ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি, সতর্কতাও বাড়ুক
Published : Saturday, 13 March, 2021 at 12:00 AM
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি, সতর্কতাও বাড়ুকডা. মুশতাক হোসেন ।।
বাংলাদেশে প্রায় দুই মাস পর করোনা রোগী শনাক্তের হার আবার বাড়ছে। বুধবার এ হার উঠে গেছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে। এর আগে রোগী শনাক্তের হার সর্বশেষ ৫ শতাংশের বেশি ছিল জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ (৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ)। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর গত দুই মাস ধরে সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তা আবার বেড়ে যাওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণগুলোর অন্যতম, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার েেত্র ব্যত্যয়। গত এক বছরে আমাদের দেশে সাড়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়া ও প্রায় ৮ হাজার ৫০০ জনের প্রাণহানির পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করলে বলা যায়, আমরা বড় রকমের বিপর্যয় এড়াতে সম হয়েছি। কিন্তু এখন সংক্রমণের সূচকের যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে আমরা যে স্বস্তির আবহে ছিলাম, এর বিঘœ ঘটবে। পরিস্থিতি বৈরী রূপ নেবে।
কথা হলো, নিয়ম মেনে যদি আমরা না চলি তাহলে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। সংক্রমণ কমাতে যেসব পরীতি পদ্ধতি রয়েছে, সেসব ব্যাপারে সবাইকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ পরীা করতেই আসছে না। আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইনের জন্য যেমন সামাজিক সহায়তা জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার েেত্রও সহায়তা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার েেত্র ঘাটতি থাকার কারণেই সংক্রমণে এখন আবার ঊর্ধ্বগতি ল্য করা যাচ্ছে। একটা বিষয় ল্য করলে দেখা যায়, বদ্ধ ঘরে অর্থাৎ যেখানে আলো-বাতাসের প্রবাহ যথেষ্ট নয়, সে েেত্র ঝুঁকি বেশি। বদ্ধ ঘরে অনেক মানুষ থাকলে ঝুঁকিও বাড়ে। আমরা অনেকেই কর্মস্থল কিংবা বাইরে থেকে সংক্রমণ নিয়ে ঘরে আসছি। এর ফলে অন্যরা অর্থাৎ যারা ঘরে থাকেন তারা সংক্রমিত হচ্ছেন। আমরা দেখছি, শীতপ্রধান কোনো কোনো দেশে সংক্রমণ ফের অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা অনেক নি¤œবিত্তের ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা নেই। তারা অনেকেই বাস করেন একটি ক।ে ফলে আলো-বাতাসের কম প্রবাহের কারণে তারা হয়তো তাদের অজান্তেই অনেকটা ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। আমাদের গণপরিবহনের চিত্রও পুরোনো অবস্থায় ফিরে গেছে। এ জন্য আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংক্রমণ এড়াতে ফের কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনটি বিষয় বিশেষত সবারই মেনে চলা উচিত- মাস্ক ব্যবহার, জনসমাগম যাতে না হয় সেদিকে ল্য রাখা, সচেতন-সতর্ক থাকা। এখন দেশের সিংহভাগ মানুষ এসব বিষয় জানেন, কিন্তু যথাযথভাবে মেনে চলার েেত্র যে ব্যত্যয় পরিলতি হচ্ছে, তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
গত বছর গ্রীষ্ফ্মকালেও সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল- তা যেন আমরা ভুলে না যাই। শীতকাল নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই সংক্রমণের ব্যাপারে আশঙ্কার মাত্রাটা তুঙ্গে ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, শীতের চেয়ে গ্রীষ্ফ্মেই সংক্রমণ বেশি হয়েছে। বিশ্বের অন্য দেশের কথা নাই বা বললাম, কিন্তু আমাদের দেশে লকডাউনকালীন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও মানুষকে দুর্যোগকালীন সহায়তা দিয়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমরা কিন্তু সেই অভিঘাত এখনও সামলে উঠতে পারিনি। এমতাবস্থায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে সজাগ-সতর্ক থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা এও ল্য করেছি, যখন সংক্রমণ কমে আসছিল তখন মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছিল। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বারবার গুরুত্বারোপ করা হলেও অনেকের উদাসীনতা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
শীতের সময় আমাদের এখানে সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছিল বটে, কিন্তু তা শীতের কারণে নয়; যতটা বেড়েছিল সামাজিক কারণে। আমরা দেখেছি, ওই সময় পারিবারিক, সামাজিক বেশ কিছু অনুষ্ঠান হয়েছে নির্দেশনা উপো করে। তারপর সংক্রমণের হারটা নি¤œমুখী হয়। কিন্তু আবার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পেছনে আমাদের দায়টা কোনোভাবেই কম নয়। প্রয়োজনের নিরিখ বিবেচনা করেও ভিড় এড়িয়ে চলা কিংবা জনসমাগমের পরিসর বিস্তৃত না করার চেষ্টা আমরা করতে পারি এবং এর অবকাশও আছে। সর্বাবস্থায়ই চলে আসে সচেতনতার বিষয়টি। দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রায় সর্বস্তরের শিাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দীর্ঘ দিনের বিরতি ভেঙে তা আবার খুলে দেওয়ার দাবি রয়েছে নানা মহলের। কিন্তু এ েেত্র বিশেষ কিছু সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়কে প্রাধান্য দিতেই হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিরাপদ দূরত্বের ব্যবস্থা রেখে শ্রেণিকে পাঠদান পরিচালনার পাশাপাশি চলাচলের েেত্রও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
অবহেলা কিংবা উদাসীনতার কারণে আবার যাতে বড় ঝুঁকির মুখে না পড়ি, তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। যদি সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কিংবা পরিস্থিতি বাধ্য করে লকডাউনের, তাহলে আমাদের জীবনযাত্রাসহ অনেক কিছু ফের কঠিন সংকটের মুখে পড়বে। জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক কর্মকা- সবকিছুই আমরা স্বাভাবিক রাখব সামগ্রিক প্রয়োজনের নিরিখে; কিন্তু তা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি অমান্য কিংবা অগ্রাহ্য করে নয়। সংক্রমণ যদি বেড়ে যায় তাহলে বহুমুখী সংকট দেখা দেবে।
সংক্রমণের ধরনের েেত্রও পরিবর্তন ল্য করা যাচ্ছে। ব্রিটেনের সংক্রমণের ধরন ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিল, দণি আফ্রিকায় যে নতুন ধরন পাওয়া গেছে, তাও ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের পরিবর্তনের ধরন সম্পর্কেও বিশদভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সরকারের সংশ্নিষ্ট প্রতিটি বিভাগকে নজর দিতে হবে।
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আমরা ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে তা প্রয়োগও শুরু করতে পেরেছি। যতটুকু সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভ্যাকসিন দিয়ে আমরা সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকাতে পারব- এ কথা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটুকু বলা যায়, যারা ভ্যাকসিন পাবেন তাদের সংক্রমণ প্রতিরোধের যে মতা গড়ে উঠবে, তাতে তারা যদি সংক্রমিত হনও, তাহলে তাদের অবস্থা গুরুতর হবে না, কিংবা হাসপাতালে যেতে হবে না। ইতোমধ্যে আমরা যে সংখ্যক ভ্যাকসিন পেয়েছি এবং শিগগিরই আরও যে সংখ্যক পাওয়ার আশা রয়েছে, তাতে আপাতত এর কোনো সংকট হবে বলে মনে করি না। ব্রিটেনে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর হাসপাতালে রোগীর ভিড় কমে গেছে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। পরবর্তী পর্যায়ে যে ভ্যাকসিন দেশে আসবে, তা আরও কার্যকরী হবে। ভ্যাকসিন নিঃসন্দেহে করোনার প্রাণঘাতী আতঙ্ক থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পেরেছে। সরকার অন্যান্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের যে চেষ্টা করছে, তা আরও গতিশীল করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনের সংকট নেই, কিন্তু মজুদ রাখতে হবে।
বিভিন্ন দেশ যে ভ্যাকসিন তৈরি করছে, তা আমাদের দেশেও করা যায়। মেধাস্বত্ব আইন শিথিল করে কোনো কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এই ব্যবস্থার বিস্তৃতকরণ দরকার। ডব্লিউটিওর সিদ্ধান্ত আছে ২০২১ সাল পর্যন্ত জীবন রাকারী যেসব ওষুধ রয়েছে সেসবের েেত্র। মেধাস্বত্ব আইন শিথিল করা যাবে। ভ্যাকসিনও তো জীবন রাকারী ওষুধ। তাই ভ্যাকসিনের েেত্রও এ আইন প্রযোজ্য বলে মনে করি। তবে এই মেয়াদ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাড়িয়ে দেওয়া গেলে সবার জন্যই মঙ্গল। যারা এখন ভ্যাকসিনের মূল উৎপাদনকারী, তাদেরও এ ব্যাপারে একমত হতে হবে। আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির সমতা আছে। সরকারি পর্যায়ে এসেনসিয়াল ড্রাগ্স কোম্পানিসহ বেসরকারি পর্যায়েও কয়েকটি কোম্পানি এই সমতা রাখে। আমাদের উৎপাদিত ওষুধ বিশ্ববাজারে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছে। তাই আমাদের পে অনুমোদনক্রমে ভ্যাকসিন উৎপাদন কঠিন নয়। যতদূর জানি, সরকার এ ব্যাপারে এগোচ্ছে। এটা শুভবার্তা। আমাদের এখানে ভ্যাকসিন তৈরির যে চেষ্টা আছে, তাতে উৎসাহ জোগানো দরকার। আমরা যদি পারি তবে তা হবে আমাদের আরেক ধাপ বড় অগ্রগতি।
সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার প্রয়াসও অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। তবে এ ব্যাপারে ব্যক্তির দায় যে অনেক বেশি, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। টিকা নিলেই স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজন নেই- এমনটি যেন কেউই মনে না করেন।

রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর