জাগো
নিউজ: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। গত জানুয়ারির
মাঝামাঝি থেকে করোনা সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায় থেকে এক ধাপ নেমে কাস্টার
(গুচ্ছ) পর্যায়ে, অর্থাৎ ব্যক্তি বা পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময়
সংক্রমণের হার কমে দুই শতাংশে নেমে আসে। তবে গত দুই দিন এ ভাইরাসের সংক্রমণ
হার বেড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি দাঁড়িয়েছে।
চলতি মাসের শেষে স্কুল, কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার ঘোষণা আছে। ফলে বর্তমানে সংক্রমণের হার বৃদ্ধিতে
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিার্থী ও তাদের অভিভাবকর উদ্বিগ্ন। এছাড়া বর্তমান
পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, পর পর দুই
সপ্তাহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার পাঁচ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি অব্যাহত
থাকলে ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাবে।
রোগতত্ত্ববিদ
ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সংক্রমণরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি
প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি (ঘরের বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক পরিধান
করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার, সাবান অথবা ছাই দিয়ে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব
মেনে চলা, জনসমাগমস্থলে না যাওয়া) মেনে চলার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ব্যাপক
উদাসীনতা করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সম্প্রতি করোনার হার কমে
যাওয়া ও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় মানুষ মনে করছে করোনা চলে গেছে।
কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালীন যেভাবে কঠোরভাবে
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ অন্যান্য সতকর্তা অবলম্বন করা হয়েছে, আবার সেই
সতকর্তা অবলম্বন না করলে সংক্রমণের হার বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন
তারা।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্যরা নতুন
করে উদ্বিগ্ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) কমিটির সদস্যরা অনলাইনে জুম মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনাক্রমে তারা সরকারকে খুব শিগগিরই কিছু পরামর্শ দেবেন বলে জানা গেছে।
জাতীয়
পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি
অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে
রাজধানীসহ সর্বত্র মানুষের মধ্যে চরম উদাসীনতার কারণে ফের সংক্রমণ বাড়ছে।
সংক্রমণ রোধে করণীয় নির্ধারণে গতকাল মঙ্গলবার রাতে জাতীয় কমিটির সদস্যরা এক
সভায় মিলিত হয়ে বেশকিছু করণীয় ঠিক করেছেন। শিগগিরই তা সুপারিশ আকারে
সরকারের কাছে উত্থাপন করা হবে।
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে
আলোচনায় যেসব পরামর্শ এসেছে তার মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি
মেনে চলার ব্যাপারে শিথিলতা দূরীভূত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং
মানুষকে উৎসাহিত করতে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশের বিমান, স্থল ও সমুদ্রসহ বিভিন্ন বন্দরের প্রবেশমুখে যাত্রীদের
স্ক্রিনিং ও কোয়ারেন্টাইনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সরকারি ও
বেসরকারি রাজনৈতিক দল ও ওয়াজ মাহফিলে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোজার
মাসেও টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়
খোলার আগে শিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টিকাদান শেষ করতে হবে। প্রয়োজনে ১৮
বছরের বেশি বয়সী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিার্থীদেরও টিকার আওতায় আনার
উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ডা. ইকবাল আর্সলান জানান, সম্প্রতি তিনি
তার নিজ জেলার একটি উপজেলা পরিদর্শনকালে কোথাও মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক বা
শারীরিক দূরত্ব দেখতে পাননি। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, বিদেশ
গমনেচ্ছুদের বাদ দিয়ে করোনাভাইরাসের নমুনা শনাক্তের হার বিবেচনায় নিলে,
সংক্রমণের হার আরও বেশি হবে। তাই করোনার সংক্রমণরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে
চলার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে পারলে
তা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, যুক্তরাজ্যেফেরত
যাত্রীদের পাঁচ-ছয়জনের মধ্যে করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে। নতুন ধরনের
সংক্রমণের মতা সাধারণ ভাইরাসের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তাই বন্দরের প্রবেশমুখে
কঠোরভাবে যাত্রীদের স্ক্রিনিং, সনদ যাচাই ও কোয়ারেন্টাইন প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য
অধিদফতরের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর)
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন বলেন, নতুন করে করোনাভাইরাসের
সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর আরও বেশি
গুরত্বারোপ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালতে ‘নো মাস্ক নো
সার্ভিস’ আরও বেশি জোরদার করতে হবে। মাস্ক পরার ব্যাপারে আগে যে কড়াকড়ি ছিল
তা আবার শুরু করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ভ্যাকসিন দিচ্ছি, সংক্রমণ একটু
কমেছে বলে সবাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছি, যা মোটেই কাম্য নয়। বিশেষ করে
পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপক জনসমাগমে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলায় চরম
ঝুঁকি তৈরি করছে। এেেত্র ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি এ
ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গণমাধ্যম
গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশে গত জানুয়ারিতে ঢাকার হযরত
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
দিয়ে আগত যুক্তরাজ্যফেরত ছয়জন যাত্রীর মধ্যে করোনার নতুন ধরন পাওয়া যায়।
নতুন ধরনের এ ভাইরাসের সংক্রমণ মতা সাধারণ করোনার চেয়ে বহু গুণ বেশি।
এ
প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. আলমগীর হোসেন বলেন, দেশে যুক্তরাজ্যে ফেরত যেসব
যাত্রী আসেন, তারা কোয়ারেন্টাইনে থাকেন এবং কোয়ারেন্টাইন শেষে বাড়িতে গেলেও
তারা ফলোআপে থাকেন। এখন পর্যন্ত ওইসব যাত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং
তাদের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ ঘটেনি।
ব্রাজিলে যে ধরনের করোনাভাইরাসের
সংক্রমণ ঘটেছে তা আমাদের দেশে পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,
আমরা ভাগ্যবান যে, ওইসব অঞ্চল থেকে মানুষ কম আসে। এখন পর্যন্ত ব্রাজিলের
করোনাভাইরাসের ধরন দেশে পাওয়া যায়নি।
করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি
সম্পর্কে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.
মোশতাক হোসেন বলেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়েও কাস্টার পর্যায়ে করোনার
সংক্রমণ ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের হার বাড়ছে এবং এ হার দুই
সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে তা ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করতে হবে।
তিনি
বলেন, কাস্টার পর্যায়ে সংক্রমণ ঘটলে রোগীকে দ্রুত চিহ্নিত, তার সংস্পর্শে
যারা এসেছে তাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করা সহজ হয়। কিন্তু কমিউনিতে
ছড়িয়ে পড়লে এ কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আগামী ৩০ মার্চ স্কুল, কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। এদিকে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ায়
অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় শিাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত কি না জানতে
চাইলে ড. মোশতাক বলেন, শিাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত এখন
পর্যন্ত ঠিকই আছে। দীর্ঘদিন শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা পরোভাবে জনস্বাস্থের
জন্য তি।
তিনি বলেন, শিার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, দরিদ্র
শিার্থীরা কায়িক পরিশ্রমের কাজে যুক্ত হচ্ছে। মেয়েদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকরা অন্য ঝুকিপূর্ণ পেশায় চলে যাচ্ছে। তবে
খোলার আগে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে শিক,
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টিকা দেয়া হচ্ছে।
ড. মোশতাক হোসেন বলেন,
করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার ফলে মৃত্যু সংখ্যা কমে আসবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি
না মেনে চললে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে
করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে কি না, জানতে
চাইলে ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা
ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় হাসপাতালগুলোতে সুচিকিৎসা
ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক ভালো।
স্বাস্থ্য
অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ১০ হাজার ২৮৩টি সাধারণ শয্যা
ও ৫৬৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সর্বশেষ বুধবারের (১০ মার্চ) পরিসংখ্যানে
দেখা গেছে, সাধারণ শয্যায় এক হাজার ৬৯৮ জন ও আইসিইউতে ২০৯ জন রোগী ভর্তি
রয়েছে। সাধারণ শয্যা আট হাজার ৫৯৪টি ও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৩৫৭টি।
এছাড়া হাসপাতালগুলোতে ১২ হাজার ৭৭৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৭১৫টি হাই ফো
নজেল ক্যানোলা এবং ৬৬০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মজুত রয়েছে।
দেশে ২০২০
সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। আর প্রথম করোনা
রোগী মৃত্যু হয় এর দশ দিন পর, ১৮ মার্চ। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায়
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায়
মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৯৬ জনে। এই সময়ে করোনা শনাক্ত
হয়েছে এক হাজার ১৮ জনের। মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫৩
হাজার ১০৫ জন।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে
উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ২৬৪ জন। এ পর্যন্ত
মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ৬ হাজার ৬১৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীার হার ৫
দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৮
শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক শূন্য ৫৯ শতাংশ এবং
শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।