পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না। জনপ্রিয় একটি গানের লাইন। কিছু কিছু পাগলাটে লোক আছেন যারা পৃথিবীর মানুষকে সবকিছু অন্যভাবে দেখার জন্য বাধ্য করেন। তাদের পাগলামি-ক্ষ্যাপা স্বভাব বদলে দেয় অনেক কিছু, খুব সহজেই।
তেমনি এক মানুষ ছিলেন ফ্রান্সের নাগরিক জ্যাঁ ক্যুয়ে। বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আন্দ্রে মারলোর দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। লাখ লাখ মানুষ শরনার্থি হিসেবে ঠাঁই নিয়েছে ভারতের নানা সীমান্তে। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ ও শিশু। এমনি সময় ৩ ডিসেম্বর প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দর থেকে জ্যাঁ ক্যুয়ে ৫ শতাধিক যাত্রীবাহি পাকিস্তানের একটি বিমান ছিনতাই করে বসেন।
বিনিময়ে মুক্তিপণ হিসেবে তিনি দাবি করেন শরনার্থি বাংলাদেশিদের জন্য বিশ টন ঔষধ ও শিশুখাদ্য। তার দাবি মেনে নেয়া হয়। ডিসেম্বরের ৮ তারিখে ফরাসি রেডক্রস ও নাইটস হাসপাতাল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও শিশু খাদ্য পাঠায়। ধারণা করা হয় তার দাবির মুখে পাঠানো সেই খাদ্য ও ওষুধের জন্য প্রায় ৫ লাখ শিশুর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিলো।
কিন্তু বিমান হাইজ্যাকের মতো একটি গুরুতর অপরাধের জন্য ৩ বছরের জেল হয়েছিলো জ্যাঁ ক্যুয়ের। ফ্রান্স সরকার তাকে শাস্তি দিয়েছিলো ৫ বছরের। সাহিত্যিক আন্দ্রে মারলোর বিশেষ প্রচেষ্টায় সেই শাস্তি দুই বছর কমিয়ে আনা হয়েছিলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি বন্ধুর বীরত্বের গল্পই আমাদের জানা। আমেরিকার রাস্তায় কনসার্ট আয়োজন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের সমর্থন দিয়ে পাশে থাকার জন্য জর্জ হ্যারিসনসহ অনেক বিদেশি বন্ধুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানও জানানো হয়েছে। কিন্তু ফরাসি জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন অজানা অধ্যায়ে।
তার গল্পটা এবার উঠে আসছে সিনেমায়। তার বিমান হাইজ্যাকের সেই দুর্দান্ত গল্পটি নিয়ে সিনেমা বানাতে যাচ্ছেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার ফাখরুল আরেফীন খান। ছবির নাম ‘জেকে ১৯৭১’। ‘ভুবন মাঝি’ ও ‘গণ্ডি’ সিনেমার এই নির্মাতা গেল বছরের শেষদিকেই ছবিটির ঘোষণা দিয়েছিলেন। গেল ৯ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সিনেমাটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন।
সেখানে তিনি বলেন, ‘ছবির গল্পের মূল নায়ক বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য মমতায় পূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী জ্যাঁ ক্যুয়ে। কাহিনিতে দেখা যাবে ১৯৭১ সালেল ৩ ডিসেম্বর। অর্লি বিমানবন্দর, প্যারিস, ফ্রান্স। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে চলছে সাজসাজ রব। কারণ সেদিন ফদ্ধান্সে আসছেন জার্মান ভাইস চ্যান্সেলর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে যে শীতল অবস্থা চলছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এই সফরেই।
এমন সময় বিমানবন্দরের বাইরে একটা ট্যাক্সি থেকে নামে দীর্ঘকায় এক যুবক। পরনে নীল জ্যাকেট, পিঠে ব্যাকপ্যাক। রানওয়েতে পাকিস্তান ইন্টারন্যশনাল এয়ারওয়েজের [পিআইএ] একটা বোয়িং ৭১১ বিমান দাঁড়ানো, কিছুক্ষণ পরেই আকাশে উড়বে সেটা। পাইলট সবকিছু দেখেশুনে নিচ্ছেন, রুটিন মোতাবেক। ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে এগারোটার কাঁটা অতিত্রক্রম করেছে। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠতে দেখা গেল সেই তরুণ জ্যাঁ কুয়েকে।
এরপর অর্লি এয়ারপোর্টের রেডিও বার্তায় একটা মেসেজ এসেছে, সেটা খুলেই চোখ কপালে উঠলো রিসিভারের সামনে বসে থাকা অপারেটরের। বার্তায় লেখা- ‘এই বিমানটা আমি ছিনতাই করেছি, আমার কথা না শুনলে পুরো বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে। আমার ব্যাগে বোমা আছে! কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেড এলার্ট জারি করা হলো অর্লি এয়ারপোর্টে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ততক্ষনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে জ্যাঁ ক্যুয়ের সঙ্গে।
কি চায় সে, কেন বিমানে বোমা নিয়ে উঠেছে, কি তার উদ্দেশ্য? জবাব এলো, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যে বিশ টন ঔষধ বিমানে তুলে দিতে হবে, তাহলেই কেবল মুক্তি পাবে বিমানের নিরীহ যাত্রীরা। এরপর তার সেই দাবি মেনে নেয়া ও তার শাস্তি বরণের ঘটনাগুলো উঠে আসবে এ সিনেমায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছবির প্রয়োজনে জ্যাঁ ক্যুয়ে সম্পর্কে জানতে গিয়ে তার চরিত্রটির প্রতি মুগ্ধ হয়েছি। একজন পাগলাটে মানুষ। স্বাধীনতাকামী। নিজের দেশে বসে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য পাগলামি করে বেড়িয়েছেন। নিজেকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন বারবার মানুষের জন্য ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। শুধু দেশেই বসে থাকেননি তিনি।
তাকে দেখা গিয়েছে ভারতেও, বাংলাদেশি শরনার্থিদের সঙ্গে। সেখানে তিনি ১ টাকার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে আটকও হয়েছিলেন একবার। কলকাতায় থাকতে থাকতে সেখানে একটি বিয়েও করেছিলেন। খুব বেশিদিন সংসার করেননি। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান। তারপর একবার নাকি দেখা গেছে হিমালয়ে। আবার দেখা গেছে অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো শহরে।
সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ‘জেকে ১৯৭১’ সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করছেন মাসুম রেজা। এতে থাকছে একটি মাত্র গান। ইংরেজিতে রচিত এই গানটি লিখেছেন ও গেয়েছেন সোলস ব্যান্ডের নাসিম আলী খান। পুরো ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব আছেন পার্থ বড়ুয়া।
এই ছবিতে জ্যাঁ ক্যুয়ে চরিত্রে অভিনয় করবেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা শুভ্র সৌরভ দাস। এর আগে তাকে দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। আর বিমানের পাইলটের ভুমিকায় অভিনয় করবেন সব্যসাচী চত্রক্রবর্তী। এছাড়াও আরও ৩৪ জন অভিনয়শিল্পী এতে অভিনয় করবেন। যা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। তাদের বেশিরভাগই ইউরোপ-আমেরিকার।
জানা গেছে, আগামী এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কলকাতার দুর্গাপুরের বিমানবন্দরে ছবিটির দৃশ্যধারণ শুরু করবেন ফাকরুল আরেফীন খান। সেখানেই টানা ছবিটির দৃশ্যধারণ শেষ হবে।
আর চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর ছবিটির মুক্তি দেওয়া হবে। কারণ ১৯৭১ সালের এই দিনেই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল।
ফাখরুল আরেফীন খানের নতুন সিনেমার জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিচালকের বাবা-মা, স্ত্রী ও কন্যা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম হামিদ, সংগীতশিল্পী নাসিম আলী খান, অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার, অপর্ণা ঘোষ, অভিনেতা মাজনুন মিজানসহ অনেকে।