ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ।।
একাত্তরের মার্চ মাসকে আমরা বলি উত্তাল মার্চ, আগুন ঝরানো মার্চ। তবে ১৯২০-এর ১৭ মার্চ তেমন আগুন ঝরানো ছিল না। তবে এটা ঠিক যে, ওই ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় একটি আগুনের ফুলকির জন্ম হয়েছিল। সেই আগুনের ফুলকি বাঙালির প্রাণে আগুনের ছোঁয়া লাগিয়েছিল একাত্তরের মার্চে। সে কারণেই ’৭১ আমাদের আগুন ঝরানো মার্চ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে যে প্রসঙ্গটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক, সেটি হচ্ছে তিনি কেন বঙ্গবন্ধু? কেন তিনি নেতা? আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমেই উদ্ধৃত করব রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১-এ স্কটল্যান্ডের স্থপতি স্যার প্যাট্রিক গিডেসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, এই স্যার প্যাট্রিক গিডেস বিশ্বভারতীর নকশা তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ একটি জায়গায় কিছু কথা বলেছেন এবং যাতে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই নেতৃত্বের সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞাটি দিয়েছেন। নেতৃত্বের সংজ্ঞা আঁতিপাঁতি করে খোঁজার জন্য আমি যথেষ্ট শ্রম দিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের যে কথাগুলো এখন উদ্ধৃত করব তার মধ্যেই নেতৃত্বের সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা আছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘ও ফড় হড়ঃ যধাব ভধরঃয রহ ধহু রহংঃরঃঁঃরড়হং, নঁঃ রহ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ঃযরহশ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু, ভববষ হড়নষু ধহফ ধপঃ ৎরমযঃষু’- কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর আমার আস্থা নেই, তবে আস্থা আছে সেই মানুষগুলোর ওপর যাদের আছে যথার্থ চিন্তা, মহান অনুভব এবং সঠিক কর্ম।
বঙ্গবন্ধুর যাপিত জীবন, কর্মকা- এবং কৃতীকে যদি বিশ্লেষণ করি, তা হলে আমি দেখতে পাই, তার জীবনকে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য গুণান্বিত করেছিল। প্রথম কথা বলি, যথার্থ চিন্তা। প্রথম চিন্তাটাই হচ্ছে বাংলাদেশকে নিয়ে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হওয়ার পর পাকিস্তানি মোহে আচ্ছন্ন যখন বাঙালি মুসলমান, এমনকি তাদের নেতারা। সেই সময় এক তরুণ ‘বেকার হোস্টেলে’ বসে তার কিছু সাথীকে নিয়ে ছোট্ট একটি সভা করলেন। বলে দিলেন : ‘এই পাকিস্তান বাঙালির অধিকার রা করবে না।’ এবং মেঠো বাংলায় বললেন : ‘ওই মাউড়াদের সঙ্গে থাকা যাবে না।’ অন্নদাশঙ্কর রায় যখন প্রশ্ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে : ‘কখন থেকে আপনি বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ‘সাতচল্লিশ থেকে।’ এই সভার কদিন পরই কলকাতার সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার অফিসে বসেছিলেন কজনের সঙ্গে। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুললেন রাষ্ট্রভাষার। ওই সভায় তিনি বলে দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা। কারণ বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ’৬১-তে কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়ের সঙ্গে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সৌজন্যে গোপন একটি সভায় মিলিত হলেন। সেখানে আলোচনা হলো স্বাধীনতা নিয়ে। দুই কমরেড তাকে বোঝালেন : ‘স্বাধীনতা আমাদের দরকার; কিন্তু ভাই, এখন পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল নয়। এখন দয়া করে স্বাধীনতার কথা বলবেন না।’ সেদিনের তরুণ শেখ মুজিব (বঙ্গবন্ধু হননি তখনো) বললেন : ‘দাদা, আপনাদের কথা মানলাম; কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো আপস করব না।’
ছয় দফা নিয়ে আমি দুটো প্রসঙ্গ হাজির করব তার সঠিক চিন্তার ব্যাপারে। ছয় দফা নিয়ে আমার মনে আছে, আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেক বিতর্ক শুরু হলো। এমন প্রোপটে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ন্যাপ নেতা, তাকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘ভাই, আপনি ছয় দফা দিয়ে কী বোঝাতে চান।’ বঙ্গবন্ধু মেঠো বাংলায় উত্তর দিয়ে বললেন : ‘আরে মিঞা বুঝলা না, দফা তো একটাই, একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ চমৎকার!
১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় তিনি বললেন : “আজ থেকে এ দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’, ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নয়।” আমরা তরুণরা পূর্ব পাকিস্তান কাগজে-কলমে লিখতাম; কিন্তু মুখে বলতাম বাংলাদেশ। তো, এমনিভাবে আমি ধারাবাহিকভাবে যদি বঙ্গবন্ধুর চিন্তাটাকে আপনাদের সামনে হাজির করি, তা হলে দেখব অনেক কথা এসে যাবে।
দুই নম্বর- মহান অনুভব বা মানবিকতা। অসংখ্য কথা আছে। ছোটবেলায় কিশোর খোকা যা ছিলেন তাতেই বোঝা গিয়েছিল, এই কিশোর একদিন অনেক কিছু হবে। জন্মলগ্নে নানা নামকরণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আকিকা দিয়ে তিনি তার (শেখ মুজিব) বাবা-মাকে বলেছিলেন : ‘তোমাদের এই ছেলে অনেক বড় হবে।’ এটা তো কথার কথা; কিন্তু কত বড় হবে, সেটা আমরা বুঝেছি।
সবচেয়ে বড় কথা মানবিকতা। অনেক ঘটনা আছে। মহানুভবতা তার নাতিদীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের জীবনে প্রতিটি পর্যায়ে আমরা খুঁজে পাব।
ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, তার যোগ্যতা হচ্ছে তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। আর অযোগ্যতা হচ্ছে মানুষকে বেশি ভালোবাসেন।
এবারে আসি সঠিক কর্মে। বেশি কথায় যাব না। ৭ মার্চের ভাষণ তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ, সংপ্তিতম ভাষণ; কিন্তু যা বলেছেন তা ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা বললেন, ‘তুমি একটু শুয়ে থাকো কাঁথা মুড়ি দিয়ে।’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) তখন কিশোরী। মাথায়-কপালে ভিক্স মালিশ করে দিলেন। তিনি শুয়ে থাকলেন। অনেকে অনেক কথা বলেছে। কী বলতে হবে, না বলতে হবে। শেষ মুহূর্তে স্ত্রীর মুখোমুখি হলেন, যা তিনি সব সময় করতেন- কী বলব আজকে? বঙ্গমাতা বললেন : ‘তোমার পেছনে বন্দুক, সামনে জনতা- তোমার মনে যা আসে তাই বলবে।’
তার গাড়ি চালিয়ে নিলেন আজীবনের সঙ্গী হাজি মোর্শেদ। মঞ্চে ওঠার আগে প্রশ্ন করলেন বঙ্গবন্ধুকে : ‘আপনি কী বলবেন। কাগজপত্র তো কিছু নাই।’ বঙ্গবন্ধু ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আল্লাহ আমাকে দিয়ে যা বলায় তাই বলব।’ তাই বললেন কবিতার ভাষায়।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বললেন : ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ সরাসরি কথা বলে দিলেন। ’৭৪-এ যখন ইসলামি সম্মেলন সংস্থায় যাবেন, তার পটভূমি আমার একটি বইয়ে ব্যাখ্যা করেছি, তখন তো অনেক বিরোধী মত ছিল। ধর্মনিরপে রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামি সম্মেলন সংস্থায় যাবেন কেন? কিন্তু তিনি গিয়েছিলেন। তা করে যে সঠিক কর্মটি করেছেন, সেটাই প্রমাণিত ইতিহাসে।
এবার দ্বিতীয় অংশে যাই। দ্বিতীয় অংশে আমার বক্তব্য, বঙ্গবন্ধু শুধু বঙ্গবন্ধু কেন? বিশ্ববন্ধু হবেন না কেন? তিনি বিশ্ববন্ধু। বিস্তৃত আলোচনায় যাব না। শুধু একটি কথা বলি : ৭ মার্চের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, সে প্রসঙ্গে অ্যাডওয়ার্ড হিথ, ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে মানুষ যতদিন পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, ততদিন এই ভাষণ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।’ মানুষের সংগ্রাম শেষ হয়নি, শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির আকাক্সায় এই সংগ্রাম যতদিন চলমান ততদিন বঙ্গবন্ধু দীপ্যমান থাকবেন উজ্জ্বল সূর্যের মতো। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্সে জোটনিরপে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন সেই অবিস্মরণীয় উক্তি : ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের প।ে’ আলজিয়ার্স সম্মেলন শেষ হলো। কায়রোর আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো : ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটিমাত্র গুলি না ছুড়ে সারা মুসলিম বিশ্ব জয় করে নিলেন।’ জানা আছে, মুসলিম বিশ্ব আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের কাছে নত হতে হয়েছিল সবাইকে।
১৯৭৩-এ আরব-ইসরায়েল যুুদ্ধে যে স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠানো হয়েছিল ২৮ জন ডাক্তার এবং দুই লাখ পাউন্ড চা পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। এটি যে কোনো মুসলিম দেশ থেকে আরবদের জন্য পাঠানো সবচেয়ে বড় সাহায্য, সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবক দল। কাজেই আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই : সারাবিশ্বের কাছে তার তো আবেদন আছে। সারাবিশ্বের শোষিত মানুষের কাছে তিনি দিকদর্শন দিয়েছেন। সুতরাং তাকে আমরা কেন বলতে পারব না, শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বিশ্ববন্ধুও বটে। শেষ করছি একটি কথা দিয়ে। আজ তো জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, শিশুদের নিয়ে অনেক কথা আছে। একটি কথা উদ্ধৃত করব। তিনি সব সময় সবাইকে বলতেন : ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও, শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ এই মানুষটি নিজে সারাজীবন শিশু ছিলেন। সারাজীবন শিশুর মতো হেসেছেন। যতই দিন যাচ্ছে- শুধু আমাদের নয়, সারা দুনিয়ার ভালোবাসা পাচ্ছেন।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)