ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা
Published : Thursday, 18 March, 2021 at 12:00 AM
অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লাতাসনোভা জেরিন উলফাত (নিশাত) ।।
কোন দেশ বা জাতির ইতিহাস সে দেশের বিভিন্ন সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসের বিষয়বস্তুু মানুষের জীবনধারা, মানুষের সমাজ ও সভ্যতার উপর নির্ভর করে। লিখিত, অলিখিত, কথ্য নানা উপাদানের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়। ইতিহাসের মাধ্যমে একটি জাতির অতীতের সংর্স্পশে আসা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তাানিরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অবলম্বন করে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলি, অগ্নিসংযোগ, হত্যা অবলীলাক্রমে তারা চালিয়ে যেতে থাকে সেদিন থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের সূচনা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রেেিত নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগকে মতা হস্তান্তর করা নিয়ে আলোচনা চলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা মতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার জনসাধারণ তাদের দাবি পেশ করে। আন্দোলনে পুলিশ লাঠি চার্জ করে, অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে।
কুমিল্লা জেলা ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা শহর। অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লার ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লায় স্কুল কলেজের ছাত্ররা রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল করে। ধর্মঘটের কঠোর কর্মসূচিতে রেল ও বিমান যাতায়ত বন্ধ থাকে, দোকানপাট বন্ধ থাকে, কোনো সংবাদপত্র ঢাকা থেকে আসেনি। পহেলা মার্চ জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২ মার্চ সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ হরতাল পালন করা হয়। টাউন হলে বিরাট এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৪ মার্চ হরতালের ২য় দিনে পূর্ব দিনের ন্যায় ভোর থেকে যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটানা ৫ দিন এদেশের অন্যান্য জায়গার ন্যায় কুমিল্লায় হরতাল পালন করা হয়। ৬ মার্চ হরতালের শেষ দিন কুমিল্লায় সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক সংখ্যক শোভাযাত্রা বের হয়। মহিলা এবং ছাত্রীদের দুটি শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় প্রদণি করে। ছাত্রীদের শোভাযাত্রা শেষে ফরিদা বিদ্যায়তনে একটি সভা ও একটি ছাত্রীসভা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। ৮ মার্চ পুনরায় টাউনহল ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সমূহে আওয়ামী লীগ ছাত্রনেতাবৃন্দ শেখ মুজিবের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে তার নির্দেশ অনুযায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। কুমিল্লা শহরের আপামর জনসাধারণ গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য প্রদেশের অন্যান্য সকল প্রকার আন্দোলন শোভা যাত্রা ও হরতাল ইত্যাদি পালন করে। ৯ মার্চ থেকে অফিসে যোগদান থেকে বিরত থাকে প্রত্যেকটি সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীগণ। ১১ মার্চে যথারীতি বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশের মতো কুমিল্লা অঞ্চলেও বেসরকারি বাসগৃহের শীর্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ১২ মার্চ  বিকাল ৩টায় বামইল স্কুল প্রাঙ্গণে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় সভাপতিত্ব করে আব্দুল মতিন। ১৩ মার্চ শনিবার বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বেলতলী স্কুল প্রাঙ্গণে এক জনসভা হয়। সভায় প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক খোরশেদ আলম। একই দিনে জঙ্গি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় দাউদকান্দি স্কুল প্রাঙ্গণে। ১৪ মার্চ বাগমারা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের স্বাধীকার আদায়ের বজ্রশপথ নিয়ে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে বিকাল ৩টায় কালির বাজার স্কুল প্রাঙ্গণে এক জনসভা করা হয়। ১৫ মার্চ এ জেলার কোতয়ালী থানার শিবরামপুর গ্রামে সংগ্রামী জনতার এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ মার্চ কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক জরুরী অধিবেশনে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক জরুরী অধিবেশনে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৮ মার্চ কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কাজী জহিরুল কাইয়ুম। সভায় জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক খোরশেদ আলমকে জেলা আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। ১৭ সদস্য বিশিষ্ট এই জেলা সংগ্রাম পরিষদে তিনটি বিভাগ রাখা হয়Ñ অর্থনৈতিক বিভাগ, গণসংগ্রাম বিভাগ, সাংগঠনিক বিভাগ । কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যসহ শিকগণ কুচকাওয়াজ পালন করে। অন্য একটি কলেজের শিক এই কুচকাওয়াজ শিাদান করেন।
কুমিল্লা পশুপালন গবেষণাগারের অফিসার এবং কর্মচারীবৃন্দ ১৮ মার্চে  এক সভায় মিলিত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করেন যে তারা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগ সাহায্য তহবিলে একদিনের বেতন দান করবেন। ২০ মার্চ  ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে শহরের সকল সরকারি ও বেসরকারি বাড়িতে ও যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় । বিকাল ৩টায় ছাত্রলীগ কুমিল্লা জেলা শাখার এক জরুরী কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন অধিকাংশ কাউন্সিলর এবং সভাটি অনুষ্ঠিত হয় নগর মিলনয়াতনে সভায় সাংগঠনিক বিষয়ে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রলীগ কর্মীরা ভবিষ্যতে কীভাবে কাজ করবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২১ মার্চ  বিকেলে টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শহরের প্রতিটি মহল্লায় স্বেচ্ছাকর্মী সমবেত হয়। গোলাম হোসেন সমবেত কুচকাওয়াজ পরিচালনা করেন। ২৩ মার্চ প্রদেশের সকল স্থানে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বিকেলে কুমিল্লা শহর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, জাতীয় শ্রমিক লীগের এক সম্মিলিত কুচকাওয়াজ ও শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে। প্রতিরোধ দিবস উপলে ২৩ মার্চ কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ যুক্ত প্রচেষ্টায় ‘আমারা জোৎ¯œার প্রতিবেশী’ সংস্থা স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি চলন্ত বা ভ্রাম্যমাণ গণসংগীতের আয়োজন করে। একটি খোলা ট্রাকে চড়ে শিল্পী শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করেন। নতুন আয়োজনে শহরবাসী একত্রিত হয়। ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ এর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২৪ মার্চ কুমিল্লা চৌধুরীপাড়া ও গাংচর মহল্লায় শিখা সংগ্রামী পরিষদ নামে একটি সংগ্রাম পরিষদ করা হয়। পরিষদের সভাপতি ও সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন যথাক্রমে অধ্যাপক তাজুল ইসলাম ও মোঃ আবদুন্নুর (বাচ্চু) এবং ৯ সদস্যের একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণেই ২৫ মার্চ রাতের অভিযানেই কুমিল্লায় গণহত্যা শুরু হয়। এই অভিযানে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক, পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমেদসহ অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া  হয় এবং অমানুষিকভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। অসহযোগ অন্দোলনের শুরু থেকেই কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন এই জন্য তাদের হত্যা করা হয়। তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

লেখক: শিক্ষার্থী: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগ।