ্রামটিই মেদেনিম-ল। ওখানটাতেই আমি জন্মেছি। সেই মেদেনিম-ল
গ্রামটি আমার লেখালেখিতে বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে। আমার নানাবাড়ির আলমারীতে
অনেক ধরনের/ অনেক লেখকের বই ছিলো। এবং আমার নানী শীতকালে মাঝে মাঝে
বইগুলিকে রোদে দিতেন। আপনারা জানেন, রোদে দিলে বই থেকে একটা অদ্ভুদ গন্ধ
আসে! আমার সেই ছেলেবেলাতেই এমন গন্ধ শোঁকে মনে হতো- আমি যদি এমন একটি বই
লিখতে পারি- বহুদিন ধরে সেই বইটির গন্ধ মানুষের মনের মধ্যে বিচরণ করবে! এটা
ছেলেবেলার কথা। তারপর জীবন শুরু হলো ঢাকায়। পুরান ঢাকায় গে-ারিয়া নামক
একটি জায়গা আছে। এই এলাকায় ধুপখোলা মাঠ নামক একটি খেলার মাঠ আছে। সে মাঠে
১০/১২টি টিম একসাথে ফুটবল খেলতে পারতো। এখন সে মাঠ সংকুচিত হতে হতে একেবারে
ছোট হয়ে গেছে। এখন তো আমার জীবন থেকেই মাঠগুলো উধাও হয়ে গেছে, পুকুরগুলো
উধাও হয়ে গেছে। আমাদের জীবন খুব সংকুচিত হয়ে গেছে। তখন গে-ারিয়ার ওই মাঠে
নানারকম খেলা হতো; কিন্তু আমি কোনো খেলায়ই পারি না। অপদার্থের মতো দাঁড়িয়ে
থাকি। এমনকি আমি সাইকেলও চালাতি পারি না।
স্মৃতিচারণ করতে করতে মিলন
বলেন, সে সময়ে আমি যেটা পারতাম, তা হলো পড়া। আমাদের ওই গেন্ডারিয়াতে যে বছর
আমার জন্ম হয়েছিলো; সেই ৫৫ সালে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।
লাইব্রেরীটির নাম সীমান্ত গ্রন্থাগার। এরকম একটি টিনের ঘরেই সে
গ্রন্থাগারটি যাত্রা শুরু করেছিলো। সে সময় স্কুল থেকে ফিরে সবাই যখন মাঠে
খেলতে যেতো; আমি চলে যেতাম লাইব্রেরীতে। সীমান্ত গ্রন্থাগারে বসে বসে আমি
বই পড়তাম। সেখানে মাঝে মাঝে আমার বয়সি একজন লেখক আসতেন। যেদিন তার লেখা
ছাপা হতো; দেখে মনে হতো গৌরবে-অহংকারে তিনি মাটির ৬ ইঞ্চি উপর দিয়ে
হাঁটছেন! এটা ঠিক স্বাধীনতার পরপর ’৭২ সালের কথা। তখন আমার মনে হতো- ওই
ছেলে যদি লিখতে পারে পারে- তবে আমি কেনো পারবো না। আমিও তো সেখানে বসে বসে
বই পড়ি। সে সময় আমি একটা গল্প লিখলাম বাচ্চাদের গল্প।
এ পর্যায়ে তিনি
বলেন, গুগলে যারা সার্চ দেন; তারা দেখতে পান ‘স্বজনী’ নামক একটি গল্প দিয়ে
আমার লেখক জীবন শুরু। তথ্যটি আসলে সঠিক নয়। আমার জীবনের প্রথম গল্পটির নাম
বন্ধু, সেটি ১৯৭৩ সালে ছাপা হয়েছে। সে ঘটনাটিই আমি আজকে আপনাদের শোনাতে
চাই। সে সময়ে ওই বন্ধুটিকে যখন দেখলাম তার লেখা নিয়ে সে যখন এক ধরনের ইর্ষা
বোধ, গৌরব করে- তখন আমি ভাবলাম দেখি আমিও চেষ্টা করে লিখতে পারি কি না।
আমি একটা গল্প লিখলাম- একটা বানরের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলের বন্ধুত্ব নিয়ে।
গল্পটি পূর্বদেশ নামক একটি পত্রিকায় পাঠালাম। পত্রিকাটি স্বাধীনতার আগে
থেকেই প্রকাশ হতো। এখন বন্ধ হয়ে গেছে। পরের সপ্তাহেই আমার গল্পটি ছাপা হলো।
ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে আমার যেটা হলো- আমি দশবারোটা কাগজ কিনালম, সংগ্রহ
করলাম। এবং আমার যে বন্ধুটিকে মনে হতো মাটির ৬ ইঞ্চি উপর দিয়ে হাটে; আমার
লেখা ছাপা হওয়ার পর মনে হলো আমি যেনো দেড়-দুই ফুট উপর দিয়ে হাঁটছি!
অহংকারটা এই পর্যায়ে আসলো। যাকে হাতের কাছে পাই তাকেই দেখাই। এভাবেই আমার
লেখালেখি শুরু হলো। আমাদের এলাকায় একটা প্রবাদ আছে ‘কচু গাছ কাটতে কাটতে
ডাকাত হয়ে যায়।’ আমিও ওরকম লিখতে লিখতে লেখক হয়ে গেছি। ওই যে শুরুটা
হয়েছিলো...।
ভালো ও মানসম্মত লেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইমদাদুল হক
মিলন বলেন, ভালো লিখলে সম্মান পাওয়া যায়, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা যায়।
এজন্য প্রয়োজন সঠিক কাজটি শুরু করা। যে কোনো ভালো কাজ একবার শুরু করে দিলে
বাকিটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়ে যায়। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘নূরজাহান’ এর
প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, সে সময় আমি প্রচুর প্রেমের উপন্যাস লিখছি;
বিক্রিও হচ্ছে দেদারছে। একদিন মেলার একটি স্টলে বসে বই ক্রেতাদের অটোগ্রাফ
দিচ্ছি। সামনে পাঠকদের দীর্ঘ সারি। তো এমন সময় একজন মাঝবয়সি মহিলা আসলেন।
আসতেই আমি তাকে একটি অটোগ্রাফসহ বই দিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে থমকে দিয়ে
বললেন- আমি কি অটোগ্রাফ চেয়েছি? আমি বললাম- তাহলে?
তিনি বললেন- আপনি এসব
কি লিখছেন? প্রেমের গল্প লিখে তো ছেলে-মেয়েদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছেন।
ভালো কিছু লিখেন, সৃষ্টিশীল কিছু করেন। তাঁর কথাটা আমার মাথায় ভন-ভন করতে
লাগলো। মেলা থেকে আমি বাসায় ফিরলাম হাঁটতে হাঁটতে। আর ভাবতে লাগলাম কি
লিখবো, কি লিখবো। এসময় আমার মাথায় আসলো নূরজাহানের কথায়। যাকে দ্বিতীয়
বিয়ের অপরাধে ফতোয়া দিয়ে গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ১০০ পাথর নিক্ষেপ করা
হয়েছিলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ‘নূর জাহান’ লিখবো। তিন পর্বে সাড়ে ১২ শ’
পৃষ্ঠার উপন্যাসটি লিখতে সময় লেগেছিলো ১৮ বছর। এর পরের ইতিহাস আশাকরি
আপনাদের সকলেরই জানা...।
এর পরের ও আগের ইতিহাস আমরা জানি। বাংলা
সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের প্রকাশিত গ্রন্থের
সংখ্যা প্রায় ২ শত। ‘নূরজাহান’ ছাড়াও অধিবাস, পরাধীনতা, কালাকাল, বাঁকাজল,
নিরন্নের কাল, পরবাস, কালোঘোড়া, মাটি ও মানুষের উপাখ্যান, পর, কেমন আছ
সবুজপাতা, জীবনপুর প্রভৃতি তার বিখ্যাত বই।
গল্প উপন্যাস ছাড়াও তিনি
নাটকও লিখেছেন দেড়শতাধিক। তাঁর নাটকের মধ্যে কোন কাননের ফুল, বারো রকম
মানুষ, রূপনগর, যুবরাজ, কোথায় সেজন, আলতা, একজনা, নীলু, তোমাকেই, ছোছা কদম,
আঁচল, খুঁজে বেড়াই তারে, কোন গ্রামের মেয়ে, মেয়েটি এখন কোথায় যাবে, বিপুল
দর্শকপ্রিয়তা পায়।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার
তাকে ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে
ভূষিত করে।
সেদিন নাঙ্গলকোটের গ-গ্রামে গণপাঠাগার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে
উপস্থিত সবাইকে বিনয়ী ও ন¤্র-ভদ্র হওয়ার পরামর্শ দিয়ে মিলন বলেন- ‘বিনয়
মানুষকে বড় করে তোলে। মানুষ বড় হলেই দেশ বড় হয়। এ জন্য আমাদের ভালো মানুষ
হতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সোনার মানুষে হিসেবে গড়ে তুলেতে হবে। আমাদেরকে
বেশি বেশি ভালো কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। শুভ চিন্তার উদয় ঘটাতে হবে।
দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। বড় মনের মানুষ হতে হবে। তবেই দেশের সার্বিক
কল্যাণ হবে।
আলোচনায় উঠে আসে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
প্রসঙ্গও। মিলন বলেন, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
মাঝেও বিনয় ছিলো। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা; রাজনীতি করতেন মানুষের
কল্যাণের জন্য। বঙ্গবন্ধু আকাশের মতো। আমাদেরকে ছায়া দিয়ে রাখছেন- পুরো
জাতিকে ছায়া দিয়ে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার আলোয়
আলোকিত। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই দেশে এতো উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
সুযোগ
পেলে কোনো একদিন আবারো নাঙ্গলকোটের এ অজপাড়াগাঁয়ে ঘুরতে আসবেন জানিয়ে মিলন
বলেন, আমি আবার আসবো নাঙ্গলকোটের এ গ- গ্রামে। দেখতে আসবো কতটুকু আলোকিত
হয়েছে নাঙ্গলকোট- এ গণপাঠাগারের আলোয় কতখানি আলোকিত হয়েছে গ-গ্রামের মানুষ।
তাঁর ভাষ্য, এ লাইব্রেরীর মাধ্যমে একজন মানুষও যদি আলোকিত হয়; তবেই এর
প্রতিষ্ঠা সার্থকতা পাবে।
সংসারের সং খালেদ চৌধুরী ।।
মা’র
ধারণা বাবার মাথায় পোকা আছে। তিনি পোকার কথারমতো চলেন। না হলে কেউ
পায়খানার ভেতর দিয়ে ছাদে উঠার সিঁড়ি রাখে! বাড়িতে দুটো শৌচাগার। বাবার
যুক্তি একটা টয়লেটকে দ্বৈত বানিয়ে জায়গার অপচয় রোধ করেছেন। কম করে হলেও
প্রতিদিন বাবা-মা’র ৪/৫ বার ঝগড়া হয়। ঝগড়াই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের
বন্ধন। বিকেলে স্কুল মাঠে ঘোরাফেরা করি। বাসা থেকে বের হব। সেই পলকে টয়লেটে
যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। আর দমানো গেল না। এক দৌড়ে কাজ সারতে যাই।
ভেতরে কে জানি আছে। সহ্য করতে না পেরে বাবার বিকল্প মলআধারে। সেখানে দরজা
ভাঙা। তার পর আবার টু-ইন-ওয়ান-ঝামেলা।
এ টয়লেটের নিয়ম হলো, ভেতরে গেলে
গান গাইতে হয়। আমি পরপর কয়েকটা গান গাই। হঠাৎ কী মনে করে গান থামিয়ে দেই।
আমার চাচাতো বোন বিথি ঢুকে যায়। তাকে দেখে আমার ভূত দেখার মতো অবস্থা। সে
দেখে দ্রুত বেরিয়ে যায়। তখন পুরো বাড়ি তার মাথায়। চারদিকের বাতাসে ধ্বনিত
যাচ্ছিল হি-হি-হি। লজ্জায় আমার দেয়ালে টানানো ফটো হতে ইচ্ছে করছিল।
চোদ্দগোষ্ঠির চাচাতো ভাই-বোনেরা আমাকে দেখতে এসেছে। আমি যেন সার্কাসের লাল
বান্দর। খাঁচা থেকে পালিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছি। সবাই চলে যাবার পর বাথরুমে
যাই। আপু... এই আপু লুঙ্গিটা দে। শুনতে পাচ্ছিস না।
-এই নে লুঙ্গি।
লুঙ্গি পরে রুমে যেতে না যেতেই বাবার রুমে আমার ডাক পড়ে। বাবা শুয়ে আছে।
-আচ্ছা বাবা তুমি কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ কোথায় উদাও হয়ে যাও?
-উদাও হয়ে যাই, কে বলেছে?
-মা। জানো তুমি যখন ছিলে না। মা আর কী বলেছে?
-কী বলেছে?
-তুমি নাকি আর একটা বিয়ে করেছো?
বিয়ের কথা শুনে বাবা হাসতে শুরু করে। দমবন্ধ মটরসাইকেলের মতো হাসি থামিয়ে বলে,
-তাই নাকি!
-সত্যি করে বলোতো কোথায় গিয়েছিলে?
-তোর জন্য একটা টি-সার্ট এনেছি।
টি-শার্টের কথা শুনে হুড়মুড়িয়ে খাট থেকে নেমে ব্যাগে খুঁজি।
-নেইতো বাবা।
-ভালো করে দেখ।
টি-শার্ট গায়ে দিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াই। তার পর বের হয়ে যাই।
-কিরে গেঞ্জি পেলি কোথায়?
-গেঞ্জি বলছিস কেন? টি-শার্ট বলতে শরম করে।
শব্দটা শুনে বিথির আকাশে শ্রাবণের ঘনঘটা।
-আমার জন্য কিছু আনেনি?
-ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন? বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
২.
মা শুকনো কাপড়ের জন্য ছাদে গেছেন। বিথিও সেখানে যায়। তখনো ওর চোখে কেচুরমতো ধীরে জল গড়ায়।
-তোর আবার কি হলো?
-বাবা শিমুলের জন্য সুন্দর একটা টি-শার্ট এনেছে। আমার জন্য কিছু আনেনি।
-নাকি কান্না কাঁদবি না। গতবার তোর জন্য এনেছে না?
বিথি
হ্যাঁ-না কিছু বলে না। চোখ মুছে। মা ছাদ থেকে চলে গেলে আবার ঝরণাধারা।
কোথা থেকে এত জল আসে! মা’র কাছ থেকে ধার নেয় কি না কে জানে? বাবা বিথিকে
ডাকে। মা ছুটে এসে বলে,
কী হলো শুনছিস না?
-ডাকুক।
-যাবি না?
-না।
-গিয়ে দেখ, হয়তো তোর জন্য কিছু এনেছে।
বিথি বাবার ঘরে যায়।
বাবা ডেকেছ?
-সেই কখন থেকে ডাকছি, দেরি করলি যে?
-শিমুলের জন্য টি-শার্ট এনেছ।
বাবা হা-হা করে হেসে উঠলেন।
-তাই বুঝি।
-কিসের জন্য ডেকেছ?
-বালিশটা ওঠা।
বালিশ উল্টিয়ে বিথি দেখে স্বর্ণের চেইন।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
-তুমি এত্তো ভালো।
বিথি চেইনটা নিয়ে মা’র কাছে যায়। তোকে খুশি খুশি লাগছে, কী ব্যাপার?
-দেখো বাবা এনেছে।
-খুব সুন্দর হয়েছে। যতœ করে রাখিস।
আজ
বিথির আনন্দের সীমা নেই। ইচ্ছে করছে শিমুলকে বলে, তোর গেঞ্জিটার দাম কত?
তার পর তার চেইনটা দেখিয়ে বলবে, এটার দাম কত জানিস? বাবা এনেছে। সঙ্গে
সঙ্গে শিমুলের চোখে ছলছল করবে। তার জন্য মায়া হবে। তবুও নিষ্ঠুর সাজার জন্য
ভিলেন মার্কা হাসি হাসতে হবে। না থাক। ওকে কাঁদিয়ে লাভ নেই।
৩.
বাবা
বাড়িতে আসার পর মা’র সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। মা একটু কড়া। মা ড্রেসিং
টেবিলের সামনে বসে লম্বা চুলে তেল দিচ্ছে আর বাবার সঙ্গে কথা বলছে।
-তুমি
মাঝে মাঝে কোথায় হাওয়া হয়ে যাও? কিছুই তো বলো না। যদি মরে পড়ে থাকো তোমার
বউ বাচ্চা কে পালবে? ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে-হেঁয়ালিপনা রাখো। আর না-বলে কোথাও
যাবে না।
-প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। বসের যেই সময় যেই কথা। চিটাং গিয়েছি।
-এভাবে আর যাবে না।
-ঠিক আছে যাব না।
-যাব না বললে হবে না। ওয়াদা করো। এর আগেও তুমি এ কথা বলেছ।
৪.
বিকেলে
বের হতে পারিনি। সন্ধ্যার পর বের হওয়া মানে ১৪৪ ধারা ভাঙা। এর মানে মা’র
হাতের শক্ত পিটুনি। মা বেশি রাগলে রুটির বেলুনি দিয়ে পিটান। ইচ্ছে থাকলেও
বেরুতে পারছি না। ভাবছি কোন ছুঁতোয় বের হব। বিথির কাছ সাহায্য চাইব? ও
সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয় না। বিদেশি পরামর্শকের মতো আকামের পরামর্শ
দেবে। তার কাছে না-যাওয়াই ভালো। তাছাড়া মাকে বলে দেবার সম্ভাবনা আছে। চাচার
বাড়ি সামান্য দূরে। ঠিক করেছি ছোট চাচার বাসায় যাবার কথা-বলে ঘর থেকে বের
হবে। যদিও মা বলবে, এখন কেন? কী জন্য যাবি? পড়া নেই? মা’র কাছে যাই। মাকে
বলি, ‘চাচার বাসায় যাচ্ছি’। মা অবাক করে বলে, ‘দেরি যেন না হয়।’ সন্ধ্যায়
ঘর থেকে বের হবার উদ্দেশ্য একটাই। বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেব। মাসুদ রানা পড়ে
আমরা কয়েকজন একটা গোয়ান্দা দল গড়েছি। দলের নাম ব্যাঙ। কুনো ব্যাঙ ঘরের
কোনায় লুকিয়ে থাকে। আমরাও লুকিয়ে দুষ্টু লোকের অপকর্ম রেকর্ড করব। যদিও এটা
নব্বই দশক না। পুরাতনকে আবার নতুন করে সাজানো এই আর কি।
স্কুলের পেছনে
আমাদের বৈঠক শেষে বাড়ি ফিরছি। পুকুরের পাড় ঘেঁসে সরু রাস্তা। বৃষ্টির পর
পিচ্ছিল। পুকুরে পড়ে যাই। সাঁতার জানি বলে রক্ষা। এখন বাড়িতে ঢুকব কীভাবে?
মা যদি জানে আমাকে আস্ত রাখবে না। ইলেকট্রিসিটি নেই। চাঁদের আলোয় সবকিছু
আবছা। মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো রকমে ঘরে ঢুকি। লুঙ্গির মতো একটা কিছু পরে
প্যান্ট বদলাই। তখনো কারেন্ট আসেনি। শরীরটা খারাপ লাগে। গুচ্ছ গুচ্ছ
তন্দ্রাভাব তুলোর ক্ষেত। ঘুমের ঢুস লাগা মুহূর্ত কেটে যায়। খাবার খেতে যাই।
মা’র হাতে মোম জ¦লছে। সোনালি আলোয় মাকে স্বর্ণপ্রতিমা লাগছে। আমি মা’র
কাছে দাঁড়াই। বাবা আর বিথি খাচ্ছে। কারেন্ট চলে আসলে বাবা আর বিথি অঝরে
হাসে। মা বুঝতে পারে না, তারা হাসছে কেন? আমিও না। দেখি আমার পরনে একটা
পেটিকোট। নিজের চোখকে বিশ^াস করতে পারছি না। দৌড়ে রুম থেকে বের হতে যাই।
সেখানেও বিপত্তি আছাড় খাই। বাবা আর বিথির হাসি আরও বেড়ে যায়। রুমে গিয়ে
পেটিকোট পাল্টে প্যান্ট পরি। আমার এ অবস্থার জন্য অন্ধকারকে দায়ী করি।
একদিনে দু-দুবার লজ্জিত হই। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। খুব খারাপ
লাগছে।
৫.
বিথির মন খুব ভালো। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই মন খারাপ বলে কোনো বিষয় আছে। তার চাচাত বোন সোহা এসে বলল,
-তোকে এত খুশি খুশি লাগছে, কি ব্যাপার?
-বাবা সুন্দর একটা হার এনেছে।
-চাপা মারার আর জায়গা পাছ না। মিথ্যা কথা একটু কম বলবি তাইলে বেশিদিন বাঁচবি।
বিথি হারটা সোহাকে দেখায়।
-চোখে দেখে বিশ^াস হলো তো!
বিথি হারটা গলায় দিয়ে আয়নার সামনে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে এবং দেখায়।
৬.
শিমুলের
বাবার মধ্যে একটা স্থিতি চলে এসেছে। তিন মাসের মধ্যে একবারের জন্যও বাইরে
গিয়ে থাকেনি। নিখোঁজও হয়নি। বিকেলে বাবার সঙ্গে লুডু খেলে। শিমুল চুরি করে
গুঁটি পাকিয়ে ফেললে দুই ভাইবোনের মধ্যে খুনসুটি। সেদিন বিকেলে বিথি আর
শিমুলের মধ্যে ফাইনাল খেলা হবার কথা ছিল। তাদের বাবা প্রধান অতিথি হিসেবে
থাকবেন। খেলা শেষে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। কিন্তু বাবা কথা
রাখেনি। তারা বাবার জন্য অপেক্ষা করেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে আবার সেই অন্ধকার।
তিনি ছয়টার মধ্যে বাসায় না ফিরলে আর ফিরেন না।
৭.
সাত দিন ধরে বাবার
দেখার নেই। কারও মধ্যে কোনো উদ্বেগ নেই। একটা মানুষের কয়েক মাস পরপর উধাও
হয়ে যাওয়া যেন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। শিমুল বলছে, ‘এবার আমার জন্য উপহার
আনবে।’ বিথি বলছে, ‘না এবার আমার জন্য উপহার আনবে।’
-গতবার তোর জন্য এনেছে।
-তোর জন্যও তো এনেছে।
৮.
বাড়ির
সামনে একটা প্রাইভেট কার থামে। শিমুল ও বিথি পরস্পরের দিতে ভাবভোলা তাকায়।
কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ছাদ থেকে দেখে তাদের বাবা গাড়ি থেকে নামে। বউয়ের
সাজে একটা মহিলাও গাড়ি থেকে নামে। শিমুল আর বিথি বুঝতে পারে না। কার কাছে
যাবে? মা’র কাছে যাবে না বাবার।
এক গুচ্ছ কবিতাআবেদিন মাওলার ।।
মর্মাহত তবু ভালোবাসা
সবচেয়ে ভালো কে? আমি ।
সবচেয়ে মন্দ কে? আমি ।
সবচেয়ে জ্ঞানী কে? আমি ।
সবচেয়ে বোকা কে? আমি।
এই “ আমি” থেকে মুক্ত হওয়ার
কোন বিশ্ব বিদ্যালয় নেই জেনে
যারা মর্মাহত হয়েছেন তাদের প্রতি ভালোবাসা।
লজ্জার কথা
ডাহুক দিয়ে ডাহুক ধরতে আসা
ছিপছিপে লোকটা বলেছিল
এতো প্রশ্ন করেন কেন ?
প্রশ্ন থামিয়ে আমি
আবার প্রশ্নই করেছিলাম
আপনি কী করেন?
লোকটি বলেছিল ‘চুরি করি’
‘ শিক্ষিত ডাহুক দিয়ে মূর্খ ডাহুক ধরি’
সেদিনের লজ্জা এখনও লেগে আছে।
মাছ দু প্রকার
নগরের শিশু মাছের নাম জানে না, মাছ চিনে না।
শিশু বলে মাছ দু প্রকার: মরা মাছ এবং লরা মাছ।
শ্যাওলা ও তঙ্কার গল্প
বহু বছর আগে তিস্তার জলটানেলের ভেতর
সাাঁতার দিয়ে আটকে গিয়েছিল এক যুবক
তাকে মনে হলে দেখি পানির উঁচু নিচু স্তর
শ্যাওলার সবুজ রঙ, দম আটকানোর চতুরতা
তাঁর মৃত্যুতে যারা কেঁদেছিল সেদিন
তারাও ভুলে গেছে তার সাহসী মৃত্যুর কথা।
কেবলি মনে হয় কোন এক দিলরুবা বলেছিল
পারো যদি দেখাও তোমার হিম্মত!
আমারও আছে এক দিলরুবা, তার তরে
তঙ্কাবিহীন হেঁটে পাড় হচ্ছি অবিরাম
শুষ্ক জলহীন শ্যাওলাহীন দীর্ঘ টানেল
একদিন কোন ক্ষুদ্র তঙ্কায় পা পিছলে
পড়ে গেলে যে রক্তপাত হবে নাকে মুখে
তাতেও তঙ্কার গন্ধই ছড়াবে বাতাস
জানি তঙ্কা শ্যাওলার মতই পিচ্ছিল
অথবা শ্যাওলার ভেতর রয়েছে তঙ্কার কাঠিন্যতা
শিশুদের নিয়ে
কাহলিল জিবরান।।
(কাহলিল জিবরান
(১৮৮৩- ১৯৩১) একজন লেবাননের কবি। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় লিখেছেন তিনি। ঊনিশ
শতকের শেষের দিকের আধুনিকমনস্ক সাহিত্যিকদের দ্বারা প্রভাবিত হন। বাইবেল,
উইলিয়াম ব্লেইক ও ফ্রেডেরিক নীৎসের প্রভাব তাঁর লেখায় লক্ষ্যনীয়।
শেক্সপিয়ার ও চীনের বিখ্যাত কবি লাওজি' র পর জিবরানের বই সর্বাধিক বিক্রি
হয়।)
তোমার সন্তানেরা তোমার নয়।
তারা জীবনের প্রয়োজনে জীবনের পুত্র ও কন্যা সন্তান। তারা তোমার মাধ্যমে
জীবন পেয়েছে কিন্তু তুমি তাদের উৎস নও, এবং যদিও তারা তোমার সাথে থাকে
কিন্তু তুমি তাদের মালিক নও। সন্তানদের তুমি ভালোবাসতে পারো, কিন্তু তাদের
চিন্তা-ধারাকে প্রভাবিত করতে পারো না কারণ তাদের নিজস্ব চিন্তা-ধারা আছে
তুমি শারিরীকভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে না,
কারণ তাদের আত্মার অস্তিত্ব আগামীকালে, যা তুমি দেখতে পাও না, এমনকি
স্বপ্নেও না। তুমি হয়তো তাদের মতো করে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করতে পারো, তবে
তাদেরকে তোমার মতো করার চেষ্টা করো না। কারণ জীবন কখনো অতীতের সাথে তাল
রাখে না বা অতীতে ফিরে যায় না। তুমি হলে ধনুক, তোমার ছেলেমেয়েরা জীবন্ত
তীর। ধনুকের মালিকের দৃষ্টি অসীমের দিকে, এবং তিনি তোমার নিয়ন্ত্রক। ধনুকের
মালিকের হাতে তোমার সমর্পণ হোক আনন্দের, কারণ যদিও তিনি উড়ন্ত তীর
ভালোবাসেন, সুতরাং ভালোবাসেন স্থির তীরকেও।
অনুবাদঃ আলমগীর মোহাম্মদ
শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব
সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি,